thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

গুলশান হামলা

জঙ্গিদের দেওয়া হয় ২৮ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ

২০১৭ জুন ৩০ ২১:২০:৩৩
জঙ্গিদের দেওয়া হয় ২৮ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ

মো. শামীম রিজভী, দ্য রিপোর্ট : এক বছর আগে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ‘সারোয়ার-তামিম বা নব্য জেএমবির’ ৫ সদস্যের নৃশংস হামলায় ১৭ জন বিদেশী, একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক, দু’জন বাংলাদেশী এবং দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।

এই বর্বরোচিত হামলা করার আগে গাইবান্ধার চরাঞ্চলে জঙ্গিদের ২৮ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে হামলার জন্য হলি আর্টিজান তাদের প্রথম টার্গেট ছিল না। জঙ্গিরা গুলশান-বারিধারা এলাকায় ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা করে। হামলার ঘটনার ৩-৪ দিন আগে তারা হলি আর্টিজানকে বেছে নেয়। এ মামলায় বিভিন্ন সময় গ্রেফতারদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও গোয়েন্দারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, হামলাগুলোর আগে ওই বছরের (২০১৬) মে মাসে ‘বড় কিছু করতে হবে’ বলে জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা অন্য নেতাদের জানায়। তখন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ওই জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সর্বপ্রথম জানায় যে, ‘এ ধরনের কাজ করতে পারে এমন ছেলে তার কাছে রয়েছে’। তখন তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে সে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার জন্য দু’জন সদস্য দেয়। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরের একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানে নিহত হয় জঙ্গি নেতা ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ। গুলশান জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারীদের তিনি গাইবান্ধার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিতেন। নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবিতে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল জাহিদুল ইসলামের।

এ প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের।

তিনি বলেন, ‘গুলশানে হামলাকারী এই পাঁচজন যখন কথিত হিজরত করেছিল তখনই তাদের আলাদা আলাদাভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ঢাকা অ্যাটাকের জন্য গাইবান্ধার একটি চরে ক্যাম্প বানিয়ে তাদের ২৮ দিনের স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া হয়। রূপনগরে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নিহত জঙ্গি মেজর জাহিদ তাদের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেছিলেন।’

‘তারপর হামলাকারীদের ঢাকায় এনে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বসুন্ধরার একটি বাসায় রাখা হয়। হামলার জন্য তখনো তারা হলি আর্টিজানকে বেছে না নিলেও তাদের টার্গেট ছিল গুলশান-বারিধারা এলাকায় ঘটনা ঘটানোর। হলি আর্টিজানে বিদেশিদের সবচেয়ে বেশি আনাগোনা হয় এবং শুক্রবারে ভিড় বেশি হয়। সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতেও আসলে তেমন কিছু নেই। ফলে হামলার উপযুক্ত টার্গেট হিসেবে ঘটনার তিন-চারদিন আগেই তারা ওই স্থানটি বেছে নেয়। এরপরই হামলাকারীদের সেখানে হামলার নির্দেশ দেওয়া হয়।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পরে নির্ধারিত দিনে (১ জুলাই) ওই পাঁচজন হামলাকারী বসুন্ধরার বাসা থেকে প্রথমে রিকশায় ও পরে হেঁটে ঘটনাস্থলে যায় এবং রেস্টুরেন্টে হামলা করে। হামলা পরিচালনাকালে সেখানকার কয়েকজন ভিকটিমের মোবাইল ফোন নিয়ে হামলাকারীরা ছবি তোলে। সেই ছবি জঙ্গিনেতা তামিম চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠানো হয়। তারা দুইজন তখন রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। পরবর্তী সময়ে তামিম ও মারজান ছবিগুলো কোথায় পাঠিয়েছিল সে বিষয়ে জানা যায়নি। কারণ আমরা তাদের জীবিত ধরতে পারিনি। তবে হামলাকারীরা হলি আর্টিজানে কোন ডিভাইস নিয়ে যায়নি। ছবি পাঠানোর জন্য তারা ভিকটিমদের মোবাইল ব্যবহার করেছে।’

আর্টিজানে হামলার জন্য যেসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর দিয়ে সংগ্রহ করে আনা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের নব্য জেএমবির অস্ত্র সরবরাহকারী মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এসব অস্ত্র সরবরাহ করেছিল।’

তাকে এই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সে অস্ত্র সরবরাহের কথা স্বীকার করেছে বলেও জানান মনিরুল।

সিটি ইউনিটের প্রধান বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে আমরা এই হামলার কমপ্লিট পিকচার (পুরো ছক) জানতে পেরেছি। তদন্ত করতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু অভিযান এবং গোয়েন্দা তথ্য সব কিছু মিলিয়ে আমরা জানতে পেরেছি এই হামলাটির পরিকল্পনা হয় গত বছরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে। তখন তারা পরিকল্পনা করে যে ঢাকায় বড় ধরনের একটি হামলা করবে যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া কভারেজ পাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে এটি তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে।’

‘এই পরিকল্পনাকে হাতে নিয়ে তারা প্রথমে ক্যাডার বাছাই করে, যে কাদেরকে এই কাজে লাগানো যায়। সেক্ষেত্রে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় কোন অ্যাটাক করতে গেলে অবশ্যই ঢাকার ছেলে লাগবে, যাদের রাজধানী সম্পর্কে ভাল ধারণা আছে। তখন তারা তিনজনকে বাছাই করে। ওই তিনজনের এর আগে একটা দুইটা খুন করার হিস্ট্রি ছিল। এরা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হামলা সফল করতে পারবে কিনা ওই চিন্তা থেকে পরিকল্পনাকারীরা পরবর্তীতে বগুড়া থেকে আরেও দুইজনকে সিলেক্ট করে, যারা হার্ডেন্ট ক্রিমিনাল (অনেকগুলো খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল)’ বলেন মনিরুল ইসলাম।

তিনি আরও বলেন, ‘নব্য জেএমবি নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য এই হামলা চালালেও তাদের নিজস্ব কিছু স্বার্থ ছিল এখানে। এই ধরনের একটি হামলার পরে তারা আশা করেছিল যে প্রচুর সংখ্যক মানুষ তাদের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করে তাদের দলে যোগদান করবে। তাদের রিক্রুটমেন্ট প্রসেসটা খুব ভাল এগুবে। পাশাপাশি তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সোর্স থেকে আরও বেশি অর্থ পাবে।’

‘তবে যারা সরকারের মঙ্গল চায় না, যারা চায় বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হোক, বিদেশিরা আস্তে আস্তে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাক এই হামলায় তাদের ভূমিকা না থাকলেও তারা এতে বেনিফিশিয়ারি হয়েছে। মূল মাস্টার মাইন্ড তামিম চৌধুরী, মাস্টার ট্রেইনার মেজর জাহিদ, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান এরা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসামি। এদের জীবিত ধরা গেলে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনের বাইরে বা ভেতরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যেত।’

অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল বলেন, ‘জঙ্গিরা যখন হলি আর্টিজানে হামলা করে তার আগে ছোট ছোট কয়েকটি হামলা করে তারা বড় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আর্টিজানে হামলার আগে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ দমন কার্যক্রমের সঙ্গে শুধুমাত্র ল অ্যান্ড ফোর্সিং এজেন্সিই সম্পৃক্ত ছিল। গুলশান হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ রুখে দেয়ার আহ্বান জানান। তার ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষই জঙ্গিবাদের বিপক্ষে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করে। এতে একটা গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। জঙ্গিরা হলি আর্টিজানের পর শুধুমাত্র একটা জায়গায় হামলা চালিয়ে সফল হতে পেরেছি, সেটি হলো সিলেটে। এছাড়া তারা আর কোথাও সফল হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘গুলশান হামলার পর আমরা তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে পেরেছিলাম। যারা বাকি ছিল তারা আবার পরবর্তীতে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারী মাসে সংগঠিত হতে চেয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই রমজানকে কেন্দ্র করেই তারা আবার একটা প্রস্তুতি নিয়েছিল। তবে মার্চ থেকে টানা অভিযান চালিয়ে তাদের সেই ক্যাপাসিটিটা আমরা পুরোপুরিই ভেঙে দিতে পেরেছি। এখন আমরা বলতে পারি হলি আর্টিজানের মতো কিংবা তার থেকে বড় ধরনের কোন হামলা করার মতো শক্তি, সামর্থ্ কিংবা মনোবল কোনটাই জঙ্গিদের এই মুহূর্তে নাই। তারা হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে। তবে আমরা আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। জঙ্গিরা চিহ্নিত হয়েছে, তারা সংখ্যায় খুবই মুষ্টিমেয়।’

জেএমবির নতুন গ্রুপ ‘নব্য জেএমবির’ সদস্যরা এ হামলা সংঘটিত করেছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় জানিয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি বর্তমানে সিটি ইউনিট তদন্ত করছে।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/ এনআই/জুন ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর