thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ 24, ৫ চৈত্র ১৪৩০,  ৯ রমজান 1445

পাট খাতে রাজনৈতিক প্রভাব

খুলনা সোনালী ব্যাংকের ১৫০০ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত

২০১৭ অক্টোবর ২১ ১১:৫২:২৯
খুলনা সোনালী ব্যাংকের ১৫০০ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা: খুলনা সোনালী ব্যাংকের পাট খাতে রাজনৈতিক প্রভাবে দেওয়া দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখে দিয়েছে ।

রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় তাদের বিরুদ্ধে বিধি-বিধান মত ব্যাংক কতৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সোনালী ব্যাংকের ৬টি শাখায় ১১২জন ব্যবসায়ীর কাছেই মোট পাওনা ১৪৯৮কোটি টাকা।

খুলনা সোনালী ব্যাংকের জোনের জেনারেল ম্যানেজার মো: মোশারেফ হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, যারা ঋণ নিয়ে ব্যাংকে আর আসে না তারাই বারবার নানা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। আর যারা নিয়ম মানছে তাদের কোনো সুবিধাই দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ব্যাংকের অর্থ লোপাটের অন্যতম হোতা ভিজে সিরাজ নামে এক নতুন রফতানিকারক।

তিনি আরও বলেন খুলনায় অঞ্চলে পাট রফতানি খাতে তাদের ব্যাংকের ১১২ জন গ্রাহকের কাছে মোট বিনিয়োগ এক হাজার চারশত ৯৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে ব্যাংকের বিধি-বিধান মতে ১০৮ জনই ঋণখেলাপি হয়েছে। তাদের কাছে পাওনা এক হাজার দুইশত কোটি টাকা, যা বিনিয়োগের ৮০ দশমিক ০৮ শতাংশ ঋনখেলাপি।

জেনারেল ম্যানেজার মোশারেফ হোসেন বলেন, সব থেকে ভয়াবহ চিত্র প্লেজ ঋণের ক্ষেত্রে। মোট দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্লেজ ঋণই ৮৭০ কোটি টাকা। এই ঋণের সিংহভাগই লাপাত্তা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্লেজ ঋণটা দেওয়া হয় গুদামে পাট রয়েছে তার বিপরীতে। কিন্তু পাট রফতানিকারকরা শুধু কাগজ পত্রে গুদামে পাট দেখিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে খাতা পত্র অনুযায়ী পাট নেই। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ তদন্তে এসব চিত্র উঠে এসেছে। প্লেজ ঋণের ভয়াবহ বিপর্য়য়ের ফলে গত ৩ বছর থেকে পাট খাতে প্লেজ ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতি করার দায়ে ঋণখেলাপি অভিযোগ করে ১০৮ জন গ্রাহকে ব্যাংক হতে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। মামলা করার প্রস্তুতি হিসাবে লিগ্যাল নোটিশও দেওয়া হয়েছে। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের আগস্টে। ব্যাংকের বিধি-বিধান মতে তাদের নামে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই মামলা করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষর লিখিত সাকুর্লারে কোনো টাকা পরিশোধ ছাড়াই দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে আগের টাকা ব্লক হিসাবে রেখে তাদের আবার নতুন ভাবে প্রয়োজনীয় জামানত নিয়ে ঋণ দিতে।

পাট ব্যবসায়ীদের একটি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ জুট এসোসেয়েশনের চেয়ারম্যান শেখ সৈয়দ আলী চলতি বছরের ২৬ ফেবুয়ারী অর্থমন্ত্রী বরাবরে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তারা কাঁচা পাট রফতানিকারকদের সকল বকেয়া এবং দেনা একটি সুদবিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তর পূর্বক ১০ শতাংশ সহায়ক জামানতের ভিত্তিতে ২৫ বছরে পরিশোধের সুযোগ দাবি করেন। এই আবেদনের সূত্র ধরে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানসহ বিজেএ’র নেতৃবৃন্দ অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে তাদের দাবির স্বপক্ষে নানা যুক্তি প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাষ্ট্রয়াত্ব চারটি ব্যাংক পাট রফতানিকারকদের এসব প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কয়েক দফা বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর উপর নানা ভাবে প্রভাব বিস্তার করা হয়। রাজনৈতিক ভাবে প্রভাব বিস্তারের ফলে সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের জেনারেল ম্যানেজার মো: খায়রুল কবীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোলাম নবী মল্লিক স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জারি করে গত ২৬ আগস্ট।

অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশ ব্যাকিং, ব্যাকিং প্রবিধি, প্রধান কার্যালয় ঢাকা এর ০২-০৫- ২০১৭ তারিখে বিআরপিডি সার্কুলার লেটার নং ০৩ এবং গনপ্রজাতন্তী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রনালয়,ব্যাংক ও অর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, নীতি ও আর্থিক প্রনোদনা শাখার ২৪-০৪-২০১৭ তারিখের স্বরাক নং ৫৩০০০০০০৩৩১, ৩৬০০২-১৭ ,১০৯ এর নির্দেশনা ও পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ৩১ জুলাই ২০১৭ অর্থ মন্ত্রনালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভার মতামত বিবেচনায় কাচঁপাট রফতানিকারক ঋণগ্রহীতাদের পাট খাতে বিদ্যমান সমস্যা কাটিয়ে উঠে ব্যবসা চালু রাখার বিবেচনায় রেখে ব্যাংকের ঋণের বকেয়া পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে এ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ২ আগষ্ট ২০১৭ তারিখে ৫৩৩তম সভায় পর্ষদ কর্তৃক নিমোক্ত নীতিমালা জারির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।

অর্থাৎ চিঠিতে ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ছাড়াই দুই বছর সময় দেওয়া হয় । দুইবছর পর থেকে তারা কিস্তি পরিশোধ করবে। এসব ঋণখেলাপিরা পুনরায় নতুন ভাবে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাবে। এই চিঠির ফলে সোনালী ব্যাংকের নেওয়া সকল পদক্ষেপ স্থগিত হয়ে গেছে। ব্যাংক ঊর্ধতন কতৃপক্ষর এ সিদ্ধান্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। তবে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন।

খুলনা জেনারেল ম্যানেজার অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের খুলনা কর্পোরেট শাখার পাট খাতে ৫২জন ব্যবসায়ীর কাছে দেওয়া ঋণ মোট ৩৮৩কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিধি-বিধান মতে ঋণখেলাপি হয়েছে সবাই এবং খেলাপি ঋণ ৩৮২কোটি টাকা। শ্রেণিকৃত ঋণের হার ৯৯.৪৮ শতাংশ। দৌলতপুর কর্পোরেট শাখায় ১৯জন গ্রহকের কাছে ঋণ ৬৬৯ কোটি ৫ লাখ টাকা । এর মধ্যে ১৬ জন ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৪৩৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। দৌলতপুর কলেজ রোড় শাখার ২০ জন গ্রহকের কাছে মোট পাওনা ৩২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এরা মধ্যে ১৯ জন গ্রাহকের কাছে পাওনা ৩১৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। শতকারা হিসাবে ঋণ খেলাপি ৯৮.৮৮ শতাংশ। একই চিত্র খুলনা খালিশপুর এবং স্যার ইকবাল রোড়ে সোনালী ব্যাংক শাখায় শাখায়।

সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর কলেজ রোড় শাখার দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সিরাজুল ইসলাম বেশিরভাগ সময় সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্ষালয়ে ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের কক্ষে অবস্থান করে প্রভাব বিস্তার করে এভাবে ব্যাংক লোপাট করে দিয়েছে । তিনি এখনও প্রতিনিয়ত ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের দিয়ে মুঠোফোনে আদেশ দিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট যে এই সিরাজুল ইসলাম ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জন করে বিধিবর্হিভূত ভাবে দশ বছরে এই ৯০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন। তার নিজ নামে ও ছেলের নামে মোট তিনটি হিসাবে রয়েছে, যা জাল জালিয়াতি ও প্রতরানার মাধ্যমে একবার উত্তোলন করে আর জমা দেওয়া হননি।

এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের দৌলতপুর শাখার ম্যানেজার ও প্রিন্সিপাল অফিসার মো: জাকির হোসেন খান জানান, সিরাজুল ইসলাম, তার পুত্র সুমনসহ তাদের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় একশত কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। আদায়ের জন্য মামলা করার পূর্ব পদক্ষেপ হিসাবে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে । তিনি স্বীকার করেন সিরাজুল ইসলাম কারণে অকারণে ব্যাংকের ডিএমডি ,জিএম পরিচালকদের দিয়ে মুঠোফোনে নির্দেশ দিয়ে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করেছেন। সম্প্রতি ব্যাংকের ঊর্ধতন মহল সিরাজুল ইসলামকে সুবিধা দিতে আবারও ফোন করেন। তিনি ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছেন লিখিত আদেশ না দিলে তিনি কোন কিছু করতে পারবেন না।

সিরাজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তাদের এই খেলাপি ঋণ নিয়ে সাবেক মন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহলে বৈঠক হয়েছে। তারা ব্যাংকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন আর কোন সমস্যা নাই। তাদের হিসাব আর ঋণখেলাপির আওতায় থাকবে না ।

এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংক খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার মো: মোশারেফ হোসেন জানান, পাট খাতে বিনিয়োগকৃত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়েছে। সরকার তাদের আবারও সুযোগ দেওয়াই তারা সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এই সুবিধায় পাট খাতের ব্যবসায়ীদের দুই বছরের মধ্যে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

তিনি আরও বলেন, প্লেজ ঋণ বিপর্যায়ের কারণে নতুন করে কোন ঋণ দেওয়া হচ্ছে না।

উল্লেখ্য জাল জালিয়তি করে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে সোনালী ব্যাংকের জিএম নেপাল চন্দ্র, একাধিক ডিজিএম, ঊর্ধতন কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীসহ ৭ জনের নামে মামলা দায়ের করেছে।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/অক্টোবর ২১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর