thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ

ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই!

২০১৭ জুলাই ০৩ ১৯:৫৫:৪৩
ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই!

জাতীয় সংসদের কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল খারিজ হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই সংশোধনী বাতিলের পর বিচারপতিদের অপসারণে এর পূর্বের বিধান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন, সংবিধানের এই সংশোধনী বাতিল হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সরাসরি পুনর্বহাল হবে না। সেক্ষেত্রে বিচারপতিদের অপসারণে এখন একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো।

সোমবার (০৩ জুলাই) প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে আপিল খারিজের এই রায় দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

এ দিন সকাল সাড়ে দশটার সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণায় প্রধান বিচারপতি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের কিছু অংশ বাদ ও কিছু পর্যবেক্ষণসহ সর্বসম্মতভাবে আপিল খারিজ করা হলো।

রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা এবং রিটকারীদের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

মামলার অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, এ এফ হাসান আরিফ ও এ জে মোহাম্মদ আলী।

এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতারাসহ আওয়ামী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবী এবং দেশি বিদেশি বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম কর্মী রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

সকাল ৯টায় আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও প্রায় দেড় ঘণ্টা বিলম্বে শুরু হয় আপিল বিভাগের কার্যক্রম। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটের দিকে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চের অন্য সদস্যদের নিয়ে এজলাসে ওঠেন। এরপরই সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়।

এর আগে একাদশতম দিবসের শুনানি শেষে গত ১ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন আপিল বিভাগ।

বিচারক অপসারণে সংবিধানের এই বিধানটি ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বারবার বদল হয়েছে। ১৯৭২ এর সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর সময়েই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণে অসামর্থ্য ও অসদাচরণ তদন্তের ভার দিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।

সামরিক ফরমান দ্বারা আনা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সংযোজন করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তিত সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাদের লইয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে।

এছাড়া ৯৬ (৪), (৫) ও (৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থে্যর অভিযোগ উঠলে এই কাউন্সিল তদন্ত করবে। কাউন্সিলের তদন্তে যদি দেখা যায়, ওই বিচারপতি শারীরিক বা মানসিক অসামর্থে্যর কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অযোগ্য বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন, তবে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে উক্ত বিচারপতি স্বীয় পদ থেকে অপসারিত হবেন।

পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হলের সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত এক মামলায় জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানের দ্বারা আনা পঞ্চম সংশোধনীও আপিল বিভাগ ২০১০ সালে বাতিল করেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও সংশোধনীতে আনা কিছু জনকল্যাণমূলক বিষয় আদালত রেখে দেন, যার মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও ছিল।

ওই রায়ের পর আনা সংবিধানের ২০১১ সালে আনা পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অক্ষুণ্ন ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের একই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর নতুন করে ষোড়শ সংশোধনী আনে। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের আদি বিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে প্রদান করা হয়।

নতুনভাবে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বাতিল করা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তিত ৯৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।

আর ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে অসদাচরণ ও অসামর্থতা প্রমাণের বিষয়টি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। যেখানে বলা হয়, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

এই রায়ের মাধমে এখন সংশোধিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া সংক্রান্ত বিধান অবৈধ হয়ে গেল। আর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ায় আপনা আপনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়ে গেছে।

সোমবার রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও এই মামলার অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আগের অবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা বলবত রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এটা সংসদ কর্তৃক প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন নেই। এখানে সংসদের বিষয় নেই। অটোমেটিক্যালি সেটি (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) পুনঃস্থাপিত হয়ে যাবে।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য রিটের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদের। সোমবার রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের হাতে নেওয়া হয়েছিল, এ রায়ের মাধ্যমে তা খারিজ ও অকার্যকর হয়ে গেল। এখন থেকে বিচারকদের অপসারণের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।

তবে এই রায়ের মাধ্যমে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল নিয়ে ভিন্নমত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে নিজ কার্যালয়ে রায়পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার মতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়নি। আমি মনে করি, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ সংসদ বাতিল করেছে সেটা আপনা আপনি রেস্টর (পুনঃস্থাপন) হবে না। এই অবস্থায় উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের পদ্ধতি নিয়ে একটা শূন্যতা বিরাজ করছে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত বিধান নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হল কি না, সে বিষয়ে সরাসরি কোনো মত দেননি আইন মন্ত্রী আনিসুল হক। সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সভা শেষে সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘২০১৪ সালে সংশোধনী আনার আগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল। তখন একভাবে চলছিল, তবে এটা ঠিক যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে ৯৬ অনুচ্ছেদ সেটা কিন্তু সংসদ বাতিল করে দিয়েছে। সুতরাং এইখানে এখন যেটা হবে সেটা ভিন্নতর কিছু একটা।’

তবে এই রায় পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার কথা বলেন আইন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘অপেক্ষা করব পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য। আশা করব পূর্ণাঙ্গ রায়টা তাড়াতাড়ি দেওয়া হবে এবং পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আমার সিদ্ধান্ত নেব কি করব।’

এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে স্বাগত জানিয়ে এটিকে ‘জনগণের বিজয়’ আখ্যা দিয়েছে বিএনপি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পূর্ণাঙ্গ রায় দেখার আগে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। সোমবার শহীদ মিনারে প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ করুণাময় গোস্বামীর মরদেহে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পরই আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।’

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আইনজীবীদের একাংশ সুপ্রিম কোর্টে মিষ্টি বিতরণ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের কক্ষে এই মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এ সময় বারের সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অনেক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। তবে উপস্থিত আইনজীবীদের বেশিরভাগই ছিলেন বিএনপিপন্থি। আওয়ামীপন্থি বেশিরভাগ আইনজীবীই রায় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/কেএ/এনআই/জুলাই ০৩, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর