thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

ওয়ান ইলেভেনের অজানা কথা-১

সত্যি খালেদাকে  মাইনাস  করতে চেয়েছিলেন মান্নান ভূঁইয়া?

২০১৭ নভেম্বর ১১ ০০:০০:২৬
সত্যি খালেদাকে  মাইনাস  করতে চেয়েছিলেন মান্নান ভূঁইয়া?

ওয়ান-ইলেভেন। ১১ জানুয়ারী ২০০৭ এ সেনাবাহিনী সমর্থিত বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এইদিনটিকে ওয়ান-ইলেভেন বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রাজনীতিবিদদের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো প্রধান দু’টি দলের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় দেশ যখন স্থবির হয়ে পড়ে তখন ওয়ান-ইলেভেন আসে। রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ সাধারণ জনগন প্রথমে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। তারা স্বস্তি পেয়েছিলেন। দেশের সেনাবাহিনী প্রথম বারের মতো সংবিধান স্থগিত করে সেনা শাসন জারি না করে দেশের সুশীল ব্যক্তিদের দিয়ে অরাজনৈতিক সরকার গঠন করে দেয়। স্বচ্ছ রাজনীতিবিদরা মনে করেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেন দেশের রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং সংস্কারের নামে প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে পারষ্পরিক অনাস্থা, সন্দেহ, অবিশ্বাসের জন্ম হয়। যার রেশ এখনও কাটেনি।

ওয়ান-ইলেভেনের ফখরুদ্দিন -মইন ইউ সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়েছিলো। নেতাদের বিভক্ত করার পাশাপাশি ওয়ান-ইলেভেনের সরকার দলের নেতাদের মধ্যে পারষ্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি করেছিলো। সে সময় দুই দলের নেতাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে নির্যাতন থেকে বাঁচতে নিজ নিজ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন নেতারা। শুধু তাই নয়, কারাবন্দি নেতারা তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি যে সব বিষোদগার করতেন তা আবার সংবাদ মাধ্যমে চলে আসতো। এখনও ইউটিউবে সার্চ দিলে তাদের কথার রেকর্ড পাওয়া যায়। সংস্কারের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাদের মধ্যে বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াসহ কেউ কেউ সন্দেহ, অবিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।

ওয়ান-ইলেভেনের সমাপ্তি ঘটে ২৮ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় যাওয়ার কারণে সংস্কারপন্থী নামে পরিচিত নেতারা আওয়ামী লীগের খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি। তবে ক্ষমতাবঞ্চিত বিএনপির মধ্যে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে দলটির ব্যাপক ক্ষতি করেছে।এখনও খালেদা জিয়া পন্থী ও সংস্কারপন্থী বিভেদ অটুট রয়েছে। সে কারণে সরকার বিরোধী আন্দোলনসহ কোন কর্মসূচিতেই সফলতা দেখাতে পারেনি দলটি।

২০০৭ সালের ২৫ জুন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। তাকে সমর্থনকারী নেতারা সংস্কারপন্থী বলে বিএনপিতে পরিচিতি লাভ করেন। ওই বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেন ও দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে বহিষ্কার করা হয়। মহাসচিব করা হয় তৎকালীন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে। কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের মহাসচিবকে বহিষ্কৃত তিন নেতাকে বাদ রেখে দলের বাকি সবাইকে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রয়াত খন্দকার দেলোয়ার সে সময় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে কাজ করাতে ব্যর্থ হন।

ওয়ান-ইলেভেনের সরকার প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ও অভিজ্ঞ নেতাদের দিয়ে সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ায়। এতে করে তাদের প্রতি শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব, অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি হয়। এই সুযোগে দলের মধ্যে দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকা নেতাদের পাশাপাশি দ্বিতীয় সারি ও তৃণমূলের নেতারা সামনে চলে আসে।

ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে একজন সক্রিয় সংবাদ কর্মী হিসেবে সংবাদ সংগ্রহ করেছি। সে সময় সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পন্থী এবং সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতাদের কাছ থেকে তাদের যার যার নিজস্ব অবস্থানের ব্যাখ্যা জানার চেষ্টা করেছি। তাদের ভাবনাগুলো জানার চেষ্টা করেছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করেছি। ওই সময়ে মান্নান ভূইয়ার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আমার কথা হতো। বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে তাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করেছি। তারই রেশ ধরে হয়তো তিনি একান্তে অনেক কথা বলেছেন।একান্তে বলা এসব কথা কখোনো প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি। তবে কেন তিনি এমন একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার একটা ব্যাখ্যা আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । এটা হতে পারে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার এমনও হতে পারে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে আমার করা বিব্রতকর প্রশ্ন থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্ঠা করেছেন।সে সময়ের মান্নান ভূইয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জানতে পারা কিছু বিষয় পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।

দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পৃথক বিএনপি করার পক্ষে একটা যুক্তি তিনি আমার কাছে খোলসা করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে এ বিষয়ে তার একটা ভাবনা ছিলো। তিনি জানতেন ওয়ান-ইলেভেনের উদ্দেশ্য কী? তিনি বলেছিলেন ফখরুদ্দিন সরকারের উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তাদের পরিবারকে বিএনপির নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। একই ভাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে দল থেকে সরিয়ে দেওয়া।

এই দু:সময়ে বিএনপির মহাসচিব হিসেবে তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। তবে তা করতে গিয়ে তিনি যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন সেটা মান্নান ভূইয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দলের বাইরে রাখতে চেয়েছেন। যাতে তাদের জেলবাস বা দেশত্যাগে বাধ্য করা না হয়। এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমাকে বলেছেন। সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি দলের নেতাদের তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ সে সময়ে সদ্য সাবেক বিএনপির ১১৬জন সংসদ সদস্য বিএনপি না করার অঙ্গীকার করে সরকারের একটি সংস্থার কাছে ফ্যাক্স করেছিলেন। তাদেরকে তখন ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। তারা ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভালো ভাবেই পাওয়ার পার্টি হয়ে যেতো এবং বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হতো। সে অবস্থা থেকে বিএনপিকে রক্ষা করতে তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বিএনপিতে সংস্কার প্রস্তাব আনেন। শুধু তাই নয়, সে সময় যারা যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন তারাও নাকি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আলাদা দল করার জন্য তিনি সময় ক্ষেপণও করেছিলেন।

দীর্ঘ ১১ বছর বিএনপির মহাসচিব থাকার পর ওয়ান-ইলেভেনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মান্নান ভূঁইয়া। দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। বহিষ্কারের বিষয়টি তিনি জানতে পারলেও আমলে নেননি। কারণ ভেতরে ভেতরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোন না কোন মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। তবে ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর যখন তাকে কোর্টে নেওয়া হয় তখন তিনি আইনজীবিদের মাধ্যমে মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার ও অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। যদিও বহিষ্কারের বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি।

ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ৬ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের বাসভবন থেকে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। মান্নান ভূইয়া তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, তারেক রহমান আটক হবার আগেই মান্নান ভূঁইয়া তারেক রহমানকে দেশের বাইরে চলে যেতে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। পাল্টা বার্তায় তারেক রহমান তাকে জানিয়েছিলেন রাজনীতি যেহেতু করেন তাই প্রয়োজনে জেলে যাবেন কিন্তু দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে যাবেন না।

আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং অন্য সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারীরা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, তারা দল ভাঙার জন্য তাদের সংস্কারের কথা বলেননি। দলকে অরাজনৈতিক, অসাধু ব্যবসায়ী ও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে রাজনীতিবিদদের মর্যাদা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রের চর্চা জোরদার করে বংশানুক্রমিক (অরাজনৈতিক, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত) ধারা রহিত করে দলকে জনগণের দলে পরিণত করা। যোগ্যতা থাকলে একজন কৃষক-মজুরের ছেলে-মেয়েও যাতে দলের নেতা-নেত্রী হতে পারেন সেই জন্য সংস্কার প্রস্তাব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তেমন দলই গড়তে চেয়েছিলেন। তাদের জীবদ্দশায় দল দুটি রাজনীতি ও আদর্শকেই মূল্য দিয়েছে বেশি। শহীদ জিয়াউর রহমান রাজনীতির একটি চিরায়ত সত্য প্রায়ই উচ্চারণ করতেন যে, 'ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।' কিন্তু বিএনপি এখন চলছে উল্টো পথে। এখন দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়, আরও বড় বিশেষ বিশেষ পরিবার।

আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া তার খসড়া সংস্কার প্রস্তাবের শুরুতেই বলেছিলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর অদূরদর্শিতা, ব্যর্থতা ও হঠকারিতার কারণে দেশে সৃষ্টি হয়েছিল গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। এ অবস্থায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নিয়ামক ভূমিকায় বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশকে সেই মহাসংকট থেকে রক্ষা করেছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ সারা দেশে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাথা হেট করে চলতে হচ্ছে। তাদের হতাশা ও উদ্বেগ দূর করতে এবং বিরাজমান পরিস্থিতির হাত থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে রক্ষার জন্য সংস্কারের আশু প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলকে সময়ের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার বিকল্প নেই।

সংস্কার প্রস্তাবে আরও বলা হয়, দলীয় গঠনতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ সংশোধন করে তিনি জাতীয় কাউন্সিলকে অধিকতর ক্ষমতাশালী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না রেখে তার সব সিদ্ধান্ত কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদন অপরিহার্য করার কথা বলেছিলেন। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছিল, সর্বস্তরের কমিটিতে কর্মকর্তা নির্বাচনে দলীয় নেতৃবৃন্দের পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের অন্তর্ভুক্তিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এও বলা হয়েছিল, সব ধরনের মনোনয়ন দেওয়ার সময় প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব দলের কাছে দাখিল করতে হবে এবং দলের পক্ষ থেকে একটি কমিটির মাধ্যমে সম্পদের সত্যাসত্য যাচাই করা হবে। দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের জন্য দুই মেয়াদে ছয় বছর সময় নির্ধারণ করার কথা বলেছিলেন যাতে নতুন জাতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া যায়।

পরিশেষে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, দলে পরিবারতন্ত্র বিকাশের চেষ্টা, দুর্নীতি, আত্মীয়করণের অশুভ পদক্ষেপ, মনোনয়ন বাণিজ্য, লুটপাট, চাটুকারিতা ইত্যাদি অশুভ প্রবণতা এবং একনায়কতান্ত্রিক পন্থার ব্যক্তি কর্তৃত্ব এই মৌলিক যুগান্তকারী সংস্কার প্রস্তাবের ফলে চিরতরে দল থেকে বিদায় নেবে।

দলে ফেরানোর উদ্যোগ :

ওয়ান-ইলেভেনের পরে দলের একটি অংশ মান্নান ভূইয়াকে দলে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মান্নান ভূঁইয়াকে একটি লিখিত আবেদনও করতে বলেছিলেন তার শুভাকাঙ্খীরা। কিন্তু তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। খালেদা জিয়ার সামনে যাওয়ার মতো নৈতিক মনোবল তার ছিলো না। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মান্নান ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠরা চেষ্টা করলেও পরে ব্যর্থ হন তারা।

উল্লেখ্য ২০০৭ সালের ২৫ জুন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। তাকে সমর্থনকারী নেতারা সংস্কারপন্থী বলে বিএনপিতে পরিচিতি লাভ করেন। ওই বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হলে সংস্কারপন্থীরা তার নেতৃত্বে তৎপরতা চালাতে থাকেন। কার্যত তখন থেকেই বিএনপিতে সংস্কার ও খালেদাপন্থী দুটি ধারা তৈরি হয়। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব হওয়ার পর বিভেদ আরও বাড়ে। কারণ তিনি ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কমিটি গঠনের নামে সংস্কারপন্থীদের বিতাড়িত করেন। ফলে মান্নান ভূঁইয়ার সমর্থকরা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তবে বিএনপি চেয়াপারসন ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর সংস্করপন্থী প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা ভোল পাল্টিয়ে মূলধারায় ফেরত আসেন। এরপরেও প্রায় অর্ধ শতাধিক সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতা বিএনপির বাইরেই থেকে যায়। তারা বিএনপির কর্মকান্ড এবং কমিটিতেও আসতে ব্যর্থ হন। এ তালিকায় উল্লেখ যোগ্যদের মধ্যে মেজর জে. (অব.) জেড এ খান, মোফাজ্জল করিম, আশরাফ হোসেন, শাহ মো. আবুল হোসাইন, শহিদুল হক জামাল, জহিরউদ্দিন স্বপন, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, নজির হোসেন, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, এসএ সুলতান টিটু, ইঞ্জিনিয়ার শহিদুজ্জামান, নুরুল ইসলাম মনি, শামীম কায়সার লিঙ্কন, ইলেন ভুট্টো, আলমগীর কবীর, আবু হেনা, আবদুল গণি (মেহেরপুর), দেলোয়ার হোসেন খান দুলু (ময়মনসিংহ), আতাউর রহমান আঙ্গুর (নারায়ণগঞ্জ), আব্দুল করিম আব্বাসী (নেত্রকোনা), আবু ইউসুফ খলিলুর রহমান (জয়পুরহাট), মেজর জে. (অব.) আনোয়ারুল কবীর তালুকদার (জামালপুর), এমএম শাহীন (মৌলভীবাজার), ফজলে আজিম (নোয়াখালী). শাম্মী শের (মুন্সীগঞ্জ), একেএম আনোয়ারুল হক, (ময়মনসিংহ) শাহরিয়ার আক্তার বুলুসহ অনেকের নাম রয়েছে। দীর্ঘদিন দলে ফেরার আশায় থেকে সংস্কারপন্থী অনেক নেতা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছেন। এরপরেও তারা অন্য দলে যোগদান করেন নি।

সংস্কারপন্থীরা নানা চাপে পড়ে দলের সিস্টেমে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল ছেড়ে যেতে চাননি কেউই। এর প্রমাণ তারা ১০ বছরে নানাভাবে দিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই বিএনপি প্রধান তাদের আবার কাছে টানছেন। সংস্কারপন্থী এক নেতা জানান, বিশেষ পরিস্থিতিতে সংস্কারের প্রক্রিয়ায় জড়াতে হয়েছিল। সঙ্গত কারণে দলীয় প্রধানের কাছ থেকে ১০ বছর দূরে থাকতে হয়েছে।

মান্নান ভূইয়া ১৯৪৩ সালের ৩ জানুয়ারি নরসিংদীর শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মান্নান ভূঁইয়া নরসিংদী অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং কয়েক হাজার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করে তিনি নরসিংদীর শিবপুরসহ বিশাল এলাকা মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।

স্বাধীনতার পর মান্নান ভূঁইয়া ন্যাপের কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং নরসিংদীতে কৃষক সমিতি সংগঠিত করেন। তিনি দীর্ঘসময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে মান্নান ভূঁইয়া ন্যাপ থেকে বের হয়ে আসেন এবং ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) গঠন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ইউপিপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ১৯৭৯ সালে ইউপিপি থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। তিনি জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের আহবায়ক মনোনীত হন। এছাড়া তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। মান্নান ভূঁইয়া ১৯৮০-এর দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নরসিংদী-৩ (শিবপুর) নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯১ সালে শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং পরে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি বিএনপির মহাসচিব মনোনীত হন। মান্নান ভূঁইয়া ১৯৯৬ সালে এবং পুনরায় ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মান্নান ভূঁইয়া ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপির মহাসচিব ছিলেন।

মান্নান ভূঁইয়া দেশের সবকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেন এবং একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে লিয়াজো রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ফুসফুসের ক্যান্সারে ২০১০ সালের ২৮ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন মান্নান ভূঁইয়া। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

লেখক: সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর

রাজনীতি - এর সব খবর