thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

নজরুলের ছোটগল্প : কতিপয় বিবেচনা-শেষ কিস্তি

২০১৮ মে ২৬ ০০:২১:৫৮
নজরুলের ছোটগল্প : কতিপয় বিবেচনা-শেষ কিস্তি

গাজী মোঃ মাহবুব মুর্শিদ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ঘটনাক্রমে গ্রামের বাউণ্ডেলে ছেলেদের সর্দার আল্লা­রাখা এবং চতুর্দশী রূপবতী চানভানু পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু এই ভালোবাসা অনেকটা সংগোপনেই থাকে, এবং ঘটনাক্রমে চানভানুর অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। বিয়ে প্রতিরোধের আর কোন উপায় না পেয়ে আল্লা­রাখা বিচিত্র ভৌতিক সব কর্মকাণ্ডের সৃষ্টি করতে থাকে - যার একটি হল জিনের বাদশার ছদ্মবেশ ধারণ। কলকাতা থেকে চিঠি পর্যন্ত ছেপে নিয়ে আল্লা­রাখা চানভানুর পিতা নারদ আলীকে পাঠায়। নিম্নোদ্ধৃত চিঠিটিতে পূর্ববঙ্গের, বিশেষ করে ফরিদপুর-বরিশাল অঞ্চলের ভাষার প্রয়োগ লক্ষণীয়। সংলাপে আঞ্চলিক ভাষার এই যথার্থ ব্যবহার নিঃসন্দেহে গল্পটিকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত করে তুলেছে। চিঠির কিয়দংশ :

খোদাতালার হুকুম হইয়াছে আল্লা­রাখার কাছে বিবাহ দিতে। আর যদি খোদাতালার হুকুম অমান্য করছ তবে শেষে তোর ম্যাইয়্যা ছেমরি দুঃকু ও জ্বালার মধ্যে পরিবে। ... চান ভানু আমার ভইনের লাহান। আমি উহারে মালমত্তা দিব। দেখ তোরে আমি বারবার বলিতেছি - তোর ম্যায়্যার আল্লা­রাখা ছেমরার কাছে শাদি বহিবার একান্ত ইচ্ছা। তবে যদি এ বিবাহ না দেছ, তবে শেষে আলামত দেখিবি। ইতি জিনের বাদশা গায়েবুল্লা। (ন. র. ৪ : ৩৮৩)

কিন্তু চান ভানুর শ্বশুর ছেরাজ হালদার ধূর্ত ও বুদ্ধিমান মানুষ। আল্লা­রাখাই যে জিনের বাদশা এটা অনুমান করতে তাকে খুব বেগ পেতে হয়নি,ফলে চানভানুর বিয়ে হয়ে গেল। চান ভানুর যে রাতে বিয়ে হয়ে গেল তার পরদিন সকালে আল্লা­রাখার বাপ মা ভাই সকলে আল্লা­রাখাকে দেখে চমকে উঠল। তার সে বাবরি চুল নেই, ছোট ছোট করে চুল ছাঁটা, পরনে একখানা গামছা হাতে পাঁচনি, কাঁধে লাঙ্গল ! (ন.র. ৪ : ৩৮৭) আল্লা­রাখার এই পরিবর্তন বিস্ময়কর হলেও অবিশ্বাস্য নয়। প্রিয়জনকে হারানোর তীব্র আঘাত তার মানসলোকে যে ঝড় তুলেছে তারই প্রতিক্রিয়ায় এই রূপান্তর।

শুধু যদি দুষ্টু কিশোরের প্রেমভিক্ষার জন্য বদমায়েশির গল্প হত, তবে এই অকিঞ্চিৎকর কাহিনি উল্লেখযোগ্য হত না। কিন্তু রোমিয়োর মতো নায়ক আল্লা­রাখারও উত্তরণ (বিয়োগান্ত বিরহের মধ্য দিয়ে) গল্পটিকে গভীরতা ও প্রাণ দিয়েছে। (কৃষ্ণরূপ ২০১৪ : ২৪৩) সমালোচকের এই মন্তব্যটির সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বলতে হয়, নজরুল অন্তত এই গল্পটিকে মিলনান্তক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারতেন, কেননা গল্পটির গতি সেই সম্ভাবনার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। আল্লা­রাখার প্রভাবশালী মাতব্বর পিতার কোন ভূমিকা গল্পটিতে দেখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে, হাস্যরসের আড়ালে ট্র্যাজিক প্রেমের একটি অনবদ্য গল্প হিসেবেই জিনের বাদশা পাঠকচিত্তে স্থায়িত্ব পাবে।

শিউলিমালার আরেকটি বিশিষ্ট গল্প অগ্নি-গিরি। এই গল্পের পটভূমি রূপে বীররামপুর (পূর্বে উল্লিখিত আবদুল কাদিরের ভাষ্যে দরিরামপুর) ও ত্রিশাল থানার উল্লেখ স্পষ্টতই নজরুলের আত্মজৈবনিক উপাদানেরই সাক্ষ্য বহন করে। জিনের বাদশার মতো নজরুল এখানেও আঞ্চলিক শব্দ ও সংলাপ ব্যবহার করেছেন এবং স্বভাবতই তা ময়মনসিংহের । এর সাথে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটেছে বেশ কিছু ছড়ার ব্যবহারে। অবশ্য জিনের বাদশাতেও লোক-অনুষঙ্গ সোনাভানের পুথি প্রযুক্ত হয়েছে।

অগ্নি-গিরির প্রধান চরিত্র শরিফ ঘরের ছেলে সবুর; যার বয়স উনিশ কুড়ি হবে; - মাদ্রাসায় পড়ে আলি নসির মিঞার বাড়িতে জায়গীর থেকে। সবুর শান্তশিষ্ট ভদ্র, অতি ভদ্র ছেলে। পাড়ার দুরন্ত ছেলেদের সর্দার রুস্তম তার দলবল নিয়ে সারাক্ষণ সবুরের পেছনে লেগে থাকে, তাকে বিরক্ত করে, ক্ষেপায়। ছেলে মহলে সবুরের নাম প্যাঁচা মিঞা। ... পাড়ার ছেলেদের অধিকাংশই স্কুলের পড়ুয়া। কাজেই তারা মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলেদের বোকা মনে করে। (ন. র. ৪ : ৩৮৯) নজরুল নিজে স্কুলে পড়ালেখা করলেও এখানে একটি সমাজদৃষ্টিকে যথার্থই তুলে ধরেছেন।

জায়গীরদারের পঞ্চদশী কন্যা নূরজাহানকে সবুর যত্নের সঙ্গে পড়ায়। এ নূরজাহান জাহানের জ্যোতি না হলেও বীররামপুরে জ্যোতি - জোহরা, সেতারা, এ সম্বন্ধে কারও মতদ্বৈত নাই। নূরজাহানের নিজেরও যথেষ্ট গর্ব আছে, মনে মনে তার রূপের সম্বন্ধে। (ন. র. ৪ : ৩৮৯) কিন্তু সজ্জন সবুর নূরজাহানের প্রেমে পড়া দূরে থাক, চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায় না। অন্যদিকে দুষ্ট ছেলেরা সবুরকে যে যথেচ্ছ অপমানিত করে তা নূরজাহানকে ভীষণ ব্যথিত করে, কষ্ট দেয়। রুস্তমদের অত্যাচার যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন ক্ষুব্ধ নূরজাহান নিজেকে আর সংবরণ করতে পারে না, সংকোচের আবরণ সরিয়ে মুখোমুখি হয় সবুরের। অগ্নি-গিরি থেকে :

সেদিন সন্ধ্যায় যখন পড়াতে গেল সবুর, তখন কোনো ভূমিকা না করে নূরজাহান বলে উঠল, আপনি বেডা না ? আপনারে লইয়া ইব্লিশ পোলাপান যা তা কইব আর আপনি হুইন্যা ল্যাজ গুডাইয়া চইলা আইবেন ? আল্লায় আপনারে হাত মুখ দিছে না ?

সবুর আজ যেন ভুলেই তার ব্যথিত চোখ দুটি নূরজাহানের মুখের উপর তুলে ধরল। কিন্তু চোখ তুলে যে রূপ সে দেখলে, তাতে আর ব্যথা লজ্জা অপমান সব ভুলে গেল সে। দুই চোখে তার অসীম বিস্ময় অন্য জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। এই তুমি ! সহসা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল -নূরজাহান। ...

সবুরের কন্ঠে তার নাম শুনে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল। বর্ষা রাতের চাঁদকে যেন ইন্দ্রধনুর শোভা ঘিরে ফেলল।

আজ চিরদিনের শান্ত সবুর চঞ্চল মুখর হয়ে উঠেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে ঝড় উঠেছে। মৌনী পাহাড় কথা কয় না, কিন্তু সে যেদিন কথা কয়, সেদিন সে হয়ে ওঠে অগ্নি-গিরি।

সবুরের চোখে মুখে পৌরুষের প্রখর দীপ্তি ফুটে উঠল। সে নূরজাহানের দিকে দীপ্ত চোখে চেয়ে বলে উঠল, ঐ পোলাপানের যদি জওয়াব দিই, তুমি খুশি হও ? নূরজাহানও চকচকে চোখ তুলে বলে উঠল, কে জওয়াব দিবে ? আপনি ? (ন. র. ৪ : ৩৯৫)

সবুরের মনোজগতের রূপান্তরকে অনুধাবণের জন্য এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিটি দিতেই হল। সবুরের ভেতরের সুপ্ত অগ্নি-গিরি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল নূরজাহানের তীব্র শব্দাঘাতে। ফলে পরবর্তী সময়ে রুস্তম ও তার দল সবুরকে অপমানিত করতে এলে সবুর রুখে দাঁড়ায়। সবুরের প্রতিরোধের মুখে ঘটনাচক্রে রুস্তমের দলেরই একজন ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। সবুর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী না হলেও সে আত্মপক্ষ সমর্থন না করে আত্মসমর্পন করে, পরবর্তী সময়ে বিচারে তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। পুলিশ তাকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে সবুর তার রক্তমাখা হাত দিয়ে নূরজাহানকে তুলে বলে উঠল, আমি যাইতেছি ভাই। যাইবার আগে দেহাইয়া গেলাম - আমিও মানষের পোলা। এ যদি না দেহাইতাম, তুমি আমায় ঘৃণা করতা।(ন. র. ৪ : ৩৯৭)

গল্পের শেষদিকে দেখতে পাই, নূরজাহানের পিতা এই শোকাবহ পরিবেশ থেকে মুক্তি ও মানসিক শান্তির আশায় সপরিবারে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন। বিরহের মধ্যেও সাত বছর পরে পুনর্মিলনের সুপ্ত সম্ভাবনা অবশ্য লেখক রেখে দিয়েছেন, যেন ছোটগল্পের অনিশ্চয়তার সূত্র মেনেই। অগ্নি-গিরির আলোচনাসূত্রে এই সমালোচক-মন্তব্যটি এখানে সংযোজন করা যায় :

এই গল্পে প্রেমচিত্র অঙ্কনে নজরুল সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। নূরজাহানের একটি কথায় সবুরের মধ্যে পৌরুষ জেগেছে নাটকীয়ভাবে এবং আত্মমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে সে জীবনে মহা সর্বনাশের সম্মুখীন হয়েছে। এই গল্পের শিরোনামা অগ্নি-গিরি উপজীব্যের সাথে দৃঢ়ভাবে স¤পৃক্ত। (মোবাশ্বের ১৯৮১ : ২০১)

পদ্ম-গোখরো কাজী নজরুল ইসলামের আলোচিত গল্পসমূহের অন্যতম। আদরিণী, মহেশ-এর মতো বাৎসল্য রসের গল্প বাংলা সাহিত্যে আমরা ইতোপূর্বে দেখলেও সাপকে নিয়ে এমন অভিনব গল্প আমাদের সাহিত্যে বিরল। বাৎসল্য গল্পটির মুখ্য থিম হলেও রূপকথা-উপকথার ঢঙে বলা এই কাহিনীতে অ্যালিগরির ঢঙে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, লোভ, কামনা-বাসনাই ফুটে উঠেছে। (কৃষ্ণরূপ ২০১৪ : ২৪১)

রসুলপুরের মীর বংশের সন্তান আরিফের স্ত্রী জোহরাকে কেন্দ্র করে পদ্মগোখরোর কাহিনি আবর্তিত। ক্ষয়িঞ্চু জমিদার বংশের হতশ্রী দশা কেটে সুদিন ফিরে আসে জোহরা এই বাড়ির বধুরূপে আসার পরে। গ্রামময় এই কথা প্রচার হয়ে পড়িল যে, মীর সাহেবদের সৌভাগ্য-লক্ষ্মী আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। (ন. র. ৪ : ৩৫৮) প্রকৃতপক্ষে জঙ্গলাকীর্ণ জীর্ণ প্রাসাদে পিতলের কলসী ভরা বাদশাহী আশরফি প্রাপ্তি মীর সাহেবদের ভাগ্য পরিবর্তনের হেতু। এই গুপ্তধন আগলে ছিল একজোড়া সর্পযুগল, সাহস করে দুধের বাটি সামনে এগিয়ে দিয়ে তাদের বশে আনার কৃতিত্ব জোহরার। এই বাস্তু পদ্ম-গোখরো দুটি এরপর জোহরার অনুরাগী হয়ে পড়ে এবং জোহরাও এদের সন্তানবৎ স্নেহ-ছায়ায় লালন-পালন করতে থাকে। আপতদৃষ্টিতে উদ্ভট, জোহরার এই প্রাণী-বাৎসল্যের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে যে অতীত-কাহিনি, তা নিম্নরূপ :

জোহরার বিবাহের এক বৎসরের মধ্যে তাহার দুটি যমজ সন্তান হইয়াই আঁতুড়ে মারা যায়। জোহরার স্মৃতি-পটে সেই শিশুদের ছবি জাগিয়া উঠে। তাহার ক্ষুধাতুর মাতৃচিত্ত মনে করে তাহার সেই দুরন্ত শিশু-যুগলই যেন অন্য রূপ ধরিয়া তাহাকে ছলনা করিতে আসিয়াছে। স্নেহ-বুভুক্ষু তরুণী মাতার সমস্ত হৃদয়-মন করুণায় স্নেহে আপ্লুত হইয়া উঠে, ভয় ডর কোথায় চলিয়া যায়, আবিষ্টের মতো সে ঐ সর্প-শিশুদের লইয়া আদর করে, ঘুম পাড়ায়, সস্নেহ তিরস্কার করে। (ন. র. ৪ : ৩৬১)

বিষধর সাপ ও মানুষের এই পারস্পরিক ভালোবাসা, একত্রবাস নিশ্চয়ই স্বাভাবিক বলা যাবে না। কিন্তু সন্তানহারা মায়ের দৃষ্টিকোণ (Point of view) এবং ইতর প্রাণীও যে স্নেহাতুর হতে পারে - বিষয়টি এভাবে বিবেচনা করতে পারলে পদ্ম-গোখরো হয়ে ওঠে এক মহৎ মানবিক চেতনা-উদ্ভূত প্রথম শ্রেণির সাহিত্যকর্ম। সমালোচকের ভাষায়, পদ্ম-গোখরো গল্পটিকে বাহ্যত, অতিপ্রাকৃত বা অবাস্তব মনে হতে পারে কারণ এক সন্তানহারার মাতৃস্নেহ সর্পশিশুদের অবলম্বন করে তার মাতৃত্বের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে এটা বিশ্বাসযোগ্য না-ও হতে পারে। কিন্তু এ গল্পের মৌল আবেগ সন্তানহারা মাতার বেদনা। (রফিকুল ২০১২ : ৮২৪)

তবে সর্পযুগলের প্রতি জোহরার অত্যধিক স্নেহ, সারা বাড়ি জুড়ে - এমনকি তাদের শয্যায় পর্যন্ত সাপ দুটির অবাধ বিচরণ স্বাভাবিকভাবেই আরিফ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ক্রমশ জোহরার সঙ্গে আরিফের এক ধরণের দূরত্বের সৃষ্টি হতে থাকে। তাহার ও তাহার প্রাণের অধিক প্রিয় বধুর মধ্যে এই উদ্যত-ফণা ব্যবধান সে লঙ্ঘন করিতে পারে না। (ন. র. ৪ : ৩৬১) জোহরার শ্বশুর-শাশুড়িও পদ্ম-গোখরোদের জন্য ভীতির মধ্যে থাকেন। অবশ্য আরিফ বা তার পিতা-মাতা যতই ক্ষুব্ধ হন, খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখান না। কিন্তু এক পর্যায়ে কাজের অজুহাতে আরিফ কলকাতায় একপ্রকার পালিয়েই যায় এবং কৌশলে জোহরাকে তার পিত্রালয়ে পাঠানো হয়। আরিফ এবং তার বাবা-মার আশা জোহরাকে দীর্ঘদিন না দেখতে পেয়ে খাদ্য ও স্নেহবঞ্চিত পদ্ম-গোখরোরা অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ভালোবাসা অন্তহীন, শর্তমুক্ত, সময়-নিরপেক্ষ। দীর্ঘদিন পরে জোহরা মীরবাড়িতে ফিরে এলে সাপ দুটি খোকা হয়ে আবার তার পদতলে ঠাঁই নেয় - যেমনিভাবে সন্তানেরা তাদের মায়ের বুকে আশ্রয় পায়। নজরুলকে একটি নিটোল কাহিনীসমৃদ্ধ ছোটগল্পের শিল্পরূপ বিনির্মাণের পুরোপুরি কৃতিত্ব দেওয়া যেত, যদি না জোহরার পিতা-মাতার নাটকীয় অনুপ্রবেশ পদ্ম-গোখরো গল্পে ঘটত। জোহরার পিত্রালয়ে গহনা চুরি, আরিফের হত্যা-প্রচেষ্টা, জোহরার বাবার রাতের অন্ধকারে মীরবাড়িতে আগমণ, লাঠির আঘাতে পদ্ম-গোখরোদ্বয়কে হত্যা এবং সর্পাঘাতে মৃত্যু - এ সবই মনে হয়, মূল কাহিনিকে যথাযথভাবে অনুসরণে সক্ষম হয়নি। সমালোচকের মন্তব্য -জোহরার পিত্রালয়ে ডাকাতির ব্যাপার, তার স্বামীকে বিষপান করানো, এ সকল ঘটনা মূল আখ্যানের পক্ষে অবাস্তব এবং বাদ দিলেও গল্পের কোন ক্ষতি হত না। (মোবাশ্বের ১৯৮১ : ২০২) গল্পের শেষপ্রান্তে দেখা যায়, পিতা-মাতার মৃত্যুর খবর শুনে জোহরা মোটেও দুঃখিত হয় না, কেননা তাদের পূর্বের আচরণ তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু পদ্ম-গোখরোদের মৃত্যু-সংবাদে জোহরা যেন দ্বিতীয়বারের মতো সন্তান হারানোর বেদনা বোধ করে এবং তীব্র মানসিক আঘাতে মারা যায়। গল্পটির শেষাংশ নিম্নরূপ :

- আমার খোকারা কোথায় বল !

আরিফ বলিল, তোমার বাবা তাদের মেরে ফেলেছেন !

জোহরা, এ্যাঁ খোকারা নাই ? বলিয়াই অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

ভোর হইতে না হইতেই গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল, মীর সাহেবদের সোনার বৌ এক জোড়া মরা সর্প প্রসব করিয়া মারা গিয়াছে। (ন. র. ৪ : ৩৭১)

বিষয়ের বৈচিত্র্যে ও ব্যপ্তিতে নজরুল-ছোটগল্পের ক্রমবিকাশের পর্যায়ক্রমটি তাঁর রচনার অনুসন্ধানী পাঠকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। করাচি-পেশোয়ার-মেসোপটেমিয়ার রণাঙ্গন থেকে কলকাতার এলিট সমাজ, গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ - সবই নজরুলের গল্পে শিল্পিত ভাষ্যে রূপায়িত হয়েছে। এর কারণ এই শিল্পী একইসঙ্গে কলকাতার আর্থ-সামাজিক প্রতিপত্তিশালী সংস্কৃতিমনা সমাজে যেমন মিশেছেন, তেমনই গাঢ়ভাবে পরিচিত হয়েছেন গ্রাম-মফস্বলের ধূলিধূসরিত কৃষকসমাজের সঙ্গে, বেড়ে উঠেছেন দরিদ্র নগ্ন বাঙালির মধ্যে। (কৃষ্ণরূপ ২০১৪ : ২৩৮)

গল্পের চরিত্র বিনির্মাণেও নজরুল ধারাবাহিকভাবে পরিণতমনস্ক হয়ে উঠেছেন। বাংলা ছোটগল্পের জগতে বিন্দি, সবুর, আল্লা-রাখা, জোহরার মতো দীপ্র চরিত্র খুব বেশি মিলবে না। বিশেষভাবে নারী চরিত্রসমূহ তাদের স্বতন্ত্র, প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পাঠকের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে।

ভাষা ব্যবহার ও সংলাপ সৃষ্টিতেও নজরুল বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম দিকের রোমান্টিক গল্পের গীতময় ভাষা ক্রমে বিষয় অনুসারে যৌক্তিকভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষভাবে পূর্ববঙ্গের মানুষের মুখের ভাষা; যাকে আমরা আঞ্চলিক ভাষা বলছি; - তাঁর ছোটগল্পে একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে রাঢ় বাংলার ভাষাকেও তিনি তাঁর গল্পে সাবলীলভাবে ব্যবহার করেছেন, অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনকে বিশ্বস্তভাবে রূপায়ণের লক্ষ্যে। কাজী নজরুলের ভাষা-ব্যবহারের দক্ষতা প্রসঙ্গে নজরুল-বিশেষজ্ঞ ডক্টর রফিকুল ইসলামের এই মন্তব্যটি এখানে স্মরণ করতে পারি :

বাংলা কথাসাহিত্যে নজরুলের পূর্বে অপর কোন সাহিত্যিককে উপভাষা ব্যবহারে অমন স্বচ্ছন্দ দেখা যায় না। নজরুল কেবল তার পরিচিত ও জানা চুরুলিয়া অঞ্চলের বাগদীদের মুখের ভাষা ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি, সমাজের নিচের তলার শহর ও গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন মুখের ভাষা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিষ্ট কথ্যভাষা ... সমান নৈপূণ্যে ব্যবহার করেছেন। (রফিকুল ২০১২ : ৮২৩)

১০

এই নিবন্ধ বাংলা ছোটগল্পে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান ও অবস্থান তুলে ধরার একটি সংক্ষিপ্ত প্রয়াস মাত্র। সৈনিক নজরুল কীভাবে গল্পকার তথা সাহিত্যিক নজরুলে ক্রমবিবর্তিত হলেন সেটির অনুসন্ধান করতেও আমরা এখানে সচেষ্ট ছিলাম। ব্যক্তির অন্তর্গত বেদনাবোধ আর সমষ্টির বৃহত্তর জীবনবোধ - দুটিই নজরুলের ছোটগল্পে সমগুরুত্বে বিনির্মিত। সমাজ ও সমকালের রূপদক্ষ শিল্পী কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ছোটগল্পে পরিমাণগত বিবেচনায় না হলেও গুণগত বিচারে চিরায়ু হবেন এমন প্রত্যাশা বোধ করি অসমীচীন হবে না

উল্লেখপঞ্জি

১. অরুণকুমার বসু (২০০০), নজরুল জীবনী, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা

২. আবদুল মান্নান সৈয়দ (২০০৭), কাজী নজরুল ইসলাম : তিন অধ্যায়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

৩. কাজী নজরুল ইসলাম (২০০৬), নজরুল রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

৪. কাজী নজরুল ইসলাম (২০০৯), নজরুল রচনাবলী, নবম খণ্ড, রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

৫. কাজী নজরুল ইসলাম (২০১১), নজরুল রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

৬. কাজী নজরুল ইসলাম (২০১১), নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

৭. কাজী নজরুল ইসলাম (২০১১), নজরুল রচনাবলী, পঞ্চম খণ্ড, রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

৮. কাজী নজরুল ইসলাম (২০১৬), নজরুলের ছোটগল্প সমগ্র, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা

৯. কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী (২০১৪), নজরুলের গল্প, কাজী নজরুল ইসলাম : জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা

১০. মাহবুবুল হক (২০১০), নজরুল তারিখ অভিধান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

১১. মুজাফ্‌ফর আম্মদ (১৯৯৫), কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা

১২. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (১৯৮৩), সমকালে নজরুল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা

১৩. মুহাম্মদ লুৎফুল হক (২০১৩), সৈনিক নজরুল, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

১৪. মুহাম্মদ সিরাজ (১৯৯০), ছোটগল্পকার নজরুল, শিল্পতরু (নজরুল সংখ্যা), ৩য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, আবিদ আজাদ সম্পাদিত, ঢাকা

১৫. মোবাশ্বের আলী, (১৯৮১), নজরুল প্রতিভা, বিভাগীয় ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর পক্ষে), খুলনা

১৬. রফিকুল ইসলাম (২০১২), কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন , নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

১৭. রফিকুল ইসলাম (২০১৩), নজরুল নির্দেশিকা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা

১৮. শেখ দরবার আলম (২০১৬), ‘‘নজরুলের ব্যথার দান এবং তাঁর মানসী’’, নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা, ইকরাম আহমেদ সম্পাদিত, ঢাকা

১৯. শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (২০০৮), কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা

২০. সুশীলকুমার গুপ্ত (২০০৭), নজরুল চরিতমানস, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/মে ২৫,২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর