thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল 24, ৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ৭ শাওয়াল 1445

হঠাৎ কেন জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দিলেন ট্রাম্প?

২০১৭ ডিসেম্বর ১১ ২০:৫৫:৫৬
হঠাৎ কেন জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দিলেন ট্রাম্প?

সমস্ত প্রথা, আইন-কানুন ও বিরোধিতা উপেক্ষা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম শহরকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে সরিয়ে এনে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণা করেছেন। তার এই ঘোষণার কারণে যে গোলযোগ ও বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এরইমধ্যে কয়েকজন ফিলিস্তিনি নাগরিকের জীবন গেছে, বহু আহত হয়েছেন এবং আশংকা করছি, ইসরাইলের হাতে আরো বহু ফিলিস্তিনি নাগরিকের জীবন যাবে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে- তার দায় কে নেবে? নিশ্চয় সে দায় প্রথমত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর বর্তাবে। সে দায়ভাগ ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপরও বর্তাবে; সঙ্গে সঙ্গে এসব অপরাধের দায়ভাগ সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানর ওপরেও পড়বে।

ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্যদিয়ে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কেন তার দায়ভাগ যুবরাজ সালমানের, সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে; আগে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির সময়কার কিছু কথা এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করি। এখানে বলে রাখি, এই সময়টাতে কেন ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন তার কারণগুলো নিয়েও আলোচনা করব আশা করছি।

বায়তুল মুকাদ্দাস যা তাই জেরুজালেম আবার তাই আল-কুদস।

ইহুদিরা ও পশ্চিমারা বলে...জেরুসালেম বা জেরুজালেম।

বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে অবস্থিত বায়তুল আকসা বা মসজিদুল আকসা।

১৯৪৭ সালে জতিসংঘে যে প্রস্তাবের মাধ্যমে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল তাতে বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম শহরকে বাদ রেখে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ হয়ে যায় ইসরাইল এবং আরেক ভাগ হয় ফিলিস্তিন। বায়তুল মুকাদ্দাস শহরের ধর্মীয় সংবেদনশীলতার দিক বিবেচনা করে এ শহরের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয় এবং এর নিয়ন্ত্রণ রাখা হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইহুদিবাদী সেনারা বায়তুল মুকাদ্দাসের পশ্চিম অংশ দখল করে নেয়। এরপর ১৯৬৭ সালে মিশর, সিরিয়া ও জর্দানের সঙ্গে ছয়দিনের যুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব অংশ দখল করে নেয়। তবে, গত ৬ ডিসেম্বর বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সমাজ কিংবা একক কোনো দেশ তা স্বীকার করে নি। জেনেভা কনভনেশন অনুযায়ী, জবরদখল করা ভূমির ওপর দখলদার শক্তি সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করতে পারে না এবং কোনো দেশ বা ভূখণ্ড জবরদখল করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। ফলে, ইহুদিবাদী ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাস শহর দখল করে নিলেও আজ পর্যন্ত কেউ তাকে ইসরাইলের ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি; এমনকি যে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোরের ঘোষণা অনুযায়ী ইসরাইল সৃষ্টি করা হয়েছে সে ব্রিটেনও বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের অংশ মনে করে না। ট্রাম্পের ঘোষণায় অন্তত বাহ্যিকভাবে তারাও খুশি নয়।

বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার বিষয়ে ১৯৯৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব পাস হয় কিন্তু বিষয়টির সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন কিংবা পরবর্তীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা বাস্তবায়ন করেন নি। সমস্ত প্রথা ভেঙে ডোনাল্ড ট্রাম্প তা করেছেন এবং তিনি এক রকমের গর্বই করছেন!

প্রধানত যে কারণ দেখিয়ে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল সৃষ্টি করা হয়েছিল তা আসলেই হাস্যকর এবং অযৌক্তিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির শাসক এডলফ হিটলার নাকি লাখ লাখ ইহুদি হত্যা করেছেন যাকে হলোকাস্ট বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ইহুদি চতুর নেতাদের পক্ষ থেকে সুর তোলা হয়- ইহুদিদের নিজস্ব কোনো রাষ্ট্র নেই সে কারণে তারা আজ গণহত্যার শিকার হয়েছে। নেতারা নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান এবং জায়গা হিসেবে তারা বেছে নেন ফিলিস্তিনকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তখন আন্তর্জাতিক বলয়ে ইহুদিবাদী লবির এতটাই প্রভাব ছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী শক্তি আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া -সবাই তা মেনে নেয়। এই সত্যের পক্ষে তখন কেউ কথা বলার মতো থাকল না যে, হিটলার যদি ইহুদি হত্যা করে থাকেন তাহলে তিনি তো ইউরোপের নেতা। ফিলিস্তিনবাসীর কী অপরাধ? তারা কেন এর দায় চুকাবেন? এছাড়া, ইউরোপে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা করেছে খ্রিস্টান শক্তিগুলো। ফলে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য কেন ফিলিস্তিনের মুসলমানরা নিজেদের ভূমি দেবেন? ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্র নেই বলে তারা গণহত্যার শিকার- এও কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। রাষ্ট্র থাকার পরও বিশ্বের বহু জাতি বলদর্পী শক্তির হাতে গণহত্যার শিকার হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব অযৌক্তিক কথার ওপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে আমেরিকা ব্রিটেন রাশিয়া সবাই মিলে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয় যার আসল লক্ষ্য ছিল ভিন্ন।

কেন ট্রাম্প এ কাজ করলেন?

প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন ট্রাম্প হঠাৎ করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন? ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় যদিও ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত হলে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সে ঘোষণা থেকে সরে আসার কথা জানান। এ নিয়ে ট্রাম্প টুইটারে বার্তাও দেন। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর অনেকটা হঠাৎ করেই তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেন এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে নেয়ার কথা বলেন। এর কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে- ট্রাম্প অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছেন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং ট্রাম্পকে বিজয়ে রাশিয়ার ভূমিকা, নারীঘটিত কেলেংকারি, জামাই জারেদ কুশনারের রুশ-সংশ্লিষ্টতা এসব বিষয় নিয়ে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভাগ্য ইদানিং অনেক বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সে কারণে তিনি ইহুদিবাদী লবিকে খুশি রাখতেই তড়িঘড়ি করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ট্রাম্প আশা করছেন, এ ঘোষণার মাধ্যমে অন্তত আরো কিছুদিন তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন, ইহুদিবাদী লবি সেজন্য তৎপরতা চালাবে। এছাড়া, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স হচ্ছেন অসম্ভব রকমের ইহুদিবাদী খ্রিস্টান। তিনিও এ সুযোগ নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে তিনি তার ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে পারেন। পাশাপাশি আরেকটি ঘটনা রয়েছে। সেটা হচ্ছে- ট্রাম্পের জামাই কুশনার নিজে একজন ইহুদি এবং ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এই তরুণ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের মতো অনেক বড় একটি ইস্যু নিরসনের দায়িত্ব পান। তিনি ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টার পদে রয়েছেন। এই ইহুদি কুশনারও বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ট্রাম্পকে প্রভাবিত ও চাপ প্রয়োগ করেছেন।

ট্রাম্পকে এই সংবেদনশীল ইস্যুতে এতবড় পদক্ষেপ নেয়ার সাহস যুগিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানও। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে অনেকটা লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির মতো সৌদি আরবে তলব করেন। মাহমুদ আব্বাস সৌদি আরব পৌঁছালে তাকে যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান জানান, বায়তুল মুকাদ্দাস হবে ইসরাইলের রাজধানী এবং বিষয়টি মেনে নিতে হবে। মুহাম্মাদের প্রস্তাবে আপত্তি জানালে মাহমুদ আব্বাসকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করার কথা বলেন। মূলত যুবরাজ মুহাম্মাদ, ট্রাম্প ও কুশনারের উত্থান ঘটেছে অনেকটা একই সময়ে এবং এই চক্র একজোট হয়ে কাজ করেছে। মুহম্মাদ বিন সালমানের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় এজেন্ডা হচ্ছে- তিনি হবেন আরব বিশ্বের একক নেতা এবং তার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতা ও অর্থ। এজন্য তিনি একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন অন্যদিকে, নিজ পরিবারের ধনাঢ্য প্রিন্স, মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আটক করে অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করেছেন। এই অগাধ ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর যুবরাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, তার জামাই কুশনার ও ইহুদি বলয়ের বাইরে যেতে পারছেন না। তিনি মনে করছেন, এসবের মাঝ দিয়ে বিশাল বড় কিছু করে ফেলছেন; তিনি নিজে এমন ক্রেডিট নিতে চান যে, দীর্ঘদিনের সমস্যা তিনি সমাধান করে ফেলেছেন! কিন্তু তিনি কী করলেন, কত বড় সর্বনাশা বিপদ ডেকে আনলেন ফিলিস্তিনি ও সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তার আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত যে গোটা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে আঘাত করেছে এবং পরিণামে বহু মানুষের জীবন যেতে পারে সম্ভবত তার পক্ষে তা আঁচ করা সহজ নয়। তিনি ফিলিস্তিনিদের করুণ ইতিহাসের অনেক কিছুই দেখেন নি বা জানেন না কিংবা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না।

মার্কিন পরিকল্পনার কোনটারই শুধুমাত্র একটি দিক থাকে না। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ইহুদি লবি মিলে যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার নানা দিক থাকে; থাকে নানা প্যাঁচ। সহজে বুঝে ওঠা মুশকিল কী তার কারণ, কী তার আগ-পিছ।

আরো কিছু কারণ :

সম্প্রতি ইরাকের কুর্দিস্তানকে আলাদ করার একটি ইসরাইলি-মার্কিন পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে। অথচ আলাদা কুর্দিরাষ্ট্র হলে তা হতো মূলত ইসরাইলের বর্ধিত অংশ এবং ইরান সীমান্তে হওয়ায় ইরানের ভেতরে ইসরাইল বহু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হওয়ার বেশি সুযোগ পেত। আরেকটি পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে কেন্দ্র করে। সাদ হারিরি পদত্যাগের নাটকের মধ্যদিয়ে সৌদি আরব ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। একইভাবে সৌদি আরব হামাসকে ধ্বংস করতে চায় অথচ এই হামাস ইসরাইলের কবল থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে। সৌদি আরবের নিজের মুরোদ নেই, আবার যারা ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে চায় তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে। এখান থেকে পরিষ্কার হয়- আসলে সৌদি আরব ফিলিস্তিনের জন্য কিছু করতে চায় কিনা।

ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসনের পর সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ। কিন্তু সম্প্রতি তাকে সৌদি আরব ম্যানেজ করতে সক্ষম হয় এবং জনপ্রিয় হুথি আনসারুল্লাহ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সালেহর অনুগত সেনারা অস্ত্র ধরে। ইয়েমেনে এক ধরনের ক্যু করে পরিস্থিতি সৌদি আরবের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপর হয়েছিলেন সালেহ। এই ক্যু করার কাজে সালেহ সফল হলে আজ ইয়েমেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত এবং সেখানে যে স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে আনসারুল্লাহ যোদ্ধারা সংগ্রম করছে তার অবসান হতো। কিন্তু বিষয়টি মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয় হুথি আনসারুল্লাহ এবং সালেহসহ তার গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডাররা নিহত হন। এখানেও সৌদি আরব তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি সিরিয়ায় উগ্র আইএস সন্ত্রাসীদের পতন হলেও ইসরাইল বা বার বার বিমান হামলা চালিয়ে সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া ও হিজবুল্লাহ বিষয়টিতে অত্যন্ত ঠাণ্ডামাথায় কাজ করেছে এবং সিরিয়া ইস্যু একটা সমাধানের দিকে যাচ্ছে যদিও ইসরাইল ও তার মিত্রদের পরিকল্পনা থেমে যায় নি, হয়ত তারা আরো ষড়যন্ত্র করবে। তারপরও আপাতত সিরিয়া ইস্যুতে ইসরাইল, সৌদি আরব ও আমেরিকা ব্যর্থ। এসব ব্যর্থতা ঢাকা যেমন প্রয়োজন ট্রাম্পের জন্য তেমনি প্রয়োজন নেতানিয়াহুর জন্য, একই রকম প্রয়োজন সৌদি আরবের জন্য। নেতানিয়াহু নিজেও আর্থিক কেলেংকারিতে জর্জরিত, মামলা চলছে তার বিরুদ্ধে। এ মুহূর্তে বায়তুল মুকাদ্দাসকে যদি তিনি ইসরাইলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পারেন তাতে তার অবস্থান মজবুত হবে এবং ইসরাইলের লোকজনের কাছে তিনি সংকট কাটিয়ে হিরো বনে যাবেন। বিন সালমানও কৃতিত্ব নিতে পারবেন যে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের অবসানে তিনি বড় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু তিনি একথা বিবেচনায় নেন নি ফিলিস্তিনি ভূমির পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রকৃতপক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়; তিনি এও বিবেচনায় নেন নি- কত জীবন আর কত রক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে আজকের ফিলিস্তিনি সংগ্রামের ইতিহাস! তিনি বিবেচনায় নেন নি- কত ত্যাগ আর কুরবানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে ইতিহাস।

কী হবে ফলাফল?

সৌদি-ইসরাইল-মার্কিন বলয় যে ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে তার ফলাফল খুব সুখকর হবে না তাদের জন্য। কারণ ফিলিস্তিনিরা ভূমির বিনিময়ে শান্তি চায় না তা খুবই পরিষ্কার। সেজন্যই তো তাদের কাছে হামাস এত জনপ্রিয়। কিন্তু ঠিক এর বিপরীত অবস্থান নিয়েছে মুসলিম বিশ্বের কথিত নেতা ও দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম বলে পরিচয় দানকারী সৌদি রাজপরিবার। কিন্তু তাদের এই ভূমিকা ও অবস্থান ফিলিস্তিনিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। সে কারণে এরইমধ্যে তারা বিশেষ করে গাজাবাসী সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান ও রাজা সালমান বিন আবদুল আজিজকে গাদ্দার হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ছবি ও কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে। আপোষ করতে চায় না বলেই গাজার ফিলিস্তিনি জনগণ বছরের পর বছর অবরোধের মধ্যে রয়েছে কিন্তু আত্মসমর্পণ করে নি। টানেল খুঁড়ে তারা গোপনে খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি পণ্য যোগাড় করছে, তবু মাথা নোয়ায় নি।

সৌদি-ইসরাইল-মার্কিন বলয় যে তৎপরতা শুরু করেছে এতে একদিকে যেমন ফিলিস্তিনিদের ঐক্য জোরদার হবে তেমনি কথিত শান্তি আলোচনার নামে আপোষ আলোচনারও মৃত্যু ঘটবে। ফিলিস্তিনের জনগণ আরা বেশি সংগ্রমমুখর হয়ে উঠবে। নতুন করে ইন্তিফাদা বা গণজাগরণ দেখা দেবে। সারা বিশ্বে ফিলিস্তিন ইস্যু আরো জোরদার হবে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করেই আমেরিকার প্রভাব আরো ক্ষুণ্ন হবে। সৌদি রাজতন্ত্রের পতনও অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ অনেক বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। যে ইরানের প্রভাব খর্ব করার জন্য এত চেষ্টা-প্রচেষ্টা সেই ইরানের প্রভাব দিন দিন বাড়বে, এভাবে পরাজিত করা যাবে না বরং ইরানই হয়ে উঠবে ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রধান নির্ভরতার প্রতীক। তাতে একান্ত সহযোগী থাকবে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়া। কারণ হাফেজ আল-আসাদ ও বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়া শুরু থেকেই ইসরাইল-বিরোধী অবস্থান ধরে রেখেছে; আপোষ করে নি। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সবগুলো যুদ্ধে সিরিয়া অংশ নিয়েছিল কিন্তু অন্যদের মতো আপোষ করে নি। সর্বশেষ ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সঙ্গে যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরাইল। পরবর্তীতে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে বৈধতা ও স্বীকৃতি দিয়ে সেই সিনাই উপদ্বীপ ফেরত নিয়েছে মিশর কিন্তু সিরিয়া তা করে নি। সিরিয়া সরকারকে প্রস্তাব দেয়া হলেও তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বরং ইসরাইলের কাছ থেকে গোলান মালভূমিসহ গোটা ফিলিস্তিন উদ্ধারের জন্য সংগ্রামের প্রত্যয় মনের ভেতরে জারি রেখেছে সিরিয়া; আপোষ করে নি। এই চিন্তা থেকেই সিরিয়া ফিলিস্তিনের হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহকে সব রকমের সমর্থন দিয়ে আসছে। সিরিয়ার বিরুদ্ধে ইসরাইল ও আমেরিকার এত শত্রুতার পেছনে এসবই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কারণ। এজন্য আরব বিশ্বে সিরিয়া হচ্ছে ইসরাইলের প্রধান শত্রু। কিন্তু মাথামোটা, ক্ষমতালিপ্সু ও আপোষকামী সৌদি নেতাদের তা বোঝার মতো অবস্থা নেই। বরং দঃখজনকভাবে আজকের দিনে সিরিয়াকে একই রকম শত্রুতার কাতারে ফেলেছে সৌদি আরব।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রেডিও তেহরান।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর