বরিশালে স্থানীয় নদীতে দেখা মিলছে না ইলিশের

বিধান সরকার, বরিশাল : রাখি পূর্ণিমা শুরু হয়েছে সোমবার (৭ আগস্ট) থেকে। সে অনুযায়ী ইলিশের এখন ভরা মৌসুম। গভীর সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও তা আকারে ছোট। অপরদিকে বরিশাল অঞ্চলের স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না। বরিশালের ৬০ ভাগ জেলে ভিতর গাঙ্গে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু স্থানীয় নদীতে ইলিশ না পাওয়ায় চরম হতাশা আর দুর্দশায় দিন পার করছে স্থানীয় জেলেরা। তবে শুধু জেলেরাই নয়, যেসব আড়ৎদার স্থানীয় নদীর ইলিশের ওপর নির্ভর করেন তাদের ব্যবসায়ও মন্দাভাব চলছে।

মেহেন্দিগঞ্জের জেলে মো. বাসেত মাঝি জানান, তিনি মেঘনায় ইলিশের সাদা জাল পাতেন। গত বছর এই সময়ে মেঘনায় বেশ ইলিশ ধরা পড়লেও এবার হাতে গোনা দু’চারটা মাত্র। সে জানায়, এতে করে সংসার চালানো এখন দায়।

চন্দ্রমোহনের সোবাহান ঢালী আক্ষেপ করে বলেন, কেবল মেঘনা নয়, কালাবদর, ইলিশা, তেঁতুলিয়া, পায়রা, বিষখালী এসব ভিতর গাঙ্গে এখন পর্যন্ত ইলিশের দেহা নাই। বারো মাসে তেরো অভিযান থাহে ইলিশ রক্ষার নামে। যেমন ধরেন ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত চলে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান। আবার পহেলা নভেম্বর থেকে ৩০ জুন এই ৮ মাস থাহে জাটকা রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া মাছের ডিম পাড়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ১৫ দিন করে চলা এই অভিযানের স্থায়ীত্ব অয় ২ মাস। তাইলে ইলিশ ধরার জন্য সময় থাকে কতডুক? এই প্রশ্ন তোলেন তিনি। মধ্য শ্রাবণ থেকে শুরু হয়ে মধ্য আশ্বিন পর্যন্ত থাকবে ইলিশ পড়ার মৌসুম। তবে এবার শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে এসে ঠেকেছে, কিন্তু নদীতে ইলিশের দেখা নেই। এমন কথা বলে নিজেই উত্তর দেন তিনি, বাও বাতাস নাই, দক্ষিণা বাতাস না আইলে নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে ক্যামনে। এ বছর এহন পর্যন্ত বানের পানি আহে নাই।

এ নিয়ে জেলা মৎস্য আড়ৎদার এসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত কুমার দাস জানালেন, এখন ইলিশের দেখা মিলছে গভীর সমুদ্রে। মংলা পোর্টের বাইরে যেখান থেকে জাহাজ চলাচল করে সেই খাড়িতে এবং সোনার চর থেকে ৬/৭ ঘণ্টা বোট চালানো দূরত্বে ইলিশ ধরা পড়ছে। কূলে মাছ নেই বলে সাদা জালে মাছ পাচ্ছে না জেলেরা। এখন লম্বা জাল ও লাল জালে ধরা পড়া ইলিশ আসছে বরিশালের মোকামে।

তিনি আরও বলেন, সাগর বৈরী আবহাওয়ার কারণে উত্তাল থাকায় মিষ্টি পানিতে মাছ এখনো আসতে পারছে না। এজন্য হিজলা, কালিগঞ্জ, মেঘনা, ঢালচর, সোনারচর, রূপারচর ছাড়াও স্থানীয় নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া এবার এখন পর্যন্ত বড় সাইজের ইলিশের খুব একটা দেখা মেলেনি। ফিসিংবোটে যে ইলিশ আসছে তা ৪ থেকে ৫শ’ গ্রামেরই বেশি। এখন সাগরে মাছ পড়ায় ৪ থেকে ৫শ’ গ্রামের মাছ ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজি আর ৬শ’ থেকে ৭শ’ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা কেজি দরে। এই দর মাছের আমদানির ওপর নির্ভর করে। দিন কয়েক মহিপুরে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে চাহিদার বরফ সরবরাহ করতে না পারায় বরিশালের পোর্ট রোডের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে দেড় হাজার মণ ইলিশ এসেছে। তবে স্থানীয় নদীর ইলিশের স্বাদ আলাদা বলে এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাদের ১৬৫ জন আড়ৎদারের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ আড়ৎদার স্থানীয় নদীর ইলিশ কেনাবেচা করে থাকেন। স্থানীয় নদীর জেলেদের ন্যায় এই আড়ৎদাররাও কষ্টে আছেন এ যাবৎ ব্যবসা শুরু করতে না পেরে।

স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা নেই আর আকার ছোট হওয়ার বিষয়ে ওয়ার্ল্ডফিশ ইলিশ প্রকল্পের টিম লিডার ড.ওহাব বলেন, ১৯৯০ সালের পর ২৫ বছর পর ২০১৬ সালে প্রচুর ইলিশ মিলেছে। ৫ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। আর সরকার অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০ ভাগ অবৈধ জাল বন্ধ করতে পেরেছেন। তাই তিনি মনে করেন এ বছর ইলিশ না পাওয়ার কোন কারণ নেই। তিনি কর্মরত ৯টি জেলায় বৈজ্ঞানিকদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছেন এবারের ইলিশের স্বাস্থ্যগত অবস্থা বেশ ভালো। তাই বড়ো সাইজের ইলিশ না পাওয়ার কোন কারণ দেখছেন না এই গবেষক। তবে জেলেদের দাবি- নদীর মোহনায় চর পড়ায় ইলিশ প্রবেশ করতে পারছে না, এই যুক্তি মানতে নারাজ তিনি। তার মতে, সপ্তাহের মধ্যেই স্থানীয় নদীতে ইলিশ পড়বে।

মূলত ডিম পাড়ার জন্য ইলিশ সাগর থেকে মিঠা পানিতে চলে আসে। এখনো মাছের পেটে ডিমের দেখা মিলছে না বলে স্থানীয় নদীতে মাছ নেই এমনটা জানালেন মৎস্য কর্মকতা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস। এই কর্মকর্তার যুক্তি হলো, এখন সাগর মোহনা জুড়ে ইলিশের জালে ঘেরা। এজন্য ইলিশ স্থানীয় নদীতে প্রবেশ করতে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ঝড় জলোচ্ছ্বাস হলে এই জেলেরা মোহনা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিলে ওই সুযোগে মাছ স্থানীয় নদীতে প্রবেশ করতে পারবে। তাছাড়া সবে ৭ আগস্ট (সোমবার) হলো রাখি পূর্ণিমা শুরু হয়েছে। এখন জল বাড়বে এবং দু’চার দিনের মধ্যেই স্থানীয় নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে।

(দ্য রিপোর্ট/এমএইচএ/এনঅাই/আগস্ট ০৮, ২০১৭)