thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল 24, ৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ৭ শাওয়াল 1445

দলীয় পাট ব্যবসায়ীদের ঋণ সুবিধা দিতে ব্যাংক লুটের নতুন নীতিমালা

২০১৮ জুলাই ১১ ১৭:৩৭:৪২
দলীয় পাট ব্যবসায়ীদের ঋণ সুবিধা দিতে ব্যাংক লুটের নতুন নীতিমালা

বিশেষ প্রতিনিধি, খুলনা থেকে ফিরে : দলীয় পাট ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ সুবিধা দিতে লুটপাটের এক নতুন ঋণ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। মূলত খুলনার দলীয় পাট ব্যবসায়ীদের তদবিরে এই সুবিধা প্রণয়ন করা হলেও সুবিধা পেয়েছেন চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, জামালপুরসহ দেশের সব পাট রফতানিকারক। সোনালী ব্যাংকের পাট খাতের ঋণখেলাপিদের জন্য এই নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এক বছর আগে “কেন ঋণখেলাপি ঘোষনা করা হবে না” এমন চুড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছিল যাদের, তারাই নতুন নীতিমালার ফের ঋণ সুবিধা ভোগ করবেন।

ঋণখেলাপিদের আগের ঋণ আদায় না করে তাদের ঋণ ব্লক (জব্দ) সুবিধা দিয়ে নতুন করে ঋণদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পাট খাতের ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে চার দফা নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রথম নীতিমালায় ব্লক টাকার বিপরীতে সহয়াক জামানত দেবার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ঋণের মাত্র ১০-২০শতাংশ সহায়ক জামানত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যা ব্যাংকিং নিয়ম নীতির পরিপন্থী। ফলে রাষ্ট্রায়াত্ব চার ব্যাংকের পাট রফতানি খাতে বিনিয়োগকৃত প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

সোনালী ব্যাংকের পাট খাতে বিনিয়োগের এক হাজার আটশত কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা এবং জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা রাজনৈতিক তদবিরে ১০ বছরের জন্য ব্লক করে আবার নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশন ( বিজেএ) চেয়ারম্যান শেখ সৈয়দ আলী সংগঠনের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বরাবরে ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে সূত্র নং জেজি/৬৭/২০১৬-২০১৭/ ১৩৬৪ আবেদন করে। এই আবেদনে তারা বারবার কাঁচাপাট বিদেশে রফতানি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পাট রফতানিকারকদের হাল নাগাদ সকল লেজার বকেয়া এবং সকল প্রকার দেনা একটি সুদ বিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তরের অনুরোধ করে। একই সঙ্গে পূর্বক ১০ শতাংশ সহায়ক জামানতের ভিত্তিতে ৫ বছর মেয়াদীসহ ২৫ বছরে পরিশোধ করার সুযোগ দানের অবেদন করে। এই আবেদনে বিগত ১০ বছরে তাদের দেওয়া ব্যাংক সুদের টাকাও ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হয় এবং যাদের নামে মামলা হয়েছে তা প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হয়।

এই আবেদনের পর বিজেএ নেতৃবৃন্দ খুলনা -৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানকে নিয়ে, অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং চারটি রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সাথে দেখা সাক্ষাত ও দেন-দরবার করেন। এই সময় পাট রফতানিকারকদের পক্ষে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন সিরাজুল ইসলাম।

পরে অর্থ মন্ত্রনালয় ঋণের টাকার বিপরীতে সহায়ক জামানতের ৫ বছেরর ব্লক সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি তাদের মনোপুত না হওয়াই আবার পাট রফতানিকারকরা দেন-দরবার শুরু করেন।

পরবর্তীতে আগের নীতিমালা পরিবর্তন করে ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট সোনালী ব্যাংক পত্র নং প্রকা/র্সাবি/সুদ/ সুদ ব্লক পাট ২৩২২ আগের নীতিমালা সংশোধন করে এক বছর মরিটরিয়াম পিরিয়ডসহ (কোন সুদা ধরা হবে না) ৪০ শতাংশ সহায়ক জামানত গ্রহণ করে ১০ বছরের ব্লক সুবিধা দেওয়া হয় । ব্লক সুবিধা গ্রহণকারীরা আবার নতুন জামানত সাপেক্ষ ঋণ নিতে পারবেন।

এই সংশোধিত নীতিমালা ব্যবসায়ীদের মনোপুত না হওয়াই তারা আবার ঊর্ধ্বতন মহলে দেন-দবার শুরু করেন। এই সময় বিভিন্ন মিডিয়ায় এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশিত হলে কিছুদিন বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। তারপর আবারও ব্যবসায়ী মহল রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যেম তদবির করে আগের নীতিমালা পরিবর্তন করাতে সক্ষম হন। এই সময় এই নীতিমালা পরিবর্তনে যেসব ব্যাংক কর্মকর্তারা আপত্তি করে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে বদলী, পদোন্নতি না দেওয়াসহ নানা ভাবে হয়রানি করা হয়।

সর্বশেষ এবছর ৮ ফেব্রুয়ারী সোনালী ব্যাংক জেনারেল এ্যাডভান্সেস ডিভিশন পত্রঝবি /সুদ ব্লক (পাট) ৩৭১ পত্রে আগের সব নীতিমালা বাতিল করে নতুন করে নীতিমালা পত্র দেওয়া হয়। এই নীতিমালায় মরাটিয়াম সুবিধা (সুদ ছাড়া ঋণ) দুই বছর করা হয়। এবং মরাটিয়াম টাইম মঞ্জুরীর তারিখ থেকে দুই বছর ধরা হবে। সকল ব্যবসায়ীর লেজারঋণ যার যা আছে তাই ব্লক ঋণ হিসাবে ধরা হবে। এই নীতিমালার ‘ঙ’ ধারায় বলা হয়েছে ব্লক ঋনের বিপরীতে যে সকল ঋণ গ্রহীতার গুদামের মালমালের ঘাটতি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কোন জামানত গ্রহণের আবশ্যকতা থাকবে না । এবং ৫০ শতাংশের অধিক যাদের ঘাটেতি রয়েছে তাদের ব্লক ঋনের বিপরীতে মাত্র ২০ শতাংশ সহায়ক জামানত প্রদান করতে হবে। এবং রফতানিকারকরা তাদের পাট রফতানি করে বিল হতে ৫ শতাংশ কর্তন করে তাদের কিস্তি পরিশোধ করবেন। এসব ঋণ ব্লক সুবিধা নিতে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে আবেদন করতে হবে। কিন্তু এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণখেলাপিদের অধিকাংশই প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ব্যাংকে আবেদন করেনি। জুন মাস শেষ হয়ে গেলে এই সুবিধা দিতে খুলনার সোনালী ব্যাংক ১১২ জন ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীর মধ্যে মাত্র ২১ জনকে সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রধান কার্যালয়ে কাগজ পত্র পাঠিয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের একজন ডিএমডি নিরাপত্তার স্বার্থে নাম না প্রকাশ করার স্বার্থে জানান পাট ব্যবসায়ীদের এই সুবিধা ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম নীতিমালার পরিপন্থি । তিনি জানান গুদামের পাটের মালিক এবং চাবি থাকে ব্যাংকের হেফাজতে । সে মাল প্রতারণা করে গোপনে বিক্রি করে দিলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আবার সেই টাকার কোন জামানতও নেওয়া হবে না। এ ধরণের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি।

খুলনা থেকে এই তদবির শুরু হলেও এই সুযোগ নারায়ণগঞ্জ, জালামপুরসহ সকল পাট রফতানিকারকদের দেওয়া হয়েছে। অথচ একই অভিযোগে অনেক পাট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে এবং প্রতারণা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে।

অর্থঋণ আদালত ছাড়াও গুদামে পাট না থাকার অভিযোগে দুদক বাদি হয়ে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে আকবার আলী এন্ড সন্স, এস এস ট্রেডার্স, লক্ষন জুট ট্রেড, একে জুট, সোনালী জুটসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া রয়েছেন কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশনের (বিজেএ) দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলে চার রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা। পরে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে চাহিদা বেশি থাকায় এবং দেশীয় বাজারে পাটের দাম মন প্রতি ৩ হাজার টাকায় উন্নীত হওয়ায় হাতে গোনো কয়েকজন ছাড়া সকল পাট রফতানিকারকের ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। একইভাবে পাট রফতানিতে উৎসাহ দিয়ে সরকারি প্রনোদনায় ১০ শতাংশ এফডিআরের বিপরীতে ১০০ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয়। ফলে রাতারাতি খুলনার অনেক ব্যক্তি স্থানীয় পাটব্যবসায়ী থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটরফতানিকারক বনে যান।

বিজেএ’র হিসাব মতে, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে খুলনায় পাট রাফতানিকারক ছিল মাত্র ৮৯ জন। এক বছরের ব্যবধানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২৪ জনে।

একজন প্রবীন পাট ব্যবসায়ী জানান, ওই সময় হঠাৎ করে দৌলতপুর বাজারে নামি-দামি গাড়ির সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। আর এর বড় অংশই রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে ব্রিফকেস ব্যবসায়ীতে পরিণত হন।

সোনালী ব্যাংকের বি এল কলেজ শাখা থেকে মেসার্স অনিক জুট ইন্টারন্যাশনালের স্বত্তাধিকারী এস এম নুরুল হক ২০০৮-০৯ সাল থেকে পাট রফতানিকারক হয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি মোট ৩৫ কোটি ৮২ লাখ ৫১১ ঋণ গ্রহণ করেন। এর বড় অংশই ছিল গুদামে পাট প্লেজ রেখে (গুদামের পাটই জামানত হিসেবে দেখানো হয়। অন্য কোথাও কোন টাকা বা জমি জামানত হিসেবে জমা দেওয়া নেই)।

২০১৭ সালের ১৮ জুলাই আইনজীবী এস এম ওয়াছিউর রহমান ব্যাংকের পক্ষ থেকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। লিগ্যাল নোটিশের শেষ প্যারায় বলা হয়, পাওনা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হবেন।

এই এসএম নূরুল হক ১৯৮৬-৮৮ সালের দিকে খুলনা দৌলতপুর দিবা নৈশ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্যানেলের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাবেক ছাত্রশিবির নেতা ও খুলনা বি এল কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রশিবিরের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত ভিপি শেখ জাকিরুল ইসলামও স্বীকার করেন যে, বর্তমান বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা এসএম নূরুল হক ছাত্রশিবিরের মনোনয়ন নিয়ে দৌলতপুর দিবা নৈশ কলেজের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তবে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর থেকে তিনি দৌলতপুর বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হন। এর সুবাদে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।

এসএম নূরুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পাট বিক্রি বাবদ তিনি আরেক পাট রফতানিকারক শেখ ফেরদৌস আহম্মেদের কাছ থেকে দুটি চেকের মাধ্যমে ৯০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাকে পাট সরবরাহ করেননি। পরে খুলনা মুখ্য মহানগর হাকিমের আমলী আদালত ‘গ’ অঞ্চলে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও ক্ষমতার প্রভাবে তিনি তা ধামা চাপা দিয়ে রাখেন বলে শেখ ফেরদৌস আহমেদ দ্য রিপোর্টের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এসএম নূরুল হক সরকারি দলের প্রভাবে মামলা করার জন্য উল্টো তাকেই হয়রানি করছেন।

এ ব্যাপারে এসএম নূরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ছাত্র শিবিরের মনোনয়ন নিয়ে দৌলতপুর দিবা নৈশ কলেজে ভিপি নির্বাচিত হবার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সেই সময় ছাত্র শিবির নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় ছাত্রদের অগ্রাধিকার দিয়ে মনোনয়ন দিত। তবে তিনি ভিপি ছাড়া আর কোন দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি। ছাত্রজীবন শেষ থেকেই তিনি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

তিনি বলেন, ব্যাংকের ঋণখেলাপির টাকা সরকারের দেওয়া ব্লক সুবিধায় তারা ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ পেয়েছেন। সেই প্রক্রিয়াই আমার হিসাবও বর্তমানে ব্লক হিসাবে রয়েছে।

একই প্রক্রিয়ায় এসএম নুরুল হকের ভাই ও ৬ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি এস এম আব্দুল হকের মালিকানাধীন তিনিটি প্রতিষ্টানের নামে সোনালী ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখা থেকে ৩৯ কোটি টাকা ঋণখেলাপি দেওয়া হয় যা বর্তমানে খেলাপি রয়েছে। সর্বশেষ লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার পরেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।

দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ সৈয়দ আলীর মালিকানাধীন দু’টি প্রতিষ্ঠান রূপালী ব্যাংকের দৌলতপুর কর্পোরেট শাখায় প্রায় ১৯ কোটি টাকা ঋণখেলাপি। বছর খানেক আগে ব্যাংক থেকে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে আগের প্লেজ ঋণের বিপরীতে মাত্র ৫ শতাংশ নতুন মর্টগেজ (বন্ধক) রেখে আবার নতুন করে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সিরাজুল ইসলাম নামে একজন পাট রফতানিকারক ব্যাংকে বসে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি চুয়াডাঙ্গায় বিএনপির এক নম্বর লোক থাকলেও বর্তমানে তিনি খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মুন্নুজান সুফিয়ানের ছোটভাই। সেই হিসাবে তিনিও খুলনায় আওয়ামী লীগের নেতা।

তিনিও একজন পাট রফতানিকারক। সোনালী ব্যাংক খুলনা বিএল কলেজ রোড শাখায় এই সিরাজুল ইসলামের নামে ৪৭ কোটি ৫৯ লাখ ৬৬ হাজার ২৪৩ টাকার ঋণ। যার পুরোটাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। তার ছেলে সাজেদুর রহমানও ২৩ কোটি ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৮ টাকার ঋণখেলাপি।

২০১৭ সালের ১৮ জুলাই আইনজীবী এস এম ওয়াছিউর রহমান ব্যাংকের পক্ষ থেকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। লিগ্যাল নোটিশের শেষ প্যারায় বলা হয়, পাওনা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হবেন। মোট ১১২ জন ব্যবসায়ীকে এই নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।

অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর ৩৪ ও ৩৫ ধারার আলোকে দেওয়ানি মামলায় কারাবাসও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মামলা মোকদ্দমাসহ যাবতীয় খরচাদি, দায় দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।

সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোন অফিসের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোনের ছয় শাখায় ১১৩ জন পাট রফতানিকারকের কাছে ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট পযর্ন্ত মোট এক হাজার আটশত কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি শ্রেণিকৃত বা ঋণখেলাপি। এসব ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে গত অর্থবছরের শুরুতেই চূড়ান্ত নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়। এই মোট এক হাজার আটশত কোটি টাকার ঋণের মধ্যে এক হাজার একশত কোটি টাকা ছিল প্লেজ ঋণ, যার বিপরীতে গুদামে পাট ছাড়া আর কোন জামানত ছিল না। প্লেজ ঋণের গুদামের পাটকেই জামানত হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এসব গুদাম সরেজমিনে পরিদশর্ন করা হয়। অধিকাংশ গুদামেই কোন পাট পাওয়া যায়নি।

একইভাবে পাট রফতানির পূর্বে কোন জামানত ছাড়া স্বল্প সুদে যে ‘পিসিসি’ (প্যাকেজ ক্যাস ক্রেডেট যা শুধু রফতানির আদেশ ব্যাংকে আসলে তার বিপরীতে স্বল্প সুদে দেওয়া হয়) ঋণ দেওয়া হয় তার পরিমানও ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ভুয়া এলসি দেখিয়ে ঋণ এবং গুদামে পাট না থাকলেও খাতা-পত্রে পাট দেখিয়ে ঋণ গ্রহণ ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

সোনালী ব্যাংকের এইরুপ প্লেজ ঋণ গ্রহণ করলেও গুদামে পাট না থাকায় দুর্নীতি দমন কমিশন ৮ থেকে ১০ জন গ্রাহকের নামে মামলা করেছেন। অর্থঋণ আদালত ছাড়াও গুদামে পাট না থাকার দুদক বাদী হয়ে মামলা করেছে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ তার মধ্যে অন্যতম, আকবার আলী এন্ড সন্স, এস এস ট্রেডার্স, লক্ষন জুট ট্রেড, একে জুট, সোনালী জুটসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে সোনালী জুটের দুদকের আসামির তালিকায় রয়েছে সাবেক ব্যাংক জিএম নেপাল চন্দ্র সাহা, ডিজিএম সমীর কুমার দেবনাথসহ কয়েকজন কর্মকর্তা।

এসব মামলায় ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়েছে। অথচ একই অপরাধে জড়িত রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং তাদের আগের টাকা ব্লক করে নতুন করে আবার ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এই লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার কারণে এবং সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের দেওয়া সুবিধার বিরোধীতা করায় সেই সময়কার সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার মোশারেফ হোসেনকে অপসরনের জন্য খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান ডিও লেটার দিয়েছিলেন। যার নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম ।

এ ব্যাপারে পাট ব্যবসায়ীদের পক্ষে সিরাজুল ইসলাম দাবি করেন, সরকারি সিদ্ধান্ত না মানা এবং প্রধান কার্যালয়ের দেওয়া সুবিধার বিরোধীতা করা তৎকালিন জেনারেল ম্যানেজার মোশারেফ হোসেন ছিলেন জামাত-শিবিরের লোক। তাই তার বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য ডিও লেটার দিয়েছিলেন।

সিরাজুল ইসলাম আরও দাবি করেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য মুন্নুজান সুফিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে তারা অর্থ মন্ত্রনালয় এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন মহলে তদবির করে এই ব্লক সুবিধা এনেছেন। এজন্য ব্যাংকের উপর মহলে কিছু অর্থ খরচ হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য পাট ব্যবসায়ীদের রক্ষার জন্য কোন সুবিধা না নিয়েই এই তদবির করেছেন।

তিনি জানান, পাট ব্যবসায়ী আর সংসদ সদস্যদের মধ্যে লিঁয়াজোর কাজ তিনি নিজে করেছেন। বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশনের দাবি অনুযায়ী তাদের পক্ষে সার্কুলার আনতে তারা একাধিক বৈঠক করেন। মোট চার দফায় সার্কুলার পরিবর্তন করে সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি নতুন নীতিমালা প্রণয়নে সক্ষম হয়েছেন।

সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার আমির হোসেন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে সোনালী ব্যাংক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোলাম নবী মল্লিক ও জেনারেল ম্যানেজার মো: আব্দুল গফুর স্বাক্ষরিত গত ৮ ফেব্রুয়ারির চিঠি ইস্যু করা হয়। চিঠিতে কাঁচাপাট রফতানি কারক ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।

ওই সুবিধার আওতায় ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত যারা ঋণ গ্রহিতা তাদের একাউন্টের বা হিসাবের স্থিতি নিরুপন করা হয়। এসব হিসাবধারীদের কস্ট অব ফান্ড হারে সুদ আরোপ করে দুই বছরের মরাটরিয়াম সুবিধা দেওয়া হয়। এই ঋণ ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য করে ব্লক হিসাবে স্থানান্তর করার নিয়ম করা হয়। একই সঙ্গে ঋণ গ্রহীতার চাহিদা এবং ব্যাংকের গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নতুন ঋণ প্রদানের বিধান রাখা হয। ওই চিঠির এসব নিয়মের কারণেই ঋণখেলাপির জন্য চূড়ান্ত নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হলেও তা কার্ষকর হয়নি।

প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো তিন পাতার ওই চিঠিতে নয় দফা নীতিমালা করা হয়েছে। তার ২ দফায় রয়েছে এই সুবিধা গ্রহণের জন্য চলতি বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে আবেদন করতে হবে। ১ এপ্রিল হতে ব্লক সুবিধা কার্যকর হওয়ার তারিখ পর্যন্ত নিয়মিত হিসাবে আরোপিত সুদ ‘সুদ হিসাবে’ এবং শ্রেণিকৃত ঋণহিসাবে আরোপিত সুদ ‘সুদ রির্জাভ’ হিসাবে স্থানান্তর হবে। ওই সুদসহ হালনাগাদ লেজার বকেয়া ব্লক হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে এবং দুই বছর মরাটরিয়াম পিরিয়ড ( কোন ঋণ মঞ্জুরের তারিখ থেকে সুদ বা কিস্তি পরিশোধ ছাড়া যে মেয়াদ তাকে মরাটরিয়াম পিরিয়ড বলে) সুবিধা ভোগ করবে।

জেনারেল ম্যানেজার আমির হোসেন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাকিংক প্রবিধি ও নীতি বিভাগ প্রথমে চলতি বছরের ২ মে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পাট খাতের ঋণ নিয়ে একটি পূর্নাঙ্গ নীতিমালা অনুমোদন করা হয় ।

এই নীতিমালায়‘ ঙ’ ধারায় বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে ব্লক ঋণসমুহের বিপরীতে যে জামানত রয়েছে, তা নতুন সৃষ্ট ব্লক ঋনের বিপরীতে বহাল থাকবে। বিদ্যমান সিসি প্লেজ ও সিসি (হাইপো) ঋণের হালনাগাদ লেজার বকেয়া ব্লককরণের বিপরীতে যে সকল ঋণগ্রহীতার গুদামে মালামালের ঘাটতি ৫০ শতাংশ পযর্ন্ত রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কোন জামানত গ্রহণের আবশ্যকতা থাকবে না। অথাৎ পূর্বে ব্যাংকের হেফাজতে থাকা গুদামের পাট বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আবার এই টাকার জন্য কোন জামানতও দিতে হবে না । ব্লক ঋণ পরিশোধের বিষয় বলা হয়েছে মরাটরিয়াম পিরিয়ডের পর (প্রথম দুই বছর পর) প্রতি রফতানি বিল/বিক্রয় বিল হতে বিল মুল্যের ৫% নিয়মিত কর্তনপূর্বক ব্লক হিসাবে জমা করতে হবে।

এই নীতিমালায় যে সকল ঋণগ্রহীতা গত ৩১ মার্চে মধ্যে আবেদন করেছেন সেসব ঋণ গ্রহীতার অনুকুলে ব্লক ঋণ সুবিধা প্রদান এবং ঋণ নবায়ন মঞ্জুরীর বিষয় কেস টু কেস ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খুলনা সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপি ১১২ জনের বেশির ভাগই আবেদন করেননি। একই ভাবে ব্যাংকও তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপও নেয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনার প্রবীন পাট রফতানিকারক এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ব্যাংকের জামানত ছাড়া এই ভাবে কোটি কোটি টাকা ব্লক ঋণ সুবিধা নজির বিহীন ঘটনা। আবার এই ব্লক ঋণ দুই বছর কোন সুদ বা কিস্তি পরিশোধ ছাড়াই দশ বছরের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে পাট রফতানি থেকে প্রাপ্ত বিল থেকে ৫ শতাংশ কেটে রেখে ব্লক ঋণ পরিশোধের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাতে এই চার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ হতে দুইশত বছর লেগে যাবে। আবার যাদের গুদামে কোন পাটই নাই সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।

এ বিষয়টিকে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকের অর্থ লুটপাট বলে আখ্যা দেন এই প্রবীন পাট রফতানিকারক।

তিনি আরও বলেন, প্লেজ গুদামের পাট না থাকায় ইতিপূর্বে দুদক খুলনার একাধিক পাট রফতানি কারকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ফলে কিছু ব্যবসায়ীকে মামলা ও জেল দেওয়া এবং অন্যদের ঋণ ব্লক করে নতুন ঋণ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি। একই অপরাধে এক দেশে দুই ধরনের বিচার থাকতে পারে না।

(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/এনটি/ ১১ জুলাই, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর