thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

তদন্তে কয়লার ঘাটতি পেয়েছে দুদক

২০১৮ জুলাই ২৩ ২০:১৬:৩২
তদন্তে কয়লার ঘাটতি পেয়েছে দুদক

দিনাজপুর প্রতিনিধি: দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা।

সোমবার (২৩ জুলাই) বিকেলে খনিতে প্রবেশ করে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং কোল ইয়ার্ড এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তারা। দুদক কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, খনির অনিয়মের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে তদন্ত কার্যক্রম শেষে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এখন অভিযোগ করছেন, বিভিন্ন উপায়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন কয়লা খনির কর্মকর্তারা।

কয়লার অভাবে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে তেমন বড় কোনও সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

হঠাৎ করে দেশের একমাত্র কয়লা খনি বড়পুকুরিয়ায় ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা তদন্ত করতে সোমবার দুপুর পৌনে ৩টার দিকে দুদকের পাঁচ সদস্যের দল খনি এলাকা পরিদর্শনে আসেন। দুদকের কর্মকর্তারা কয়লা খনিতে প্রবেশ করে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও কোল ইয়ার্ড এলাকা পরিদর্শন করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসেন। এ সময় সাংবাদিকদের তারা বলেন, ‘কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।’

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, ‘আমরা কয়লা খনির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, খনির কোল ইয়ার্ডে ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন কয়লা মজুদ থাকার কথা। কিন্তু কোল ইয়ার্ডে রয়েছে মাত্র ২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। বাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কোনও হদিস নেই। বিপুল পরিমাণ কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ায় এখানে প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির আলমত পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই আমরা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় দুদক অফিসে জানিয়েছি। খনির কয়লা গায়েবের ঘটনায় ইতোমধ্যে দুই জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত, এমডিকে অপসারণ এবং এক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় দুদক অফিসের কর্মকর্তারা কথা বলবেন।’ তিনি আরও জানান, সম্পূর্ণ তদন্ত শেষ করতে ৬০ দিন সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় দুদক অফিসের তদন্ত শেষেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে খনির কোল ইয়ার্ড থেকে কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় কয়লা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, কয়লা বিক্রিতে অনিয়ম ও কয়লা চুরি এই খনিতে নিয়মে পরিনত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বেশ কিছু কর্মকর্তা টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। স্থানীয় কয়লা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালে খনি থেকে ৩০০ টন কয়লা চুরি হয়েছিল। পরে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে খনির কর্মকর্তারা রাতারাতি সেই ৩’শ টন কয়লার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে সমন্বয় করে। এই ধরনের অনেক চুরিই হয়ে থাকে। কিন্তু সুকৌশলে তারা বেরিয়ে গেছে। বড় অংকের কয়লা চুরি হওয়ায় এবং কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকায় বিষয়টি ধরা পড়েছে।’

কয়লা ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘যে পরিমাণে কয়লা খনি থেকে বিক্রি হয়, কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তার বেশি পরিমাণ কয়লা দিয়ে দেওয়া হয়। ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত কয়লা বিক্রি করে আসছে কিছু কর্মকর্তা।’

এদিকে কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের একমাত্র কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। রবিবার রাত ১০টা থেকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিডে বন্ধ রয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ।

বড়পুকুরিয়া কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাকিম সরকার কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় কয়লা না পাওয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। তবে কয়লা উৎপাদন বন্ধের ফলে উত্তরাঞ্চলে কোনও বিদ্যুৎ ঘাটতি হবে না। জাতীয় গ্রিড থেকে বিকল্প উপায়ে এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে অন্য স্থান থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে এসে সরবরাহ করলেও লো ভোল্টেজের একটি সমস্যা থাকতে পারে। এছাড়া বড় ধরনের সমস্যা হবে না।’

কয়লা খনি সূত্রে জানা গেছে, একটি ফেস থেকে নতুন ফেসে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরের জন্য গত ১৬ জুন থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পুনরায় কয়লা উত্তোলন শুরু হবে আগামী আগস্ট মাসের শেষের দিকে। এই সময়ের মধ্যে পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া কয়লা ভিত্তিক ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার মজুদ রয়েছে বলে গত ২০ জুন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবিকে নিশ্চিত করে খনি কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, গত ২০ জুন খনি কর্তৃপক্ষ পিডিবিকে নিশ্চিত করে খনির কোল ইয়ার্ডে ১ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা মজুদ রয়েছে। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষ গত ৪/৫ দিন আগে পিডিবিকে জানিয়ে দেয়, খনির কোল ইয়ার্ডে কয়লার মজুদ শেষ পর্যায়ে। খনির কোল ইয়ার্ডে বর্তমানে দেড় লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ থাকার কথা থাকলেও ৭ থেকে ৮ হাজার টন কয়লা। বাকি ১ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কোনও হদিস নেই। দুদক সোমবার জানায়, উধাও হওয়া কয়লার পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার টন।

এই ঘটনায় খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর) খালেদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদকে অপসারণ করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দফতরে সংযুক্ত করা হয় এবং মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও কোম্পানী সচিব) আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড সিরাজগঞ্জে তাৎক্ষনিক বদলি করা হয়। বড়পুকুরিয়া খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার পরিচালক আইয়ুব খানকে। ঘটনায় গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের সদ্য অপসারণ হওয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দীন আহমদ জানান, যে পরিমাণ কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না তা সিস্টেম লস। তিনি দাবি করেন, গত ১১ বছরে এক কোটি ১০ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় শতাংশ হিসেবে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন কয়লা সিস্টেম লস। রোদ্রে পুড়ে, বাতাসে উড়ে, পানিতে ভিজে, মাটিতে মিশে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এই সিস্টেম লস হয়ে থাকে। এখনও অনেক কয়লা রয়েছে যা মাটিযুক্ত। এর আগে কোল ইয়ার্ড কখনই খালি না হওয়ায় তারা এই সিস্টেম লস আগে বুঝতে পারেননি। আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে এই লসের পরিমাণ ৫ শতাংশ পর্যন্ত বলে জানান তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/জুলাই ২৩, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর