thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

০৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস

আত্মপরিচয় হারাতে বসেছে আদিবাসী চা শ্রমিকরা

২০১৭ আগস্ট ০৯ ২০:৫৪:৪৫
আত্মপরিচয় হারাতে বসেছে আদিবাসী চা শ্রমিকরা

আহমেদ সেলিম, মৌলভীবাজার : নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবন চর্চা থেকে সরে যাচ্ছে চা বাগানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। দারিদ্র্য, অসচেতনতা এবং বিচ্ছিন্নভাবে চা বাগানগুলোতে বসবাসের কারণে নিজেদের ভাষা ও কৃষ্টি জানেনা এ প্রজন্মের অনেকেই। চা বাগানে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থানের কারণে ‘চা শ্রমিক’ হিসেবে তাদের পরিচয় তৈরি হয়েছে। যার কারণে তাদের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় পড়ে যাচ্ছে আড়ালে।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, রাজনগরসহ ৭টি উপজেলায় ৯২টি চা বাগান রয়েছে। আর এসব চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁড়াও, মাহালি, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, বর্মা, কানু, পানিকা, কুর্মী, চাষা, অলমিক, মোদি, তেলি, পাত্র, মাঝি, রাজবংশী, মোদক, বাড়াইক, ভূমিজসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করেন। বর্তমানে এদের অধিকাংশ অতি দরিদ্র হওয়ায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবন চর্চা সম্ভব হচ্ছেনা। নিজেদের ভাষা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি চর্চা কমে আসায় এখন তারা নিজেদের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় নিয়েই পড়েছেন সংকটে। আর্থ সামাজিক অবস্থার কারনেও অনেক সময় তারা নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় ধরে রাখতে পারছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া চা শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভুজপুরী ভাষায় কথা বলেন। যার ফলে নিজেদের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রও কমে গেছে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মিরতিংগা চা বাগানের বয়ো মুন্ডা বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা এখন মুন্ডা ভাষা শিখতে চায় না। পরিবারে থাকলে দু’একটা কথা বলে, কিন্তু বাইরে গেলে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে।’

মিরতিংগা চা বাগানের আদিবাসী মুন্ডা জনগোষ্ঠীর মেয়ে সাবির সাথে কথা হয়। সাবি জানায়, সে স্থানীয় কমলগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তার মা মারা গেছেন অনেক আগেই। চা শ্রমিক বাবার অল্প আয়ে চলে না তাদের পাঁচ জনের সংসার। তাই মাটি কাটা, কখনো ইট ভাঙার কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগায় সে। এমনকি সংসার চালাতেও সহযোগিতা করে সে।

অবশ্য সাবি জানে না নিজের আত্মপরিচয়, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। শুধু সাবিই নয়, এই অবস্থা তার বান্ধবী দিপালী মুন্ডারও। দিপালী জানায়, তাদের আলাদা সংস্কৃতি কী? তা সে জানে না। সবার সাথে যে ভাষায় (বাংলা ও ভুজপুরী ভাষায় মিশ্রণ) কথা বলে, পরিবারেও সে ভাষায়ই কথা বলে। নিজেদের কোন ভাষা আছে বলে তার জানা নেয়।

কমলগঞ্জ উপজেলার দেওরা ছড়া চা বাগানের অর্জুন ওঁড়াও জানান, তাদের নামের পরে তারা পদবী লিখেন উড়াং। আসলে তারা আদিবাসী ওঁড়াও, এটা তিনি জেনেছেন কয়েকদিন আগে তাদের সমাজের এক সভায়।

একই বাগানের সত্যজিৎ ওঁড়াও জানান, ওঁড়াও না উড়াং তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। টিকে থাকতে তাদের সংগ্রাম করে জীবন পার হচ্ছে, এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার সময় নেই তাদের।

সাঁওতাল মেয়ে মমতা জানায়, দেওরাছড়া চা বাগানে তারা মাত্র কয়েকটি পরিবার বাস করে। এখানে তারা সংখ্যায় অল্প বলে নিজেদের অনুষ্ঠানাদি তেমন হয়না। যার ফলে তারা তেমন কিছু শিখতে পারছেনা।

মমতা আরও জানায়, সাঁওতালি কিছু নাচ সে জানে, তবে তাদের ভাষা সে জানে না।

চা শ্রমিক আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন লোক গবেষক আহমদ সিরাজ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গেছে এখন অনেকে তাদের আত্মপরিচয় যেমন ভুলেছে তেমনি অনেকে আত্মপরিচয় গোপন করছে বাধ্য হয়েই। কারন আদিবাসী চা জনগোষ্ঠীর মানুষ সমাজের মূলস্রোত হতে বিচ্ছিন্ন। তারা সংখ্যালঘু ও বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এবং সমাজে তাদের খাটো করে দেখার জন্যে, তারা ভাবে এই সমাজে তারা গ্রহনীয় নয়। তাই অনেকেই নিজেদের পরিচয় গোপন করছেন। যেমন- দলিত নৃগোষ্ঠী শব্দকর সমাজের অনেকেই এখন ‘শব্দ’ বাদ দিয়ে শুধু ‘কর’ লিখেন। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। প্রায় সকল সূচকে পিছিয়ে পড়া এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সংগঠিতভাবে তাদের জীবন চর্চা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করার মাধ্যমে এরা রক্ষা পাবে। আর এই দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।’

এই ব্যাপারে জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা জ্যোতি সিনহা বলেন, ‘তাদের ভাষা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে পারলে তাদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য সরকারের কিছু উদ্যোগ রয়েছে। আমার জেলার সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে একত্রিত করে আগামীতে অনুষ্ঠান আয়োজন করবো, যাতে তারা নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে। আর তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সরকার ব্যাবস্থা নিচ্ছে। আমরা তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছি।’

(দ্য রিপোর্ট/এজে/এনআই/আগস্ট ০৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর