সাতচল্লিশে সিলেট যেভাবে পাকিস্তানের অংশ হলো

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ১৯৪৭ সাল। ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে ভারতবর্ষ ভাগ হলো; পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। এ দু’টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও প্রশ্ন ওঠে আসামের অংশ সিলেটের ভাগ্যে কী হবে।

মুসলমান আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করার দায়িত্ব পড়েছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ওপর।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন এক ঘোষণায় তিনি সিলেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব দেন স্থানীয় জনসাধারণের কাঁধে। সিদ্ধান্ত হলো গণভোট অনুষ্ঠানের।

সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে মোট ভোটার ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন। ভোট দিয়েছিল ৭৭ শতাংশ মানুষ। ২৩৯টি ভোটকেন্দ্রে বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছিল বলেই জানা যায়। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী সিলেটে গণভোট সংক্রান্ত কার্যক্রমের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

দেশভাগের সময় ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন জকিগঞ্জের মোহাম্মদ নূরউদ্দীন। তার মনে রয়েছে সেই ভোটের কথা। মোহাম্মদ নূরউদ্দীন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন করিমগঞ্জের প্রাথমিক স্কুলে।

ভোটে করিমগঞ্জের মানুষও আসাম ছাড়ার রায় দিলেও করিমগঞ্জের কিছু অংশ র‌্যাডক্লিফ লাইনে ভারতের আসামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মোহাম্মদ নূরউদ্দীনের ভাষায়, ‘আমরা বাইরাইয়া মিছিল দিছি করিমগঞ্জে। মসজিদ যেখানে ছিল সেখানে স্লোগান নাই। এইভাবে করছি। ভোটে আমরা করিমগঞ্জকেও পাইছি। এই যে সাড়ে তিন থানা গেল সবটা পাইছি। কিন্তু আমাদের নেতাদের অভাবেই কংগ্রেস বড়লাটের লগে মিল করিয়া নিয়া গেছে।’

কুশিয়ারা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন নূরউদ্দীন। তিনি জানান, তার নানা বাড়ি, ভগ্নীপতিসহ অনেক আত্মীয়ের বাড়ি পড়ে যায় করিমগঞ্জে আর তারা থাকেন পূর্ব বাংলায় বর্তমান জকিগঞ্জ এলাকায়।

তিনি বলেছেন, ‘আত্মীয়স্বজন সবাই থাইকা গেছে। ইন্ডিয়ায় থাকছে। এখনো আছে। আমরার যাওয়া আসা নাই। তারাও আসে না।’

সিলেটের গণভোট দেখেছেন মাহতাবউদ্দীন আহমেদও। মনে করে বলেছেন সেই কিশোর বয়সে বড়দের সঙ্গে পাকিস্তানের পক্ষে কী স্লোগান দিতেন তারা-‘মুসলীম লীগের মার্কা কী- কুড়াল ছাড়া কী, পাকিস্তান জিন্দাবাদ-লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, কায়দে আজম জিন্দাবাদ এইগুলা স্লোগান ছিল।’

মাহতাবউদ্দীন জানিয়েছেন, ভোটের প্রচারে সিলেটে মুসলিম লীগের বড় নেতারা এসেছেন। তার মনে আছে সিলেটের শাহী ইদগায়ে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহও এসেছিলেন।

মাহতাবউদ্দীন দাবি করেছেন, গণভোটের প্রচারে এসে করিমগঞ্জে তাদের বাড়িতে একবেলা খেয়েছিলেন তৎকালীন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১২জন কর্মী।

তার ভাষায়, ‘কংগ্রেসের মার্কা ছিল ঘর আর মুসলীম লীগের ছিল কুড়াল। হিন্দুদের মধ্যে নমোশূদ্ররা ছিল মুসলীম লীগের পক্ষে। আলেমদের একদল ছিল কংগ্রেসি। হুসেইন আহমেদ মাদানী উনি আর ওনার একটা গ্রুপ ছিল কংগ্রেসি।’

দেশভাগের ইতিহাসে সিলেটের গণভোট এক বিরল ঘটনা। এই ভোটে জয়ী হতে মুসলীম লীগ ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালায়। সিলেটের জনগণকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুসলীম লীগ।

পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া ফরজ ঘোষণা করে ফতোয়াও জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, গণভোটের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচশো কর্মী নিয়ে কলকাতা থেকে সিলেট এসেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরোধে হিন্দু রায়বাহাদুর আরপি সাহা একাধিক লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়েছিলেন মুসলীম লীগের পক্ষে। সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করে তারা আবার কলকাতা ফিরে যান।

শিক্ষাবিদ ও সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলীম সাহিত্য সংসদের সভাপতি অধ্যাপক মো. আব্দুল আজিজ তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

তিনি বলেছেন, ‘মুসলমানদের জন্য গণভোট পরিচালনার জন্য একটা রেফারেন্ডাম বোর্ড হয়। সেই বোর্ডের সভাপতি হলেন আব্দুল মতিন চৌধুরী নামে একজন প্রবীণ নেতা। যিনি এককালে জিন্নাহ সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। আর সেক্রেটারি হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুল হাফিজ যিনি বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের বাবা।’

তার মতে, সিলেটে ৬০ ভাগ মুসলিম থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের একটি অংশ কংগ্রেসপন্থী হওয়ায় ভোটের প্রচার প্রচারণার প্রয়োজন হয়।

তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের পক্ষে পড়লো ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ ভোট আর ভারতে যোগদানের পক্ষে পড়লো ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ ভোট। মুসলীম লীগ ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি। এজন্য সিলেটিরা গর্ব অনুভব করতো যে আমরা বাই চয়েস পাকিস্তানে আসছি।’

১৯৪৭-এ সিলেটের ঐতিহাসিক গণভোটেই ঠিক হয় পূর্ব পাকিস্তানের একাংশের মানচিত্র।

কিন্তু গণভোটের রায় না মেনে মানচিত্রে দাগ কেটে করিমগঞ্জের কিছু অংশ ভারতকে দিয়ে দেওয়ায় সিলেটের মানুষের কাছেও চির বিতর্কিত হয়ে যায় র‌্যাডক্লিফ লাইন।

প্রতিবেদন ও ছবি : বিবিসি বাংলার সৌজন্যে

(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/আগস্ট ১৮, ২০১৭)