thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ

পদ্মা পাড়ে বিশাল কর্মষজ্ঞ

২০১৭ আগস্ট ১৮ ১১:২৮:০৬
পদ্মা পাড়ে বিশাল কর্মষজ্ঞ

জোসনা জামান, রূপপুর থেকে ফিরে : শতবর্ষের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর সর্বাধুনিক রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেন তৈরি করেছে মেলবন্ধন। দুর থেকে দেখলে তেমনটিই মনে হয়। ব্যাপক কর্মষজ্ঞ চলছে পদ্মা নদীর পাড় জুড়েই।

শিগগিরই শুরু হচ্ছে রূপপুর পরামানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল স্থাপনা ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং’ এর কাজ। সেখানেই মূল বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আগামী অক্টোবর মাসে এ অংশের কাজের উদ্বোধন করার লক্ষ্যে চলছে সব প্রস্তুতি।

মূল স্থাপনার ফাউন্ডেশন ফাস্ট কংক্রিট পোরিং ডেট (এফসিডি) নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে সংশ্লি¬ষ্টদের মাঝে। কোথাও তৈরি হচ্ছে, প্রটকশন বাঁধ, কোথাও বিশাল এলাকা জুড়ে মাটি ভরাট, কোথাও আবাসিক জোন, এরকম কর্মষজ্ঞ চোখে পড়ে পুরো রূপপুর জুড়েই। সম্প্রতি পাবনা জেলার ঈশ্বদী উপজেলায় রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ড.শওকত আকবর দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সম্পুর্নই নিরাপদ বলা যায়। কেননা এতে ৫ স্তরের নিরাপত্তা বেস্টনী রয়েছে আর স্ইে সঙ্গে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। তাই দুঘর্টনার আশংকা নেই বললেই চলে। তারপরও যদি কোন সময় কোন রকম দুঘর্টনা ঘটেও তার জনসাধারণের মাঝে কোন প্রভাব পড়বে না।

রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমানে মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিস্টমেন্টর কাজ পুরোদমেই চলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিং করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ৪ হাজার কিউবিক মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসেই মধ্যেই পুরোটা করা যাবে। সে লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্ত হবে ৭০ মিটার করে আর ফাউন্ডেশনের পুরুত্ব হবে ৩ মিটার। এছাড়া আনুষাঙ্গিক অনেক কাজই এগিয়েছে ইতিমধ্যেই। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের মাধ্যমেই পাওনিয়ার বেইজ ও ইরেকশন বেইজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এছাড়া চলছে প্রটেকশন ড্যাম (বাঁধ) তৈরির কাজ। ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার লম্বা এবং ১৩ মিটার প্রস্ত এ বাঁধের কাজও এগিয়েছে অনেক দুর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছিল। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতিমধ্যেই ৮০০ একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহগণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। যতদুর চোখ যায় শুধু রোলার, এক্সকেভেটর, পে-লোডার মেশিন ও ড্রাম ট্রাক চলাচলের দৃশ্য। দেখে মনে হবে যেন যন্ত্র আর মানুষ মিলেই যেন তৈরি হচ্ছে পারমানবিক সেতু বন্ধন।

অন্যদিকে মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে তৈরি হচ্ছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। পাবনা গণপূর্ত অধিতদফতর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যেই তিনি সুউচ্চ বিল্ডিং এর কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০তলা মোট ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬তলা ৮ বিল্ডিং এর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। মোট ২২টি সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি হবে এই চত্তরে। এছাড়া থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

প্রকল্পের চীফ ইঞ্জিনিয়ার ইউরিক মিখাউল খোসলেভ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রিয়াক্টর বিল্ডিং তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে সাব বেইজ তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মূল প্রকল্পের ভিত্তি। অবকাঠামো ছাড়াও অনেক কাজ চলছে। যেমন রড. ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি সব কাজই হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবেই। অক্টোবর মাসে মূল স্থাপনার কাজ শুরু হলে তার পরের ৬৮ মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও জানান, প্রতিদিন রাশিয়ার বিশেজ্ঞ ও বাংলাদেশি কর্মী মিলে প্রায় ১ হাজারের বেশি কর্মী দিন রাত কাজ করছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে। এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্রেস রিয়াক্টর বসবে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি। যা কেবল রাশিয়ায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রয়েছে। আর বাংলাদেশের রূপপরই হবে দ্বিতীয় ব্যবহার।

প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য প্রকল্পের শুরু থেকে গত মে মাস পর্যন্ত মোট ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৮১২ কোটি ৯ লাখ টাকা। এ পর্যায়ের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল প্রকল্পে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এ পর্যায়ের ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ব্যয়ের প্রকল্প হচ্ছে এই রূপপুর পরমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভিভিইআর-১২০০(এইএস-২০০৬) রিঅ্যাক্টরের দুইটি বিদ্যুৎ ইউনিট (ইউনিট-১ ও ২) এর সমন্বয়ে ২৪’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার পরমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। সেই সঙ্গে এটি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো তৈরি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং কার্বনমুক্ত ও বেইসলোড বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা সম্ভব হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে ১৯৬০ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য ১৯৬০, ১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে কারিগরি ও অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এটি নির্মাণ সম্ভব হয়নি।

সরকারের বিদ্যুৎ খাতের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের ১০ শতাংশ পারমানবিক বিদ্যুৎ থেকে পাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এ অবস্থায় আর্ন্তজাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে এবং গাইডলাইন অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য ২০১০ সালের ২১ মে বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক ও একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পাবনার রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি এবং ২০১২ সালের ৪ জুন বাংলাদেশে পারমানবিক খাতে দক্ষজনবল তৈরিতে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি ঋণ চুক্তি এবং প্রকল্পের মুল কাজ বাস্তবায়নের জন্য একটি সঝোতা চুক্তি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ (প্রথম পর্যায়) শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এটি ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল একনেকে অনুমোদন লাভ করে। বর্তমানে এ পর্বের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

ইতিমধ্যেই মুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। মূল কাজ সম্পাদনের জন্য রাশিয়ান ফেডারেশনের এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখান প্রকল্পের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ. এস. এম. মিজানুর রহমান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নুর-ই আলম।

এ সময় ড. মিজান বলেন, নিরাপদ, শাস্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পারমানবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। এর মধ্যদিকে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সারাজীবনের প্রচেষ্টা এবং সরকারের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়িত হবে।

প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১ ও ২ নং ইউনিট এর বিস্তারিত ডিজাইন তৈরি, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জামাদি সংগ্রহ, এলটিএমই সংগ্রহ, এ দুটি ইউনিট নির্মাণ, পারমাণবিক জ্বালানী সংগ্রহ, কমিশনিং ও টেস্টিং ইত্যাদি করা হবে। এছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ৩৬৯ জন এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অন্যান্য কাজ পরিচালনার জন্য ২ হাজার ৫৩৫ জন জনবল নিয়োগ, প্রকৌশল সরঞ্জামাদি স্থাপন,বিভিন্ন ধরণের কম্পিউটার, এক্সেসরিজ ও সফটওয়্যার সংগ্রহ, ভুমি অধিগ্রহণ, পূর্ত নির্মাণ কাজ বিভিন্ন ধরণের সরবরাহ সেবা সংগ্রহসহ আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

(দ্য রিপোর্ট/জেজে/এআরই/আগস্ট ১৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর