thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

৩৭ বছরেও সাতছড়ির পাম বাগান থেকে তেল উৎপাদন হয়নি

২০১৭ নভেম্বর ০৭ ০৮:৩২:০১
৩৭ বছরেও সাতছড়ির পাম বাগান থেকে তেল উৎপাদন হয়নি

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে থাকা পাম বাগানটি অযত্ন ও অবহেলায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ৩শ’ ১০ একর ভূমিতে প্রায় অর্ধলক্ষাধীক পাম গাছ শুধু জাতীয় উদ্যানের ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়ে আছে। অযত্ন ও অবহেলায় কারণে কোন কাজে লাগছে না এই গাছগুলো। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে পাম বাগানটি সৃষ্টি করা হলেও, গাছগুলো থেকে তেল উৎপাদন সম্ভব হয়নি। এতে করে একদিকে যেমন উদ্যানের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে তেমনি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

তবে এ ব্যাপারে সাতছড়ি বন কর্তৃপক্ষের দাবি, বাংলাদেশের আবহাওয়া পাম গাছের অনুপযোগি হওয়ার কারণে এখান থেকে কোন ফল সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। যে ফলগুলো আসছে তা এখানকার জীবজন্তুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও পুরনো সমীক্ষা আর অনুসন্ধান বলছে অন্য কথা।

জানা যায়, বাংলাদেশে দৈনিক গড়ে ৬ হাজার মেট্রিকটন এবং বছরে ২১ লক্ষ ৯০ হাজার মেট্রিকটন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। যার সিংহভাগই আমাদের আমদানি করতে হয়। এর আনুমানিক মূল্য হচ্ছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে পাম গাছ চাষে সার্বিকভাবে বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র। দেশের ২২ লাখ টন ভোজ্যতেলের বর্তমান চাহিদা মেটাতে মাত্র তিন কোটি পাম গাছের উৎপাদন প্রয়োজন। পরিবেশগত দিক দিয়েও পাম অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব একটি উদ্ভিদ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এটি বাতাসের গতি রোধ করে বাতাসের ক্ষিপ্রতা কমিয়ে দেয়। ফলে লোকালয়ে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। পাম গাছ দীর্ঘজীবী এবং শক্তিশালী গাছ হওয়ায় ঝড়সহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করতে উপযোগী।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, পামওয়েল গাছ প্রথম আবিস্কৃত হয় মালয়েশিয়ায়। দেশটির মাটি ও আবহাওয়া পামওয়েল গাছের জন্য বিশ্বের সব চেয়ে উপযোগি ছিল। গত ৩৯ বছর ধরে বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু পরীক্ষা করে দেখা গেছে এখানের মাটি ও আবহাওয়া পামওয়েল চাষের উপযোগী। কোনো কোনো স্থানে মালয়েশিয়ার চেয়েও পামের ভালো ফলন আশা করা যায়। বর্তমানে পাম ওয়েল গাছ বাংলাদেশের ফলন মালয়েশিয়ার তুলনায় দেড় থেকে দ্বিগুণ। বাংলাদেশে বছরে একটি গাছে ১০-১২টি কাঁদি ধরে। মালয়েশিয়াতে প্রতি কাঁদির ওজন হয় ২০-৪০ কেজি। আর বাংলাদেশে ৪০-৬০ কেজি পর্যন্ত হচ্ছে।

অনেক সমীক্ষার পর ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে পামওয়েল চাষের সব চেয়ে উপযোগী স্থান হিসেবে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানকে নির্বাচিত করা হয়। পরে বন বিভাগের উদ্যোগে ওই এলাকার প্রায় ৩শ’১০ একর ভূমিতে ১০ হাজার পাম গাছ লাগানো হয়। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে ১০০ একর, ১৯৮৩ সালে ১০০ একর এবং ১৯৮৪ সালে প্রায় ১১০ একর ভূমিতে এসব পাম বীজ লাগানো হয়। সেই সময় দেশে পাম বীজ না থাকায় সুদূর মালয়েশিয়া থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। সেই সময় ১০ হাজার গাছ লাগানো হলেও বর্তমানে গাছ থেকে ফল পড়ে নতুন ছাড়া গজিয়ে সেখানে অর্ধলক্ষাধিকেরও বেশি গাছ রয়েছে।

অথচ রোপণের ৫ বছর পর থেকে ফল দেয়া শুরু হলেও দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে এখান থেকে কোন ফল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে সাতছড়িতে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক পাম গাছ রয়েছে। পাম গাছগুলো পূর্ণতা পাবার পাশাপাশি সাতছড়িকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করায় পর্যটকরা এখানে এসেই পাম গাছ দেখতে ভিড় জমান।

এক সময় পাম ফল থেকে তেল উৎপাদনের কোন কারখানা বাংলাদেশে না থাকায় এখান থেকে কোন তেল উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে পাম ফল থেকে তেল উৎপাদনের কারখানা বাংলাদেশে থাকার পরও এখান থেকে তেল উৎপাদন করা হচ্ছে না। প্রায় অর্ধলক্ষাধিক গাছের ফল কোথায় যাচ্ছে তারও কোন হদিস নেই।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধলক্ষাধিক পাম গাছের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছু গাছ এখনও পুরোপুরি ভালো থাকলেও সেগুলোকে কোন পরিচর্যা করা হচ্ছে না। ফলে বন বিভাগের উদাসিনতার কারণে একদিকে যেমন সরকারের কোটি কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। অন্যদিকে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান।

এদিকে, উৎপাদিত লাখ লাখ টাকা মূলের পাম পাকার পর তা কোথায় যাচ্ছে তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বন কর্মকর্তাদের দাবি পাম পাকার পর বন্যপ্রাণী বানর, হনুমান, উল্লুক-ভাল্লুক নির্বিঘ্নে খেয়ে ফেলেছে। আর অবশিষ্টগুলো ঝরে পড়ে এক সময় মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার একজন ব্যবসায়ি বলেন, বন এলাকায় অবস্থান হওয়ায় ওই বনের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি রয়েছে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এ গাছগুলোর কোনো পরিচর্যা করা হচ্ছে না।

স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, গাছগুলো ঠিকে আছে আল্লাহর কুদরতে। অনেক গাছেই ফল আসে কিন্তু তা কোথায় যায় একমাত্র বন কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন।

এ ব্যাপারে বন বিট কর্মকর্তা মো. আনিছুজ্জামান বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণে লোকবল সংকট রয়েছে। লোকবল সংকটে এখানকার পাম গাছসহ অন্যান্য গাছের কোন পরিচর্যা করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, এখানে জনবল প্রয়োজন প্রায় শতাধিক লোকের। কিন্তু এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারি মিলিয়ে আছে মাত্র ৭জন।

এখানে উৎপাদিত পাম ফল কোথায় যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখানের গাছগুলোতে ফল আসে না। আর যদিও হাতেগোনা কয়েকটি গাছে ফল আসে, তাও বন্যপ্রাণীদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবি বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। তাই এখন পর্যন্ত এ বিষয়টিতে নজর দেইনি। আমি রেমা-কালেঙ্গা পরিদর্শ করে এসেছি। সেখানেও এত বড় বনে কোন ধরণের উৎপাদন হচ্ছে না, যা সত্যি অবাক হওয়ার বিষয়। আমি রেমা-কালেঙ্গায় উৎপাদনের বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমি খুব শিগগিরই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে যাব। এবং পাম গাছের বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করব।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/নভেম্বর ০৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর