thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ 24, ৫ চৈত্র ১৪৩০,  ৯ রমজান 1445

গল্প

একটি আত্মহত্যার হ্যান্ডনোট

২০১৭ অক্টোবর ১৩ ০২:৩৬:৩১
একটি আত্মহত্যার হ্যান্ডনোট

“আমরা আদৌ জন্মাতে চাই কী না সেটা জিজ্ঞেস না করেই আমাদের জন্ম দেয়া হয়েছে, যে শরীরে আমাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে সেটা আমরা নিজেরা বেছে নিইনি, এবং আমাদের জন্য অবধারিত করে রাখা হয়েছে মৃত্যু।”-মিলান কুন্ডেরা

তারচেয়ে উপর থেকে টুপ করে নিচে লাফিয়ে পড়ি এই ভালো। এই যে ভাই শুনছেন, আমি আত্মহত্যা করবো! সত্যি বলছি! আমি আত্মহত্যা করবো। ও ভাই, যাবেন না..। দাঁড়ান একটু। কীভাবে আমি আত্মহত্যা করতে পারি তার একটা সহজ উপায় যদি বলতেন। এই যেমন ধরুন- ট্রাকের নিচে মাথা দিয়ে, অথবা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে কিংবা ট্রেনে কেটে নতুবা গলায় দড়ি দিয়ে-এরকম কিছু একটা আর কী..? ও ভাই চলে যাচ্ছেন ? যাবেন না। একটু দয়া করুন। শুধু একটু, শুধু.. ঠিক আছে আপনারা যান। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়বো না আমি। আত্মহত্যা আমি করবোই। আমার অবস্থান এখন মিরপুর-১ অভার ব্রিজ। বাস, সি.এন.জি. রিক্শা সব সারিসারি অগ্রসর হচ্ছে যে যার গন্তব্যের দিকে। দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলছে গোল্ডলিপ সিগারেট। ছাই হচ্ছে জ্বলে পুড়ে। আঙুলে তুড়ি দিয়ে কিছু ছাই ফেলে দিলাম নিচে। পিচঢালা রাস্তায় পড়ার আগেই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে উড়ে গেল ছাইগুলো। ব্রিজের পাতে রেখে সিগারেটটার শেষ মাথার টকটকে লাল আলোকে থেতলে দিলাম পা দিয়ে ঘষে। আমার ডানপাশে দাঁড়িয়ে আছে ষোড়শি এক মেয়ে। মাঝে মধ্যে আড়চোখে তাকাচ্ছে সে। তার নিষ্পলক চোখের চাহনিতে তৃষ্ণার ছাপই বলে দেয় সে কোন একজনের প্রতীক্ষায় আছে। এক্ষেত্রে অপেক্ষা শব্দটা বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু কেন জানি প্রতীক্ষা শব্দটার প্রতি আলাদা একটা মমত্ববোধ আছে আমার। পুনরায় মেয়েটির দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে হল, আহা! মেয়েটির সঙ্গে আমার কী চমৎকার মিল। সে যেমন কারও জন্য প্রতীক্ষায় আছে। আমিও তেমন। এই মুহূর্তে সক্রেটিস-এর হেমলক পান করার আগের কথাগুলো বেশ মনে পড়ছে আমার। সক্রেটিস যেন বলছেন-‘এখন আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে, একটি জীবনের আর অন্যটি মরণের।’ কোন্ পথটি মহত্বের? আবারও আমার দিকে ঘুরে তাকাল মেয়েটি। তার এবারের তাকানো একটু অন্যরকম। মেয়েটির হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে আমাকে সে পকেটমার বা ছিনতাইকারী গোছের কেউ ভাবছে? কিন্তু আমি তাকে কেমন করে বোঝায় আমি আত্মহত্যা করতে এসেছি। কিছুক্ষণ পরে হয়তবা ‘আমার মৃতদেহে ঝুলবে নোটিশ বোর্ড কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।’ দুঃখিত নচিকেতা। আপনার গান থেকে মেরে দিলাম লাইনটা। কী করব বলুন? এই মুহূর্তে লাইনদুটির খুব দরকার ছিল যে আমার। হাফাতে হাফাতে একটি ছেলে এসে দাঁড়াল আমার বামপাশে। চোখে কালো সানগ্ল¬াস। চশমাটাতে তাকে খুব মানিয়েছে। যদি কেউ ছেলেটির চেহারার বর্ণনা দিতে বলে, আমি বলব-এই পৃথিবীতে কিছু মুখ আছে, যেসব মুখ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ঠিক এমন একটি গড়নের মুখ তার। তবে তার মুখ দেখে এই মুহূর্তে মন ভালো হচ্ছে না আমার। অথচ হওয়া উচিৎ। ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আমাকে উপেক্ষা করে তাকাচ্ছে ছেলেটার দিকে। ছেলেটির হাসি দেখে বুঝলাম সেই তার প্রতীক্ষার মানুষ। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করলাম-আমিও কি এভাবে কারও প্রতীক্ষায় ছিলাম বা আছি? বুকের বামপাশটা মৃদু হাওয়ায় দুলে উঠল। আমি অবাক হলাম। আলতো করে হাত রাখলাম বুকের বামপাশটায়। অনুভব করলাম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কার জন্য? কীসের জন্য? জানার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাসের হাওয়া ঢুকে পড়লো বুকের মধ্যে। নিচের দিকে তাকিয়ে মানুষের ভিড় দেখে মনে মনে ভাবলাম, এখান থেকে যদি লাফ দিই তাহলে আমিতো মরবোই না, অযথা একটা হুলস্তুলল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলব মানুষের ঘাড়ের উপর পড়ে। আচ্ছা আমি এখন কী করি বলুন তো? আমাকে তো মরতে হবেই। মাথার ভেতর ফাঁকা হাওয়া ঢুকে কু-লী পাকিয়ে বাষ্পীভূত হচ্ছে। ঠাস্ করে পড়ে মাথাটা যদি ফেটে যেত। বেশ হত তাহলে। মগজগুলো ছিটকে পড়ত ব্রিজের পাতের উপর। আর এই গন্গনে দুপুরের রোদে তেতে উঠত মগজগুলো। ফুটতো জ্বলন্ত কড়ার উপর রাখা কৈ মাছের মতো। আর সেখানে খুন্তি দিয়ে নাড়লে শব্দ হত ছ্যাৎ ছ্যাৎ..। আহা! কী মজাটাই না হতো।

আচ্ছা ভাই, মগজের গন্ধ কি খুব বেশি বাজে? তা না হলে আমার পাশ থেকে সানগ্লাস পরা ছেলেটি চলে যাচ্ছে কেন? ইতোমধ্যে মগজ ফাটার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে নাকি? কই আমি তো কোন গন্ধ পাচ্ছি না। ওই তো পাশ দিয়ে আরও একজন ভদ্রলোক দ্রুত স্থান পরিত্যাগ করছেন। প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে উঠল মাথাটার ভেতর। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পাচ্ছি না আমি। শরীরে চিম্টি দিয়ে দেখলাম আমি অসাড় গোছের কোন প্রাণীতে রুপান্তরিত হচ্ছি কিনা? ব্রিজের সিঁড়ির দিক থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একজন ভিক্ষুক। চোখ তার কোটর থেকে বাইরে বের হয়ে আছে অনেকখানিই। এরকম চেহারায় তাকে লাগছে রুপকথা গল্পের রাক্ষস-খোক্ষসের মতো। গ্রীষ্মের তাপদাহে চোখদুটি যেন আগুন হয়ে জ্বলছে তার। মনে হচ্ছে চোখের তাপে গলে পড়বে এই অভার ব্রিজ। ‘অভারব্রিজটা’ গলে পড়বে! কথাটি ভাবতেই এক আনন্দের রোল বেজে উঠল দেহের ভেতর। ভাবলাম মজাই হবে! টুইন টাওয়ারের মত ধ্বসে পড়বে ব্রিজটা। বাংলা চ্যানেলগুলোর খবরের খোয়াক জুগাবে। সারাদিন ধরে চলবে লাইফ টেলিকাস্ট। মানুষজন কাজ-কাম ফেলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে টিভির সামনে। পৃথক পৃথক বিবৃতি দেবেন দেশের সরকারি দল ও বিরোধীদল। এখানেও চলবে রাজনীতি। আগুন যত বাড়বে রাজনীতির অঙ্গনও হবে তত উত্তপ্ত। এভাবে চলতে চলতে চলতেই থাকবে...

আগুনের প্রসঙ্গ আসাতে অন্য আর একদিনের কথা মনে পড়ল আমার। খুব বেশি দিনের নয়। এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। আগুন লেগেছিল এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ শপিং কমপ্লেক্স বসুন্ধরা সিটিতে। গ্রামের বাড়িতে এক চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে টিভি দেখছিলাম আমি। ডিসের সুফল ও কুফল দুটোয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে এখন। তারই কল্যাণে অজোপাড়াগাঁয়ে বসেও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আগুনে পোড়ার সেই ভয়াবহ দৃশ্যালোক। দোকানে অনেক লোকের সমাগম। সবাই প্রায় চাষা-ভূষা গোছের। তাদের মধ্য থেকে আমিই হঠাৎ বলে ফেললাম, আগুনটা ইচ্ছে করেও লাগানো হতে পারে। দোকানের এককোণে বসে থাকা এক বৃদ্ধ লোকটা থরথর করে কেঁপে উঠলেন। বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলো বাবা? তুমার মাথা কি ঠিক আছে? ইচ্ছে করে কেউ কি কখনও আগুন লাগায়? আমি বললাম- লাগাই চাচা, লাগাই। ওদের যে বীমা কোম্পানিতে কোটি কোটি টাকার অগ্নিবীমা করা থাকে। অন্যদিকে ব্যাংক থেকেও হয়ত নেওয়া আছে কোটি কোটি টাকার ঋণ। এ সবই পুষিয়ে নেবার ধান্ধা আর কি? বৃদ্ধটি আমার কথার মাথামু-ু কিছুই না বুঝে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এই যা দেখুন তো ভাই, এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমি তো আত্মহত্যা করতে এসেছি। এসব কথা ভেবে কেন বৃথা সময় নষ্ট করছি? আমার পাশের ষোড়শি মেয়েটা ততক্ষণে উধাও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে তাকালাম। নিচে পিচ্ঢালা রাস্তায় রোদের ঢেউ খেলানো খেলাটা জমে উঠেছে বেশ। হঠাৎ দেখতে পেলাম ওই তো সেই মেয়েটা। সঙ্গে সানগ্লাস পরা সেই ছেলেটাও। দুজনে দুজনার হাত ধরাধরি করে রাস্তা পার হচ্ছে। কী সুন্দর মানিয়েছে ওদের। রাস্তা পার হবার সময় একহাত প্রসারিত করে গাড়িগুলোকে থামিয়ে দিচ্ছে ছেলেটি। গাড়ির ড্রাইভার’রাও তাকিয়ে আছে ষোড়শি এই জুটির দিকে। ছেলেটির হাতের ইশারায় দাঁড়িয়ে পড়ছে গাড়িগুলো। দৃশ্যটি দেখে মেয়েটি বেশ কয়েকবার ঝলমল করে হেসে উঠল। সঙ্গিকে মনে মনে নায়কের আসনে বসালেও কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। আসলেই তো, ছেলেটি নায়কই বটে। তাই তো এতটুকুন বয়সেও এক মেয়ের হাত আঁকড়ে ধরে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে তার সকল দায়-দায়িত্ব। বয়সে যারা প্রবীণ তারা এই যুগলের ভালোবাসা দেখলে আৎকে উঠবেন। আজকের তরুণ’রা এই ভালোবাসার নাম দিয়েছে ‘ডিজুস প্রেম’। আধুনিকতার নতুন সংস্করণ ‘ডিজুস’। আজকাল তরুণদের মধ্যে এই শব্দটি নিয়ে এতো মাতামাতি যে, কয়েক বছরের মধ্যেই এটি বাংলা অভিধানে স্থান করে নেবে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এমনিতেই অনেক ইংরেজি শব্দ আমরা বাংলা হিসেবে ব্যবহার করি। সেক্ষেত্রে একটু অদ্ভুত ও উদ্ভট এই শব্দটি ব্যবহারে কোন অসুবিধা থাকার কথা নয়। ‘ডিজুস প্রেম’কে আজকাল অনেকে ডিজিটাল প্রেমও বলে। এই প্রেমের দৈর্ঘ্য প্রস্থ নাকি আরও ছোট। যাকে বলে শর্টকার্ট পলিসি। নিষ্পাপ কিংবা পবিত্র এই শব্দগুলো এখন বড্ড ব্যাকডেটেড। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও উক্ত শব্দটার প্রতি বেশ আগ্রহী। তিনিও তরুণদের পক্ষে। তাই তো ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করবেন এমনটি আশ্বাস দিয়েছেন। তরুণদের আবেগকে তিনি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর বুড়ো-হাবড়া? তাদের কথা! থাক বাদ দেন না। তাদের আবার কী? এই তো বসে বসে দিন গুনবে। চলে যাবার দিন। আর এই আমি। আচ্ছা ভাই বেকারদের কি তরুণ বলা যায়? কী জানি যাই হয়ত। তবে শুধু তরুণ বললে ভালো শোনায় না। তাই তার আগে বেকার শব্দটি সংযোজন করে বলছি- ‘বেকার তরুণ’। হাঁ হাঁ হাঁ। আমি অভিশাপ দিচ্ছি বেকার শব্দটিকে, যেন অভিধান থেকে সে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায়। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। মৃত্যুর জন্য এত বেশি অপেক্ষা করা ভালো নয়। ঠিক যেমন মরণের পর লাশ বেশিক্ষণ বাইরে রাখা ঠিক না। এতে করে আত্মা নাকি কষ্ট পায়? আমার অবশ্য এসব প্রচলিত নিয়মরীতিতে বিশ্বাস নেই। নাহ্ আর সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নাহ্..। আমি বোধ হয় এই অভার ব্রিজ থেকে লাফ দিলে মরব না। সিদ্ধান্ত পাল্টায়। ভাবি সামনে তো মিরপুর-২। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক নামে একটা সুউচ্চ অট্টোলিকা বুক চিতিয়ে আছে। পুঁজির ভারে তাকে আজকাল একটু ন্যুব্জ দেখায়। ওটার উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করলে কেমন হবে। ওখান থেকে নিচে পড়লে নিশ্চয়ই আমি একেবারেই ছাতু হয়ে যাবো। কোন চিহ্ন থাকবে না। তখন না হয় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ-এর ‘বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা’শিরোনামের কবিতার ভাষায় বলবো-

‌‘ধ্বংসেরও তবু কিছু অবশেষ থাকে, চিহ্ন থাকে

আমাদের তা-ও নেই-স্মৃতি নেই, চিহ্ন নেই, শূন্য গৃহাঙ্গন ’।

আপনি চিন্তা করবেন না রুদ্র সাহেব। আমিও আসছি আপনার মতো নিঃচিহ্ন হতে। মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। মাটির সঙ্গে মহব্বত করতে আমারও যে বড় সাধ হয়। সাধ ও সাধ্যের মিলন সাধনে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, পুঁজির ভারে ন্যুব্জ উক্ত অট্টোলিকার ছাদ থেকেই লাফ দেবো। কিন্তু আমি আবারও মত পরিবর্তন করলাম পরক্ষণে। কারণটা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। সুপ্রিয় পাঠক, আমি যদি উক্ত ছাদ থেকে নিচে লাফ দিই। তাহলে সবাই ভাববে- আমি নিশ্চয় সুদের টাকা পরিশোধ করতে পারিনি বলে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছি। অন্যদিকে এই খবর মিডিয়ার কাছে বেশ রসদ জোগাবে, আলোচনার ঝড় তুলবে। এদের নামে দুর্নামের শেষ নেই এমনিতেই। যেমন ধরুন, গ্রামের কোন মহিলা যদি ঋণ নিয়ে সময় মত সুদসহ পরিশোধ করতে না পারে। তাহলে মাঠ পর্যায়ের কর্মচারিরা তাদের শাড়ি পর্যন্ত নাকি খুলে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে মাঠকর্মীরা নিরব। কারণ তাদের চাকরি বাঁচাতে হবে। তা না হলে নিজেদের বউ পোলাপানদেরও ন্যাংটা হয়ে থাকতে হতে পারে। না কিছুতেই এ কাজ করা যাবে না। আমি ছা-পোষা বেকার যুবক। তাদেরকে বে-ইজ্জতি করা কি আমায় সাজে? তাহলে আমার আত্মহত্যার পরিকল্পনাটি কি ভেস্তে যাবে? না। তা আমি হতে দেব না। বাই হুরুক অর বাই কুরুক আত্মহত্যা করতেই হবে আমাকে। পা দুটি যেন পাতের সঙ্গে আঁটকে যাচ্ছে। দেবো কি লাফ এই ব্রিজ থেকে? মনে হচ্ছে এখান থেকে আর সুবিধে করা যাবে না। তারচেয়ে বরং এই ভালো আজ থাক। বাসায় গিয়ে সারারাত ভেবে পরের দিন সুষ্ঠুভাবে সমাধা করা যাবে কাজটা। অবশেষে বাসায় ফিরে এসে সারাদিনের কর্মকা- সম্পর্কে জানাই এক বন্ধুকে। কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করল না সে। অবশ্য তার বিশ্বাস অবিশ্বাসে আমার কিছুই যায় আসে না। বালিশে মাথা রেখে সারারাত ভেবে, মনে মনে ছক তৈরি করলাম একটা। সেই অনুযায়ী খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলাম। এবার আমার গন্তব্যস্থল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওখান থেকেই লাফ দেবো ঠিক করেছি। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে রওনা হওয়ার মনস্থির করলাম। আবাসিক থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর অনেকট পথ। কর্ণফুলী নামক একটি বাস মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াত করে। বাসটির সার্ভিস এতো বাজে যে এলাকার লোকজন প্রায়ই বেজন্মা বলে গালাগালি দেয়। সে যা হোক, এসব ভেবে আমার কী লাভ? আমি তো এসব থেকে মুক্তির আনন্দ খুঁজছি। এরপর আবাসিক মোড় থেকে কিছুটা জনযুদ্ধ করে বাসে উঠলাম। ভেতরে উঠতেই লোকজন ঠেলতে ঠেলতে পেছনে পাঠিয়ে দিল আমার ক্ষুদ্রকায় দেহটাকে। একদম পেছনের সিটের আগের সিটে ভাগ্যক্রমে (যদিও আমি ভাগ্যে বিশ্বাসি নয়) এক্ষেত্রে আমি সুযোগই বলব। হ্যাঁ, জানালার পাশে একটি সিটে সুযোগ পেলাম বসার। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। সামনের ধাক্কা দেওয়া বলিষ্ঠ যুবকদেরকে ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে একবার। স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফিরে পেলাম একটু। গোঁ গোঁ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাসটা। জানালা দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছি বাইরের দিকে। শেয়াল বাড়ির মোড় থেকে বামে টার্ন নিতেই হালকা হাওয়ার দুলুনি লাগল দেহটার ভেতর। বাসে বসে বই পড়তে পড়তে গন্তব্যের দিকে যাওয়া আমার পুরানো অভ্যাস। সবসময় তাই-ই করি। সেগুলো প্রায় সব-ই হালকা মেজাজের বই। আজ সঙ্গে করে কোন ব্যাগ নিয়ে আসিনি। সুতরাং বইও আনা হয় নি। চরম ভুল হয়ে গেছে। বই পড়তে পড়তে মরতে আমার খারাপ লাগতো না। তবে আর একটা চমৎকার কাজ করেছি। পকেটে চিরকুট ভরে নিয়ে এসেছি কয়েকটা। সব চিরকুটই মৃত্যু ও জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন জনের মতামত। আজ আমি পড়তে চাই এই ভারি মেজাজের কথাগুলো। শোনাতেও চাই অনেককে। অন্য সময় তো সুযোগ পাই না। আজ এসেছে এক মোক্ষম লগ্ন। দশ নম্বর গোল চক্করে এসে থেমেছে বাসটা এখন। তো চলুন শুরু করি-প্রথমে আমার পছন্দের কবি জীবনানন্দ-এর লেখাটা-

“কথাটি মেয়েদের বা ছেলেদের নয়, কোন বয়সের সেটাও হয়তো নয়, মৃত্যু তো তোমার জানাশোনা নিজের জীবনের মধ্যে একমাত্র একটাই শাশ্বত ও নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা নিজে থেকে ঘটবে বা তুমি ঘটাবে। কেন ঘটাবে, তুমি জীবনকে-মোটা কথায় সদর্থক বেঁচে থাকাকে-ভালোবাসো বলে, রোগেশোকে সুখে-দুঃখে সার্থকতা-অসার্থকতায় ক্রমাগত বেঁচে থাকতে চাও বলে, এইসব তোমার ধরাছোঁয়ার বাইরের কোন চিড় তুমি সহ্য করতে পার না বলে; তোমার ভালোবাসার জিনিসটাকেই তুমি তখন ভেঙে ফ্যালো, শিশুরা প্রগাঢ়, সৎ ভাবাবেগে যা করে ফ্যালে, কেন করে, না জেনেই করে।”

ইতোমধ্যে কাজীপাড়া চলে এসেছে বাসটা। জানালা দিয়ে চিরকুটটি ছেড়ে দিলাম বাতাসে। আর জীবনানন্দ-এর মানুষের মৃত্যু হলে কবিতা থেকে উচ্চারণ করলাম-

‘আজকের আগে যেই জীবনের ভিড় জমেছিল

তা’রা ম’রে গেছে;

প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে

অন্ধকারে হারায়েছে;’

আমার দিকে কেমন জানি আড়চোখে তাকাচ্ছে পাশে বসা যাত্রীটি। আমার এহেন কা-ে নিশ্চয় বিব্রত সে। কিন্তু কিছুই বলছে না। যাক বাবা বাঁচা গেল। এরকম এক নিরব দর্শক পেয়ে ভালোয় লাগছে। সবকিছুই দেখবে কিন্তু কিছুই বলবে না। কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারবো সব। পকেট হাতড়ে বের করলাম আর একটা চিরকুট। আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে লোকটা। বেশ নিষ্ঠুর হৃদয়ের কাজ, তবুও তার অসহায় মুখ দেখে হাসি পাচ্ছে আমার। কোনরকম তাকে তোয়াক্কা না করেই পড়তে লাগলাম-

“জন্ম মানে ঘুমিয়ে পড়া; তারপর এই জীবন জুড়ে যা কিছু ঘটে তা সব স্বপ্ন। মৃত্যু মানে ঘুম থেকে জাগা। কেউ যদি অল্প বয়সে মারা যায়, তাহলে বুঝতে হবে যথেষ্ট ঘুম হবার আগেই তাকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে বৃদ্ধ হয়ে মারা গেছে, তার মানে তার ঘুম সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং বারবার তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো, শেষে সে নিজেই ঘুম থেকে উঠে বসেছে। যে আত্মহত্যা করেছে সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল যার সমাপ্তি সে টেনেছে; কারণ সে জেনেছে যে সে ঘুমাচ্ছিলো এবং সচেতনভাবে সে তার ঘুম ভাঙিয়েছে।”

বাহ্ চমৎকার উক্তি, লিও তলস্তয়-এর। আন্দ্রেই তারকোভস্কির দিনলিপি থেকে সংগ্রহ করা। খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে আমার। শেষ দুই লাইন আবারও পড়তে চাইছে মন। আবারও পড়বো, হ্যাঁ আবারও- ‘..যে আত্মহত্যা করেছে সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল, যার সমাপ্তি সে টেনেছে; কারণ সে জেনেছে যে, সে ঘুমাচ্ছিলো এবং সচেতনভাবে সে তার ঘুম ভাঙিয়েছে।’ এবারের চিরকুটটি ফেললাম না। রেখে দিলাম পকেটেই। যেন পরীক্ষায় কমন পড়েছে। পরে চিরকুট দেখে প্রশ্নোত্তর লিখবো। যাকে নকল করা বলে আর কী? মাথার ভেতর নানারকম চিন্তা উঁকিঝুঁকি মারছে। এই মুহূর্তে চমৎকার একটা আইডিয়াও এসেছে। পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে না পারলে ভালো লাগছে না। আচ্ছা বলুন তো? আত্মহত্যার সহজ উপায় নামে একটা বই লিখলে কেমন হয়? এতো কিছুর সহজ উপায় বের হচ্ছে এটাও বা বাদ থাকবে কেন? কথা দিলাম আমি যদি দৈব্যক্রমে বেঁচে যায় অথবা পুনর্জন্ম ঘটে (আমি একটিতেও বিশ্বাসি নয়) তবে আত্মহত্যার সহজ উপায় নিয়ে একটি বই লিখবো। আর যদি উক্ত দুটির কোনটিই না ঘটে। তো যারা আমার লেখাটি পড়ছেন তাদের মধ্যে যে কেউ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন, প্লিজ..। যাতে করে আমার মতো মৃত্যুর পথযাত্রীরা সঠিক উপায়ে আত্মহত্যা করতে পারে। আইডিয়াটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আগারগাঁও এসে জ্যামে আটকে গেল বাসটি। অবশ্য জ্যাম কমাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ড. ফকরুদ্দিন-এর সময়ে আগারগাঁও ও বিজয়স্মরণীর পাশ দিয়ে একটা বাইপাস সড়ক করা হয়েছে। সড়কটি করাতে জ্যাম কমবে কি? বেড়েছে দ্বিগুন। আহা! দেশটার জন্যে হঠাৎ দরদ উত্লে উঠল। চারিদিকে এতো হইচই, দলাদলি, গালাগালি, হাতাহাতি, রক্তারক্তি-হাহাকার! এই আমাদের দিনবদলের নমুনা? ওহ্ নো-ডিসগাস্টিং। ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভগুলো ভয়াবহতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ক্রমশ। আগারগাঁও জ্যাম ছাড়িয়ে এখন বিজয়স্মরণীর দিকে যাচ্ছি আমরা। জানালার ধারে বসে ছোট ছোট ডায়লগ মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। সঙ্গে নোটবুক থাকলে নাট্যকার জর্জ বার্ণাড’শ-এর মতো বাসে বসে নাটকের ডায়লগ লেখা যেত। তিনি নাকি বাসে বসেই অনেক নাটকের ডায়লগ লিখেছেন। সোজা এসে বিজয়স্বরণীর জ্যামে থেমে গেল বাসটা। পকেট থেকে আর একটি চিরকুট বের করেই পড়তে শুরু করি-

“পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মসমূহ মৃত্যুর পরও একটি ভিন্নতর জীবনের লোভ দেখিয়েছে, সে জীবন পাপের শাস্তি অথবা পুণ্যের পুরস্কারের জীবন। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় নব্বইভাগ মানুষ কোনো-না- কোনো ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও, ধর্মকথিত পারিলৌকিক জীবনের প্রতি বিশ্বাস রেখেও ইহলৌকিক জীবন নিয়ে-বলা ভালো, এই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব নিয়ে-অসুখী বোধ করে কেন, কেন অস্তিত্বের অর্থ অনুসন্ধান করতে চায়? তার কারণ হয়ত এই যে, মানুষ অবচেতনভাবে অনুভব করে এই সমস্ত ধ্যান-ধারণা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া, এগুলো কিছুই সে নিজে বেছে নেয়নি-এমনকি তার নিজের জীবনটিও তার বেছে নেয়া নয়।”( কথাশিল্পী আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর মানুষের মৃত্যু হলে প্রবদ্ধ থেকে টুকে নেওয়া)

বাসটি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। ফার্মগেট পার হয়ে কারওয়ান বাজার। আনন্দের জোয়ার বইছে দেহের সব অণু পরমাণুতে। সত্যি বলছি-আমি আনন্দ পাচ্ছি। আত্মহত্যার মধ্যে নিশ্চয় কোন ম্যাজিক আছে। নইলে এই ভরদুপুরে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে শরীর কেন আনন্দে মেতে উঠবে আমার? মাঝে মাঝেই গোঁ গোঁ করছে গাড়িটা। ইনজিন্টা ধাক্কা খেল কয়েকবার। এই জীবনে কিছুই হলো না, আর হবেও বলে মনে হয় না। আমার অবস্থা এখন স্যামুয়েল বেকেট-এর ওয়েটিং ফর গডোর মতো। সেখানে শুরুর ডায়লগটা এমন-‘নাথিং টু বি ডান.. ’। আমি আর পাচ্ছি না। গন্তব্যে পৌঁছাতে আর কতোক্ষণ লাগবে? ও ড্রাইভার ভাই-একটু তাড়াতাড়ি চালান না। আমি ক্লান্ত বোধ করছি। ঝিমুনি আসছে। চোখ দুটি বন্ধ করে একটা হাই তুললাম। চোখের ভেতর ভেসে উঠল অনেক ছবি। মা-বাবা, বড় ভাই, লক্ষ্মী ছোট বোনটা আর আ..র আলো আঁধারে দূর্বাঘাস মাড়িয়ে শিশির মাখানো পায়ে চলে যাওয়া আমার বিপন্ন বিস্ময়! এভাবে কতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম? অথবা ঘুমাই নি। শুধু মনে হলো চোখ বুজে আত্মিক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে ছিলাম বুঝি। এ আমার নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া। নিজেকে নিজেই হাতড়িয়ে খুঁজে নতুন ভাবে আবিষ্কার করা। এটা অবসর সময়ের ভাবনা। কিন্তু আমার আর কোন অবসর নেই। অনেক তাড়া আছে আমার। মৃত্যু আমাকে তাড়া করছে। আমি মৃত্যুর দিকে দৌড়াচ্ছি। থামবার কোন অবকাশ নেই আমার। ওই তো দেখতে পাচ্ছি ৩২তলা বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার বুকে মিশে যেতে আহবান জানাচ্ছে আমাকে। নিজের সঙ্গে নিজেই বললাম, আসছি....।

সামনে শাপলা চত্বর। বুকটার কিছু অংশ ফাঁকা হয়ে গেল। ইতোমধ্যে অবশ্য দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। থরথর করে একবার কেঁপে উঠল পা দুটো। আমি কি ভয় পাচ্ছি? না এমন তো কথা ছিল না। যেহেতু মরতে চাচ্ছি সেহেতু রাস্তা পার হবার সময় ডানে বামে তাকানো অর্থহীন। তা-ই করলাম। রাস্তা পার হতে লাগলাম ডানে বামে না তাকিয়েই। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোন গাড়িঘোড়া স্পর্শ করল না আমাকে। দেদারছে পার হয়ে গেলাম আমি। শাপলা চত্বর অতিক্রম করে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ওপাশে গিয়ে ব্যাংকের দারোয়ানকে খুঁজে বের করা প্রথম কাজ। তারপর তার সাহায্যে রাতে ব্যাংকের ছাদে উঠেই ধপাস...।

দারোয়ানকে পেলাম অবশেষে। দারোয়ান চতুর আলী। সকল পরিকল্পনার কথা তাকে জানালাম। সে বেশ উৎসুক। তার বাড়ি যশোর জেলায়। ভাগ্যের ফাঁদে পড়ে ঢাকা শহরে এসেছে সে। একটা মিষ্টি প্রেমের ও আর একটি বিরহী প্রেমের গল্প আছে তার। তবে সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমি বলতেও চাই না অবশ্য। আপনাদের মধ্যে যদি কারও সঙ্গে তার কখনও দেখা হয় তবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তার দয়া হলে আপনাদেরকে সে গল্প দুটি শোনালেও শোনাতে পারে। আমি আমার জায়গায় ফিরতে চাই। হ্যাঁ, আমি আত্মহত্যা করতে চলেছি। আমার সব কথা শুনে চতুর ভাই বেশ আগ্রহি। আমাকে আত্মহত্যা করাতে সাহায্যে করবে সে। যদিও এই ব্যাংকের ছাদে ওঠা বেশ কঠিন। অনেক পাহারা আছে। তবুও চতুর বলেছে এসব তার কাছে কোন ব্যাপারই না। আলটিমেটলি তাই-ই ঘটল। ঠিকই আমাকে ছাদে উঠিয়ে নিচে নেমে গেছে সে। তার নিচে নামার কারণ হল, সে আমার পাশে থাকলে নাকি আমার বাঁচার ইচ্ছে জাগতে পারে। কী জানি হবে হয়ত? সে যা হোক-বর্তমানে আমার অবস্থান বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাদের উপর। সময় রাত ৮টা। তারিখ ২৮ মার্চ ২০০৯। আকাশে অসংখ্য তারা। এতো তারা একসঙ্গে আগে কখনও দেখিনি আমি। এদেরকে কে নেমন্ত্রণ করল? চতুর ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। সে আমাকে বলেছিল রাতের আকাশের তারা গুনতে তার খুব ভালো লাগে। রাতে ছাদ থেকে লাফ দেবো শুনে সে আরও বলেছিল, যদি আকাশে তারা দেখেন তবে বলবেন-‘একডা তারা দুইডা তারা ওই তারাডার ভাতার মারা’। এই বাক্যটির সঙ্গে তার জীবনের বিরহী প্রেমের গল্পটির যোগসূত্র আছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে তাকে দেখতে। চতুর ভাই আপনি কোথায়..? বর্তমানে এরকম বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। অকৃত্রিম এই বন্ধুকে আমার নকিয়া-৬০৩০ মডেলের সেটটা দিয়ে দিয়েছি। সে আমাকে বলেছে, আমি লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার মিষ্টি প্রেমের নায়িকার কাছে কল দিয়ে কথা বলবে। অর্থাৎ যে মুহূর্তে তার প্রেমিকা কল রিসিভ করবে সেই মুহূর্তেই আমার মৃত্যু ঘটবে। এই সময়টা সে আমার পাশে থাকলে আমার মৃত্যুপত্রটা পড়ে শোনাতাম। নিচে লাফ দেবার জন্য কিছু সাহসও দরকার। সে থাকলে কিছু সাহসও পেতাম। তাকে ওয়ান, টু, থ্রি বলতে বলতাম। আর আমি সঙ্গে সঙ্গে দিতাম লাফ। এক লাফ ধপাস...। ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আজ তো আর্থ আওয়ার। এটি পালনের জন্য বিশ্বের ১০০ দেশের প্রায় এক বিলিয়ন লোক রাত ৮.৩০-৯.৩০টা পর্যন্ত এক ঘন্টা বিদ্যুৎ নিভিয়ে সময়টি উদ্যাপন করবে। আমিও ভাবছি আমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে এই উদ্যোগকে স্বাগতম জানাব। পকেট থেকে শেষ চিরকুটটা বের করার জন্য হাত ঢোকালাম। ওমা! এতো দেখছি অন্য আর একটি। পড়া হয় নি। ওকে, নো প্রোব্লেম এখনি পড়ে দিচ্ছি-

“স্বাভাবিক মৃত্যু বলে কোনো জিনিস নেই। যেহেতু একটা মানুষের উপস্থিতিই পৃথিবীকে জবাবদিহিতার সামনে দাঁড় করায় সেহেতু তার জীবনে যা ঘটে তার কোন কিছুই স্বাভাবিক নয়। সব মানুষকেই মরতে হবে, কিন্তু প্রতিটি মানুষের জন্যই তার মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা, সে যদি সেকথা জানেও, যদি তাতে সম্মতিও দেয়, তবু তা একটা অন্যায্য লঙ্ঘন, অ্যানজাস্টিফায়েবল ভায়োলেশন”

(সিমঁ দ্য ব্যুভোয়া-এর একটি অতি সহজ মৃত্যু উপন্যাস থেকে ধার করা।)

বিল্ডিংয়ের নিচে তাকাতেই চক্কর দিয়ে উঠল মাথাটা। চিরকুটটি ছাদের উপর থেকে উড়িয়ে দিলাম বাতাসে। পকেট হাতড়িয়ে শেষ চিরকুটটি নিয়ে চিৎকার করে পড়তে শুরু করলাম-

“বমি বমি ভাব, নাকি আসছে মৃত্যুই? /-ফিরে এসো আমার হৃদয়। /অনেক যুদ্ধ হল আমাদের।/এবার থামুক আমার জীবন। /শ্লথ আমরা হই নি /যা পেরেছি, করেছি”-আঁরি মিশো (১৮৯৯-১৯৮৪)

আমার মৃত্যু সন্নিকটে অথচ কী আশ্চর্য! নামটাই বলা হলো না এই অধমের। প্রবীণদের হয়ত মনে আছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রেডিও থেকে চরমপত্র পড়া হত। শত্রুর পরাজয়ের খবর আঞ্চলিক ভাষায় প্যারোডি করে বলায় এই চরমপত্রের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু যিনি পাঠ করতেন তাঁর নাম কখনও বলা হতো না। অবশেষে যুদ্ধের শেষ দিন অর্থাৎ বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর আমরা তাঁর নাম জানতে পারি। তিনি ছিলেন এম.আর. আকতার মুকুল। এই চরমপত্রের চরম বিজয় হয়েছিল। কিন্তু আমার জীবনের কোন বিজয় নেই। তাই আপাতত নামটা বলতে চাচ্ছি না। তবে মিডিয়ার কল্যাণে আপনারা হয়ত জেনেও যেতে পারেন। না এতকিছু ভেবে নষ্ট করার কোন মানে হয় না। কথাসাহিত্যিক হেমিংওয়ে একবার বলেছিলেন- ‘প্রত্যেক গল্পের সমাপ্তি হয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে’। আমার জীবনটাও কী কোন গল্প? আমিও তো সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ভাবনাগুলো মস্তিষ্কের সীনাপাস খেয়ে ফেলছে ক্রমশ। ব্যাংকের নিচে বড় বড় বিল্ডিং-এ অসংখ্য আলো ঝলমল করছে। সুপ্রিয় পাঠক এখন সময় ৮.৩০। সো সুইচ অফ...

[লেখকপরিচিতি: মিলন আশরাফ কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক। প্রাচীন জেলা শহর যশোর। সীমান্তবর্তী থানা শার্শা। চারদিক বিল বাওড় ও সোনামুখীর রহস্যে ঘেরা বদ্বীপের মতো গ্রাম স্বরূপদহ। এখানেই জলের সঙ্গে জলকেলি খেলতে খেলতে বেড়া ওঠা মিলনের। একাডেমিক পড়াশুনা যথাক্রমে : স্বরূপদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শার্শা পাইলট হাইস্কুল (বর্তমানে মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়), যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ এবং সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স। নাটকের প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে থিয়েটার স্কুল থেকে এক বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন। ২১তম ব্যাচের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ভেতরে শিল্পের নতুন অস্থিরতায় অভিনয় ছেড়ে সার্বক্ষণিক মনোনিবেশ লেখালেখিতে। বাংলা একাডেমিতে সরকারি অনুদানে তরুণ লেখক প্রকল্পে বৃত্তি নিয়ে কাটান অর্ধবর্ষ।

বর্তমানে সৃজনশীল মৌলিক লেখা, অনুবাদ ও পড়াশুনাতে বেশি ব্যস্ত তিনি। পাশাপাশি একটি বিদেশি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

তার প্রকাশিত বই : আদিপাপ (ছোটগল্প সংকলন, ২০১৪), অনুবাদ : জাদুর আংটি (শিশুতোষ উপন্যাস, ২০১৪), অদ্ভুত সাহায্যকারী (বেলারুশের শিশুতোষ গল্প সংকলন-১, ২০১৫)]

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর