thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

 

জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রকল্প : সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ

২০১৪ মার্চ ০১ ১৪:২০:৪৯
জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রকল্প : সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

'অদ্ভুৎ আঁধার এক নামে চারিধারে' এ রকম একটা সময়ে আমরা অবস্থান করছি। আমাদের চিন্তারাজ্য নানা টানাপোড়নে বিধ্বস্ত। ধাবমান সময়ের পিঠে চড়ে তবু কবিতাপ্রেমে আবিষ্ট বহুজন এ পথের মুসাফির। কবিতা কী, কবিতা কেমন হবে, কবিতার ভবিষ্যৎ-ইবা কী— এমন কতগুলো কী'র উত্তর খোঁজার ফাঁকে জীবনানন্দ দাশ স্মরণীয় হয়ে উঠেন।

'কবিতার কথা' নামক প্রবন্ধে এ নিয়ে তিনি নানা উত্তর করেছেন। ‘বরং লেখনাকো একটি কবিতা’— এই চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী বলছেন, 'সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি— কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নবনব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।'

তিনি একই প্রবন্ধে আবারও এ কথা বলছেন, 'হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন; কিন্তু উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয; যা উদ্ঘাটিত হল তা যে কোন জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্যৈর রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে; যদি তা না দেয় তাহলে উদ্ঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরোনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি, কিংবা হয়তো নতুন কোনো চিন্তাও (যা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), কিন্তু তবু তা কবিতা হল না, হল কেবলমাত্র মনোবীজরাশি। কিন্তু সেই উদ্ঘাটন-পুরোনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব-নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল; আরো নানা রকম মূল্য-যে সবের কথা আগে আমি বলেছি— তার থাকতে পারে, আমার জীবনের ভিতর তা আরো খানিকটা জ্ঞানবীজের মতো ছড়াতে পারে, আমার অনুভূতির পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারে, আমার দৃষ্টি স্থূলতাকে উঁচু মঠের মতো যেন একটা মৌন সূক্ষ্মশীর্ষ আমোদের আস্বাদ দিতে পারে; এবং কল্পনার আভায় আলোকিত হয়ে এ সমস্ত জিনিস যত বিশাল ও গভীরভাবে সে নিয়ে আসবে কবিতার প্রাচীন প্রদীপ-ততই নক্ষত্রের নতুনতম কক্ষ-পরিবর্তনের স্বীকৃতি ও আবেগের মতো জ্বলতে থাকবে।' —এ বিশ্বাসের মাত্রা জীবনানন্দকে আলাদা স্থান করে দিয়েছে কবিতার ইতিহাসে। এ কারণে আমাদের সময়েও আজ তাঁর মূল্য অনেক গভীরে প্রোথিত।

জীবনানন্দ দাশ অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে সৈয়দ আলী আহসান বলছেন, 'বর্তমানে পৃথিবী হচ্ছে বিজ্ঞানের এবং পর্যাপ্ত সামগ্রীর। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অসম্ভবের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়েছে যার মধ্যে আমরা ব্যতিব্যস্ত এবং দিক-ভ্রান্ত। সমযের গতিবিধিও এখন হিসেব করা যাচ্ছে না— একটি অসম্ভব দ্রুততায় আমাদের বর্তমান সময় অতীতের অস্পষ্টতায় হারিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের পক্ষে কোনো বিশেষ সূত্রের মধ্যেই স্থিতিশীল হওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। এ সময় যাঁরা কবিতা লিখছেন তাঁদের কবিতায় কোনো সুবিন্যস্ত বর্ণনা প্রস্তাবনা নেই, একটি অস্থির বিসংবাদের রেখাঙ্কন আছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বর্তমানকালের এই অস্থিরতার তত্ত্বকে তাঁর কবিতায় ব্যাখ্যা করেছেন। বিষ্ণু দের কবিতায় রূপকল্প, চরণবিন্যাস এবং কারুকর্মের মধ্যে যুগের অস্থিরতা প্রতিচিত্রিত হয়েছে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ একটি বেদনাময় আত্মকেন্দ্রিকতায় আপন অস্তিত্বের চৈতন্যকে অনুভব করতে চেয়েছেন। তিনি পৃথিবীকে একটি একক অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করতে চেয়েছেন, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি এবং প্রাণী একাকার হয়েছে। মানুষ শুধুমাত্র আপন সামাজিক, সাংসারিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে উপস্থিত নয়, সে সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি এবং প্রাণীজগতের সঙ্গেও একটি বিশেষ আবহে একত্রিত রূপে উপস্থিত। আমরা আকাশ, মাটি, বৃষ্টি, নদী, পাথর, লতা, গাছের শাখা, স্থলচর প্রাণী এবং কলকণ্ঠের অনেক পাখি নিয়ে পৃথিবীতে বাস করি। এদের সঙ্গে অবশ্য আমাদের সংসার যাপন নয়, কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব যাপনের মধ্যে এরা সর্ব মুহূর্ত উপস্থিত। তাই জীবনানন্দ দাশ মানুষকে প্রকৃতির বর্ণবৈচিত্র্যের মধ্যে এবং প্রাণীজগতের অবিস্থিতির মধ্যে নির্ণয় করতে চেয়েছেন। নির্ণয় করার উপায় হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাদের সকল অনুভূতিগুলোকে উৎকণ্ঠিত করা। এই অনুভূতিগুলো হচ্ছে দৃষ্টির অনুভূতি, ঘ্রাণের অনুভূতি, স্পর্শের অনুভূতি, স্বাদের অনুভূতি এবং শ্রবণের অনুভূতি। মানুষের সজীবতার প্রমাণ এই অনুভূতিগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। একমাত্র ম্রিয়মাণ মুমূর্ষু ব্যক্তির কোনো অনুভূতি নেই। কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশ তাঁর কর্তব্য ভেবেছিলেন এই অনুভূতিগুলোকে সকল বর্ণনার মধ্যে প্রমাণিত করা।' (আধুনিক কবিতা : শব্দের অনুসঙ্গে, পৃ-৩৯)

এই বিবেচনা সহকারে জীবনানন্দ দাশকে অধ্যয়ন করে দেখি, — তিনি বাংলা কবিতার একেবারে স্বতন্ত্র বিভা। ঔজ্জ্বল্য ও লাবণ্যে অনন্য; শব্দগঠন, প্রয়োগ এবং বাক্যগঠনে স্বতন্ত্র অনন্য কবিতার শরীর তৈরীতে। তার ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ দেখে কবি নিজেও প্রস্তর যুগ থেকে আধুনিক যুগের দিকে যাত্রা করেছিলেন। অথচ এ চিত্রকল্পের ভেতরই শাশ্বত হয়ে উঠেছিল ‘নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোত্স্নাকে ছুঁয়ে’ যাওয়া অশেষ যুগের বাস্তবতা। ‘ঘোড়া’ কবিতার চিত্রকল্পগুলো কালচেতনায় উদ্ভাসিত বলে কবি সমকালের হয়েও মহাকালের বাণীবাহক হয়ে উঠেছিলেন। আর ‘আকাশলীনা’ কবিতায় স্বার্থপর প্রেমিকের আকর্ষণ থেকে কোনো এক ‘সুরঞ্জনা’কে ফেরানোর তাগিদে যে সময়ের ছবি আঁকলেন, তা-ও ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে’র।


‘আকাশলীনা’ কবিতায় যে কবিকে পাই, সে কবি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বাধীন রুচির প্রতি প্রতিবন্ধক— যা আধুনিকসম্পন্ন মানুষের দীক্ষিত মন গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু ভিন্নার্থে চিন্তা করলে বিষয়টি ভিন্ন রকমের তাৎপর্যও বহন করে। ‘সুরঞ্জনা’ যদি সাধারণ কোনো এক সরলার ভূমিকায় কল্পনা করা যায় যার সারল্যভরা মনে কোনো প্রবঞ্চনা ধরা পড়ে না, সে সরলার যে-কোনো ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করার ব্রত নিজে গ্রহণ করেছেন। ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ আপাতজীবিকাজটিল জীবনের অভিজ্ঞান। এ কবিতারও চতুর্থ পঙিক্ততে ‘হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল— রাঙ্গা’ হয়ে ওঠার পর পরই একটি স্পেসসহ পঞ্চম পঙিক্ততে ‘চুপ-চুপে ডুবে যায়— জ্যোত্স্নায়’ ভিন্ন রকম স্বাদ এনে দেয়।


কল্পনাবিলাসিতার জন্য কল্পনাবিলাসীদের বারণ করতে পারেন না। তবু যারা ‘টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে/বিনষ্ট হতেছে সাংহাই’ তারা নিশ্চয় মেনে নেবেন, জীবনানন্দ দাশকে কোনোভাবেই রাজনীতিবিমুখ কবি বলা যায় না। জীবনানন্দ দাশ নির্জনতাপ্রিয় কবি সত্য; কিন্তু বিশ্বচরাচরের বিভিন্ন ঘটনা ও দুর্ঘটনা তাকে ভাবিত করেনি— এ কথা সত্য নয়। অন্তর্মুখীন হওয়ার কারণে উচ্চকণ্ঠে চেঁচামেচিতে তার অনীহা ছিল ‘রূপার ডিমের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা’র মতো। দূর থেকে দেখেছেন যা কিছু পৃথিবীতে অকল্যাণ ডেকে আনে। যুদ্ধের ভয়াবহতা দূর থেকে অনুভব করেছেন, প্রতিকারের কোনো ব্যর্থতম চেষ্টা করেননি; কিন্তু রাজনীতিবিদ, সমাজবিদদের প্রেরণা যুগিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদের। সময়ের অগ্রগামী ছিলেন বলে তাত্ক্ষণিক তার কাব্যভাষা সমকালের যুগমানস উপলব্ধি করতে পারেনি। এ ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ একটি খণ্ড কবিতা হয়েও হয়ে উঠেছে সমকালের যুগসন্ধিক্ষণের যোগসূত্র।


আবেগের তারল্যে ভেসে গেলে এ কবিতটিও ‘বনলতা সেন’-এর মতো পাঠকপ্রিয় হতে পারত। কিন্তু ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি যে অর্থে ইতিহাস-আশ্রিত ভৌগোলিক সীমা ও অসীমের সঞ্চয়, সে অর্থে ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’কে অভিব্যঞ্জিত করা যায় না। দু’টি কবিতার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, অনুভব ভিন্ন। ভিন্ন দু’টি কবিতার অবয়ব ও কালচেতনাও।

চিত্রকল্প নির্মাণে ‘বনলতা সেন’ স্বতন্ত্র। উল্লিখিত কবিতা দু’টিতে এমন চিত্রকল্প ঝলসে উঠতে দেখা যায় না। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’-এর মতো উপমা-আশ্রিত এমন অমোঘ চিত্রকল্প উল্লিখিত কবিতা দু’টিতে কোথায়? কোথায় এমন ভারমুক্ত আশ্রয়? ‘পাখির নীড়ের’ সঙ্গে তুলনীয় আশ্রয় কেবল নাতিশীতোষ্ণ বাংলায়ই সম্ভব। আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে কল্পনারও অতীত। তাই ‘বনলতা সেন’ কবিতার সঙ্গে যতই অ্যাডগার অ্যালান পো’র কিংবা ইয়েটসের কবিতার মিল দেখানো হোক, ‘বনলতা সেন’ স্বতন্ত্র শিল্পই।


জীবনানন্দ স্বভাবের সপক্ষে একটি জটিল সারল্যের কবিতা ‘বোধ’। সহজ-সরল বাক্যবন্ধের সম্মিলনে রচিত এ কবিতা। আপাত সরল বাক্যাবলীর মাধ্যমেই জটিল চিন্তা ঘনীভূত হয়ে উঠেছে; ধীরে ধীরে। ক্রমেই জটিলতম চিন্তার দুর্গম অঞ্চলে পরিণতি পেয়েছে। ব্যক্তি-বিশেষের স্ববিরোধ শিল্পের অঞ্চলে এক অনির্বচনীয় ঢেউয়ের নাম ‘বোধ’। ‘আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়-কোন এক বোধ কাজ করে’, কিন্তু সে বোধ কী? সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
অথচ দুর্বোধ্য সে অনুভূতিপুঞ্জকেই যেন গভীর মমতায় প্রকাশ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। না পেরেই কি একা হয়ে গেলেন? ‘সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখে শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা?’ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এ বৈশিষ্ট্যই জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক এবং সমকালীন আধুনিক কবিদের থেকেও ভিন্ন ও বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে। এটিই তার মহত্তম আধুনিক কবিসত্তার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ঘৃণা, অবহেলা— সবই একজন মানুষের মনে কী করে একীভূত হয়ে এক অব্যক্ত বেদনারাশির জন্ম দেয়, তা-ই যেন এ কবিতার মূল বিষয়ে পরিণত।


এটি আধুনিকতাবাদের নৈরাশ্য ও নিঃসঙ্গচেতনা কিংবা বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং অলৌকিকতায় আস্থাহীনতার বৈশিষ্ট্যকে নিশ্চিতির রূপ দেয়। আপন চিত্তের চাঞ্চল্যের কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ কবি। বিস্ময় প্রকাশের ভাষা তার, ‘সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়!’ তারপরই বিস্ময়াভিভূত আপন হৃদয়ের কাছেই প্রশ্ন জমা রাখেন, ‘অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?’ অসুখী মানুষ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার আঁকুতিই প্রকাশ করে। সাঁর্ত্রে কথিত অস্তিত্ববাদী চেতনার এ আরেক বিরল দৃষ্টান্ত। ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’র সঙ্গে ‘বোধ’ কবিতার অন্তর্গত মিলের চেয়ে অমিলই যেন বেশি। যে অর্থে ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ রাজনীতি সচেতন কবিতা, সে অর্থে ‘বোধ’ নয়। প্রথমটিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির যোগাযোগকে পূর্ণ করে তোলা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে ব্যক্তির একাকিত্ব, হাহাকারকে চাড়িয়ে দিয়েছেন মানবমনে।

‘অবসরের গান’ কবিতার শুরুতেই ইন্দ্রিয়ঘন উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে বিস্ময় জাগে। ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/অলস গেঁয়োর মত এই খানে কার্তিকের ক্ষেতে;/মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ’ পুরো তিন পঙিক্তজুড়েই একটি চিত্রকল্প উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্বাদের অবাস্তব রূপের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্মিলন। অলীক উপলব্ধির সংশ্লেষ ঘটানোর অভিনব কৌশলও। যার নাম হয়তো প্রকারান্তরে পরাবাস্তবও হতে পারে। কিন্তু এখানে পরাবাস্তবতা খুঁজে পেতে গেলে বাস্তবতারও সংশ্লেষ ঘটাতে হয়। কার্তিকের মাঠে মাঠে ফসলের উত্সব। কৃষকের মনে আনন্দের হিল্লোল। এতসব আনন্দের ভেতর অলস সময় কাটানোর মতো অফুরন্ত সময় পাড়াগাঁর মানুষের থাকে না। নতুনকে আহ্বান করা ও বরণ করার ভেতরই উচ্ছ্বাসপূর্ণ হয় না। পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চয়ও মানুষের চিন্তাবর্গের অনেকটা অঞ্চলজুড়ে জায়গা করে রাখে। তাই ‘পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে’ যখন বের হয়ে আসে অন্ধকারে তখন ‘ইঁদুরেরা চলে গেছে’। খাদ্যচক্রের প্রসঙ্গনির্ভর এ চিত্রকল্পের প্রাণীজগতের অনিবার্য সত্য চিত্রায়িত। আবার এ দৃশ্য ইয়েটসকে মনে করিয়ে দেয়। ইয়েটসেও কেবল ইঁদুর আর পেঁচার আনাগোনা। কিন্তু ইয়েটসের কবিতায় যে অর্থে প্যাস্টোরাল কবিতার গন্ধ খুঁজে পান সমালোচকরা, সে অর্থে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কোনো গ্রাম্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। অথচ দু’জনই গ্রামের দৃশ্য এঁকেছেন।

এ কথা সত্য যে, শিল্প পুরোপুরি সমাজ-বিমুখ নয় কিন্তু তার নিজস্ব একটি গতিধারা আছে— নিজের যুক্তিতে সে অগ্রসর হয় এবং শ্রুতিতে যে ধ্বনি সে ধারণ করে তা তার নিভৃত লোকের কণ্ঠস্বর, পৃথিবীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কলরোল নয়। এভাবেই জীবনানন্দ দাশ এক পৃথিবী নির্মাণ করেছেন যা একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব-জনসাধারণের নয়। জার্মান কবি রিল্কে এক তরুণ কবিকে উপদেশ দিয়েছিলেন— 'তুমি তোমার মধ্যে আত্মগোপন কর এবং যে-উৎস থেকে তোমার জীবন জেগেছে তার গভীরতা জানবার চেষ্টা কর। শিল্পী তার নিজের জন্য এক ভূখণ্ড নির্মাণ করবেন এবং আপনার মধ্যে এবং প্রকৃতির মধ্যে সকল বিস্ময়ের সন্ধান করবেন। তুমি তোমার নির্জনতাকে ভালবাসবে এবং নির্জনতার কারণে যে বেদনা সে-বেদনার নির্মম দাহনকে সহ্য করবে।' এমন পথের পথিক জীবনানন্দ রূপের রাজ্যে অবসরপ্রিয় মানুষের চোখ দেখেন ‘আকাশের মেঠোপথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ’। কারণ ‘সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে’। শীতের শেষে বসন্ত, বসন্ত শেষ না হতেই গ্রীষ্মের আলস্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অনেকটা ‘গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে’ ধরনের বার্তাও শোনা যায়।


‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায় চিত্রকল্পের বিপুল সমাহারে বিস্ময় জাগে। ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়’ বলে সময়নির্ভর চিত্রকল্পের আশ্রয়ে কবিতার শুরু। যেখানে চাঁদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল, সেখানে জোনাকিরা অন্ধকার দূর করে দেয়। এমন শীতে ‘মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার’ শুনেও পুরনো পেঁচার ঘ্রাণের সন্ধান করে সুলুকসন্ধানী মন। অপরূপ শীতের রাতে অশত্থের ডালে ডালে বক ডেকে ওঠে। ‘বুনো হাঁস শিকারীর গুলির আঘাত’ এড়িয়ে দূরে চলে গেলে ‘সন্ধ্যার কাকের মত আকাঙ্ক্ষা’ নিয়ে নিত্যদৃশ্যে অভ্যস্ত হয় সংসারী মানুষ। সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হলুদ হয়ে এলে ‘মিনারের মত মেঘ সোনালী চিলেরে তার জানালায় ডাকে’ চিত্রকল্পে জীবনানন্দ দাশের স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় হলেও এর ভেতরই মৃত্যুর করুণ দৃশ্যও উঁকি দেয়। তাই ‘সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত এসে জাগে/ধূসর মৃত্যুর মুখ’ তখন মৃত্যুর আগে আরও একবার বেঁচে থাকার আকুতি জানানোর আকাঙ্ক্ষাও জাগে।


‘আটবছর আগের একদিন’ একটি রহস্যময কবিতা। রহস্যটা—বোধের দিক থেকে, না কি প্রকাশের দিক থেকে? যাপিত জীবনের প্রতি ব্যক্তির বিবমিষা জন্মে, তাই কোনো কার্যকারণ সম্পর্কে পারম্পর্য রক্ষা না করেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে শ্রেয় জ্ঞান করে কবিতার নায়ক। বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈরাশ্যই তাকে জীবনের সমস্ত প্রাচুর্য উপেক্ষা করে আত্মহননের দিকে প্ররোচিত করে— যে রকম ঘুম একজন মানুষের কাম্য হতে পারে না, সে ঘুমই তার জোটে। তার মনে হয়, জেগে থাকাই যেন গাঢ় বেদনা ভরা। সে বেদনার ভার তাকে আর সহ্য করতে হবে না। শেষোক্তি শোনায় ‘চাঁদ ডুবে চলে গেলে-অদ্ভুত আঁধারে/যেন তার জানালার ধারে/উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।’ শেষ পঙিক্তর উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে ফুটে ওঠে একটি বিশেষ বিষণ্ন সময়ের ভয়াবহ চিত্র। যাপিত জীবনের ক্লেদজ অভিজ্ঞতার ভিড়ে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কাছে লাশ কাটা ঘরের স্পন্দনহীন হিম ঘুমই শ্রেয় মনে হয়। আবার ‘রাত্রি’ কবিতায় ‘হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল’ বলে যে বিশেষ মুহূর্ত ও মানসিক অবস্থার বিবরণ পেশ করা হয়েছে, তার শেষ টেনেছেন ‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়/লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।/তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব—অতিবৈতনিক/বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবত’ দিয়ে। নগরের ক্লেদজ ও মমতাহীন যাপিত জীবনের নির্মম বহুরৈখিকতায় ঋদ্ধ এ চিত্র।


জীবনানন্দ দাশে রূপকধর্মী চিত্রকল্প তেমন স্পষ্ট নয়। প্রতীকধর্মীও নয়। সর্বত্রই উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্পের প্রাচুর্য। ‘হায় চিল’ থেকে শুরু করে ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুচ্ছ। ‘হায় চিল’ কবিতার ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে’ পঙিক্তও মানবমনের জটিল ঘূর্ণাবর্তের তীরে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত সত্যের নাম। ‘ক্যাম্পে’ নামক সে জটিল চিন্তাশ্রয়ী কবিতা, সেখানেও উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্প। ‘মৃত পশুদের মত আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি’ পঙিক্তও উপমাকে আশ্রয় করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চিত্রকল্প। ‘শ্যামলী’ কবিতায় সমকালের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে চিরকালীন দিগ্বলয় স্পষ্ট। জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্বে উপমা, উৎপ্রেক্ষার প্রাচুর্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চিত্রকল্পের অমোঘ স্বাক্ষরও। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাত’— এ পরিপূর্ণ জীবনানন্দ দাশের কাব্যবিশ্ব।

ইংরেজ কবি শেলী ছিলেন চিত্রকল্প সৃষ্টিতে অনন্য। জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্প গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির সমন্বয়ে নির্মিত। চিত্রকল্পের সঙ্গে থাকে প্রতীক। জীবনানন্দ প্রাকৃতিক প্রতীক ব্যবহার করে তার কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন। আকাশের তারা আর নদীর জলের ওপর ভাসমান ফুল তার কবিতায় অপূর্ব সাদৃশ্য সৃষ্টি করেছে। অন্ধকার প্রতিবেশে শ্রবণ ইন্দ্রিয়, ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণকারী মন প্রবলভাবে সৌন্দর্যের স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আলোকিত জীবনে আমরা অন্ধকারের, রোমান্সের স্বাদ পাই কি? তাই কবি মৃত্যুকে বেছে নেন জীবনকে গভীরভাবে ভালোবাসার জন্য। তীব্রভাবে উপলব্ধি করার জন্য। এমনকি জীবনকে আবিষ্কার করার জন্য। মৃত্যুর আক্রমণ থেকে জীবন আমাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে থাকে। শিশুকে স্পর্শ করে কবি তার শৈশবে ফিরে যেতে চান। কারণ, সহজবোধ্য, শৈশব থেকে মৃত্যু বেশ দূরে অবস্থান করে।

মানুষ সব সময় বস্তুকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে চায়। ইতিহাসের ঘটনাপরম্পরাকে সে তার স্মরণের মধ্যে চিত্র-রূপে উপস্থিত রাখে, ভালোবাসার অনুভূতিকেও সে দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে চায়। তাই কবিতায় প্রধানতঃ আমরা লক্ষ্য করি যে, কবি একটি ছবি এঁকে ঘটনাকে এবং অনুভূতিকে পাঠকের দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করছেন। বাংলা কবিতায় এই দৃষ্টির অনুভূতিটা স্বয়ম্প্রভ এবং কবিতার মধ্যে একটি অনুভূতিকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবির সব চেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে সমস্ত অবস্থাকে দৃষ্টিপাতের মধ্যে নিয়ে আসা। দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্প সহজেই উপমার সাহায্যে গড়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যধারায় এই দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্পের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। কিন্তু স্পর্শের অনুভূতি, গন্ধের অনুভূতি, শ্রবণের অনুভূতি এবং স্বাদের অনুভূতি, শব্দে তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন, এবং রবীন্দ্রনাথের সময়ে ব্যাপকভাবে তার পরীক্ষাও হয়নি। জীবনানন্দ দাশের কাব্যে আমরা বাংলা কবিতার সর্ব প্রথম এই অনুভূতিগুলোকে শব্দে তুলে ধরার আকুলতা লক্ষ্য করলাম। প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দ দাশ জীবন-বিমুখ কবি নন, বরঞ্চ জীবনকে জানেন বলেই প্রকৃতির আদিমতা এবং সজলতার মধ্যে তিনি তাঁর অস্তিস্তের সন্ধান করেছেন।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও আলোচক

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর