thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

ঢেউয়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড কুয়াকাটার উপকূল

২০১৭ আগস্ট ১২ ১৬:৩৩:১৭
ঢেউয়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড কুয়াকাটার উপকূল

কুয়াকাটা প্রতিনিধি : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কুয়াকাটার উপকূল। বঙ্গোপসাগরে বিশাল বিশাল ঢেউ উপচে পড়ছে কুয়াকাটার উপকূলে। ভাঙ্গছে উপকূল রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধও। এতে ধ্বংস হচ্ছে সাগরপারের নিরাপত্তা বেষ্টনী।

এছাড়া নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার ফসলী জমি। সমুদ্রের সীমানা বৃদ্ধির কারণে কমছে স্থলভাগ। বদলে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের গোটা উপকূলের মানচিত্র। এভাবে চলতে থাকলে উকূলের রক্ষাকবচ সবজু বেষ্টনী সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিলিন হওয়ার আশঙ্কা করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন স্পষ্ট। উপকূলীয় এলাকায় লবনাক্ততা মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। স্রোত পরিবর্তন হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ঘন ঘন সামুদ্রিক দুর্যোগ। চরম হুমকির সন্মুখিন হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জনপদ। উপকূলের ভাঙ্গন রোধে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছে না। সমুদ্রের পানি ফুলে ফেঁপে ক্রমশই চলে আসছে লোকালয়ে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের কারণে ঢেউয়ের তাণ্ডব বেড়ে যাচ্ছে। এসব ঢেউ কেড়ে নিচ্ছে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার একর ফসলি জমি। ক্রমেই শ্রীহীন হয়ে পড়ছে অপরূপ সৌন্দার্যের বেলাভূমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত।

অব্যাহত ভাঙ্গনের কারণে কুয়াকাটা সৈকতের প্রশস্ত সংঙ্কোচিত হয়ে পড়ছে। ফলে জোঁয়ারের সময় পর্যটকরা সৈকতের বেলাভূমিতে নামতে পারছে না। ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষার জন্য সরকার উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এতে করে কুয়াকাটা সৈকতটি এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।

দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনার হাতছানি। অপার এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার গ্রহণ করেছে নানা পরিকল্পনা। এরই মধ্যে ২০১৬ সালকে সরকারের তরফ থেকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।

দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি অর্জন করেছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। বালুক্ষয় রোধ করা না গেলে সম্ভাবনার আশা জাগানো একটি সমুদ্র সৈকত তথা পর্যটন শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে এমনটাই দাবি করেছেন বিশিষ্টজনরা।

এ বিষয়ে উপকূলীয় মানব উন্নয়ন সংস্থা (সিকোডা)’র নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও প্রচন্ড ঢেউয়ের তান্ডবে উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন অব্যহত রয়েছে। এভাবে ভাঙ্গন অব্যহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন এবং হাজার হাজার একর ফসলি জমি সমুদ্র গর্ভে বিলিন হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই উপকূল রক্ষার জন্য সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙ্গন রোধের উদ্যোগ নিতে হবে।

পানির স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে মৌসুমী ঝড়ের হারও বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ২০টি নিন্মচাপ হয়েছে। এ সকল নিন্মচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ১২ টি। অথচ এর পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ৩৯টি নিন্মচাপ হয়েছে। আর এ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে ২০০৯ সাল ছিল সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ বছর। ওই বছর বঙ্গোপসাগরে নয়টি নিন্ম চাপ সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে থেকে দু’টি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা সৃষ্টি হয়েছে। এ দু’টি ঘূর্ণিঝড় উপকূলের জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। যে ক্ষতি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের উপাত্ত অনুযায়ি দুই-তিন দশক আগে যেখানে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে চার থেকে পাঁচটি“তিন নম্বর সতর্ক সংকেত” জারি করার মতো নিন্মচাপ তৈরি হতো, সাম্প্রতিক বছর গুলোতে তা বেড়ে নূন্যতম ১২টিতে এসে ঠেকেছে। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ২৫টি। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একের পর এক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে বিপর্যস্ত প্রান্তিক জনপদের জীবযাত্রা।

১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সৈকতের একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার মনোরম দৃশ্য পৃথিবীতে বিরল। এ কারণে শীত, গ্রীস্ম ও বর্ষা সব ঋতুতেই দেশী-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটকদের পদভারে মুখরিত থাকে কুয়াকাটা। কিন্তু সুপার সাইক্লোন সিডর ও আইলাসহ দফায় দফায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সাগরের রুদ্র রোষের কারণে অব্যাহত ভাঙ্গনের কবলে হারিয়ে গেছে কুয়াকাটার মূল প্রাকৃতিক সৌন্দার্য। এরই মধ্যে সাগর বক্ষে হারিয়ে গেছে সৈকতের সৌন্দর্য হিসেবে খ্যাত ফয়েজ মিয়ার ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ এর সারি সারি নারিকেল, ঝাউ, তাল, সেগুন, কুল, লেবু, আম, পেয়ারা বাগান এবং সৈকত সংলগ্ন সওজ, পাউবো ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলোসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, এভাবে সৈকত সংলগ্ন গাছপালা সমুদ্র গর্ভে বিলিন হতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পরবে। বালুক্ষয় রোধ করার জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করছি। তাহলে ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি সমুদ্র সৈকত তথা পর্যটন শিল্প রক্ষা পাবে।’

এছাড়াও সৈকতের কোলঘেষা ‘কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান’ এখন পুরোপুরি হুমকির মুখে। এরই মধ্যে উদ্যানটির বিরাট অংশ সাগর বুকে বিলীন হয়ে গেছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন বহু হোটেল-মোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অব্যাহত ভাঙনের কারণে প্রতিবছরই সৈকত সংলগ্ন বিপণি-বিতানগুলো পিছনে সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে মালিক পক্ষ। এমনকি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরি বেড়িবাঁধও এখন হুমকির মুখে।

এ ব্যাপারে ফয়েজ মিয়ার বাগানের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমি বহু বছর যাবত সমুদ্রপাড়ে বাস করি। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বসত ঘর উপরের দিকে আনতে আনতে এখন ক্লান্ত হয়ে গেছি। ঝড়-বন্যা আমাদের নিত্যদিনে সঙ্গী। সাগরপাড়ে গাছপালা থাকায় বন্যার সময় বাতাসের চাপ কম লাগে। বর্তমানে যেভাবে বালুক্ষয় শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে আর থাকা যাবে না।’

কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের জন্য সেজে থাকা সৈকতের কয়েকটি স্পট লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। অপরদিকে সৈকত তটে থাকা ঝাউবন, নারিকেল কুঞ্জ, তালবাগান, শালবনসহ শুটঁকি পল্লী তছনছ হয়ে গেছে। সৈকত ঘেঁষা বনাঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির শতশত গাছ উপড়ে যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এভাবে ভূমিক্ষয় অব্যহত থাকলে কুয়াকাটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ভিতরে পানি প্রবেশ করে পর্যটন শিল্প বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে অপরদিকে পর্যটক শূন্য হয়ে যাবে কুয়াকাটা এমনটাই আশঙ্কা করেছে স্থানীয়রা।

কুয়াকাটার খাজুরা এলাকার ৮০ বছরের বৃদ্ধ করিম হাওলাদারের কাছে সাগরের ভাঙ্গন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সাগরের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘কী কমু দুঃখের কতা, এই রাক্ষস সাগর মোর জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর সব কিছু ভাসাইয়া লইয়া গ্যাছে। মুই এহন মাইয়া-পোলা লইয়া খাইয়া না খাইয়া মানষের জাগায় ওকরাইত (পরবাসী) থাহি। প্রায় এক মাইল দক্ষিণে মোর দোতালা টিনের ঘর আছেলে আর এহন সাগরের মাঝে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম প্রান্তের খাজুরা থেকে গঙ্গামতি পর্যন্ত ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। আবার গঙ্গামতির পূর্বপাশ দিয়ে সাগর হতে রামনা বাঁধ চ্যানেলটি উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই চ্যানেলের উভয় কূল ভাঙ্গছে বেপরোয়াভাবে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের ৪৭/৪ নং পোল্ডারের বুড়ো জালিয়া থেকে গাজীর খাল পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার বাঁধের। প্রতি বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও ঠেকাতে পারছে না ভাঙ্গন। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির কারণে শুধু কলাপাড়ায় ভাঙ্গছে না এ দৃশ্য সমগ্র উপকূলীয় এলাকার। উপকূলীয় রামনা বাঁধ চ্যানেল, আগুন মুখা, বুড়া গৌরাঙ্গ, মেঘনা, তেতুলিয়া, পায়রা, বলেশ্বর, পশুর চ্যানেল, বিষখালী নদীসহ সাগর সংলগ্ন এলাকার ভাঙ্গনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। ফলে কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া, ধানখালী, চম্পাপুর, লতাচাপলী, মহিপুর, নীলগঞ্জ ইউনিয়নসহ সমদ্র উপকূলের প্রায় লক্ষাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারাতে বসেছে। মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার এক আবাদী জমি। উপকূলের কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে দেখা দিয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। বহু মানুষ বাড়ি ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে অন্যত্র।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমএ মোতালেব শরীফ জানান, কুয়াকাটায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। সৈকত বিলিন হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীদের অবস্থা কি হবে? তাই সরকারকে দ্রুত এর পদপেক্ষ নেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি।

এ ব্যাপারে কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা প্রকল্পের পেপার ওয়ার্ক দ্রুত এগিয়ে চলছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সবকিছু অবহিত করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে কুয়াকাটার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্পটগুলোতে বেড়িবাঁধ রক্ষায় জরুরি মেরামতের কাজ চলছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএনইউ/আগস্ট ১২, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর