thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

পাবলো শাহি’র গল্প

একখণ্ড কাহিনী

২০১৪ মার্চ ০৮ ০০:১২:৩০
একখণ্ড কাহিনী

আপাতত দৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও আমার স্ত্রীর চরিত্রে বৈপরীত্য, মতানৈক্য, পরিবর্তনশীলতা ও ধারাবাহিকতা প্রভৃতি গুণের সমন্বয় ঘটেছে দেখে-- এটা মেনে নেই আমি। স্ত্রী হিশাবে সে এক-রকম হলেও মা হিশাবে তুলনাহীন। এক অঙ্কবাচক কর্মতৎপরতা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে, তবে তার শুভ কর্মোদ্যোগ পরিবারের লোকজনের বোধগম্য হয় না? ফলে, আমার স্ত্রী’র সমস্যা হয় এর ভেতর ও বাইরের জীবনের সমন্বয় ঘটাতে। তার আবেগ একটু বেশী, সময়ে সময়ে তা পরিবর্তিত। নোতুন কাজ মানে সৃজনশীলতা ও অন্যের জন্য উদ্বেগ তার স্বভাবজাত। সঙ্গত কারণে অদ্ভুত ভাবনায় তার স্বস্তি ও নিরাপত্তা আমাকে চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। আমি, পুত্র ও কন্যা দিয়ে তিনি সব সময় দুর্দশাগ্রস্ত। অথচ আমরা সবাই তার অবাধ্য। হয়তো এই কারণে তিনি ঝগড়াটে হয়ে উঠছেন। কখনো কখনো ধৈর্য সহকারে এই বিপরীত স্রোতকে তিনি মোকাবেলা করেন, তার বক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা সহানুভূতি ও সৃজনীশক্তি চারপাশের জগৎকে মুঠোয় ভরে আনেন তিনি।

আমার সম্পর্কে তার ধারণা আমি খুব নাটকে। স্বার্থপর, যৌন সম্পর্কে সক্রিয় ও উত্তেজক এবং ভাব প্রকাশে চমৎকার। তবে আমি যে অনুগত প্রকৃতির মানুষ তা তিনি বিশ্বাস করলেও মুখে খুলে বলতে নারাজ। বন্ধু হিশাবে আমি অসাধারণ এবং অফুরান। আশাবাদী মানুষ হলেও ইদানীং গোদেম ও রুবি’র আংটি বিশ্বাস নিয়ে তিনি আমাকে নিরাশাবাদীদের দলে ফেলেছেন, তবে আমি যে নৈরাজ্যবাদী নই-- তা আমার প্রাণোচ্ছ্বল, কর্তৃত্বপরাণ গোঁফজোড়া তার প্রমাণ। তবে তার ধারণা আমি দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাই।

ইদানীং তার স্বপ্নজগৎ নিযে তিনি ভাবিত। সাপ ও ঈগল নিয়ে তার ভয়। আমাদের ঘরে বাসকরা মেয়ের পোষা চামচিকাটা যখন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে তখন তিনি ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন। তার বক্ষ ও পাকস্থলী আর আমার হৃদপিণ্ড ও পৃষ্ঠাদেশ নিয়ে ভাবিত আমরা। প্রেমের ক্ষেত্রে আমার স্ত্রী কল্পনা বিলাসী। প্রেম নিয়ে এক ঘন চা কাপের মতো ধুয়া উড়িয়ে তিনি রহস্য রচনা করেন। আর আমি উজাড় করে ভাবতে চাই এই বিষয়ে।

স্বপ্নে ইদানীং আমি গোবরে পোকা দেখি, আমর স্ত্রী দেখেন মোরগের ডাক। আর স্বপ্নে তিনি গীর্জা দেখালে আমি দেখি ঝর্ণা। যদিও আমার স্ত্রী বলেন পুরুষরা তরোয়ার বা বন্দুকের মতো আর আমি বলি নারীরা বেড়াল ও আয়নার মতো তবু আমরা স্বপ্নে ‘বন্দুক’ ও ‘বেড়ালছানা’ এ দু’টি বিষয়ে সতর্কভাবে এড়িয়ে যাই।

আমার স্ত্রীর চুল ঢেউ খেলানো, আবেগ-প্রবণ; কষ্ট পেতে ভালোবাসেন তিনি-- অনেকটা কবি প্রকৃতির। এইসব কথা-বার্তার মধ্যদিয়ে চরিত্রের রেটিনা পর্যবেক্ষণ করে হয়তো পাঠক আমাদের ভেতরের মানুষটাকে সন্ধান পেতে পারেন। ১৭ই এপ্রিল জন্ম হওয়াই আমার স্ত্রী অনেকটা ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির ও অহঙ্কারী প্রেমিকা। তার জন্মগত আর এক স্বভাব আছে স্নায়ুচাপে ভোগা। তার ইন্দ্রিয় বড় প্রখর।

আর আমি শিল্প-সাহিত্য নিয়ে বিচরণ করি।

আমার স্ত্রীর ভাগ্যাকাশে চন্দ্র উদিত সব-সময়। তার মন স্পর্শকাতর ও খুঁত খুঁতে-- প্রেমের ব্যাপারে তিনি এই অভ্যাসের রাস টানতে অক্ষম।

অনেক সময় তার মেজাজ-মর্জির স্থূল আচরণ আমাদের ব্যথিত করে। আমার স্ত্রী ঘর গোছাতে, শিশুকে আদর করতে এবং আপ্যায়ন করতে পছন্দ করেন। তিনি নিজে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটান-- ফলে অন্যের সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, উৎসাহ ও ভালোবাসা প্রার্থনা করেন। অতিরিক্ত মিষ্টি খান-- এই খাদ্যাভ্যাস-ই তাকে মোটা করে তুলেছে। তাকে বলি, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও দুশ্চিন্তা করো না। তবে আমি তার শান্ত কণ্ঠস্বর, মোলায়েম আবেগী চোখের ভাষায় মজে থাকি। আমি সব-সময় তার সুনিদ্রা কামনা করি।

আমার ভাগ্যাকাশে সূর্য উদিত। আমার স্ত্রীর ভাষায় আমার চোখের ভাষা নির্ভীক কর্তৃত্ব প্রত্যাশী ও উষ্ণ। এইসব কাহিনী নিয়ে ব্যস্ত থাকি, আমি আর আমার স্ত্রী, সেখানে ছুটে যাই যেখানে সবকিছু ঘটে। আমি যশোরের রাস্তায় কিংবা ঢাকার শ্যামলী, আদাবর, শাহবাগ, কাঁটাবন হেটে বেড়াই। আর থেমে থাকি হয়তো যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজীমউদ্দীন খান বলেন ‘টিকফা’ চুক্তিতে জনমানুষের স্বার্থ রক্ষা হয় না, মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার-- কাজেই দেশের বাণিজ্যস্বার্থ সংক্রান্ত রক্ষণশীল অবস্থানের কোনো নৈতিক ভিত্তি আর থাকে না।

কেমন আছে এইসব ভাঙনের ঘরবাড়ি। ডাকযোগে আমার কাছে পৌঁছায় পাগলের সন্ধ্যা-সকাল। শিক্ষাবিদদের ভোটপত্র আর রাশিচক্র, মানুষের চন্দ্রগমনের কাহিনী। যেন ইঁদুরের পথ ধরে জীবন থেকে পালাই। আমার কাছে মানুষের সাথে সম্পর্কটা যতটা মধুর, যতটা ততটাই বিরূপ ও প্রতিকূলও মনে হয়। জীবন থেকে পালালে মাটি পাথর হয়ে ওঠে, আমিও আমার স্ত্রীর খামখেয়ালী মাফিক উষ্ণতায় পালিয়ে বাঁচি। আমাকে যে তার মধ্যে বাঁচতে হবে সে-কথা সাহিত্যই আমাকে শিখিয়েছে। অথচ সে যখন একলা বসে ভাবে, আমি তখন তাকে কম চিনতে পারি?

সে বলে-- ‘পাবলো, আমাদের জীবন কি বিস্মরণের সম্পত্তি, নাকি আমাদের পাগুলো লুকিয়ে রাখার কোন রাস্তা আমাদের জানা নেই।’

আমি বলি-- ‘এই নৈরাজ্য ভাবনায় জীবন দূরে চলে যাচ্ছে, বরং কাঁধে সময় নিয়ে নদীতে চলো মাছের নামতা বলি।’

সে বলে-- ‘রানা প্লাজা থেকে আমাদের পাড়ায় ঢুকেছে অদ্ভুত এক মৃত্যুগন্ধ।’

আমি বলি-- ‘আমাদের মাথা খনন করলে এ রকম অনেক স্মৃতি বেরিয়ে আসবে।’

সে বলে-- ‘পোপ বলেছেন, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা ক্রীতদাসেরও অধম।’

আমি বলি-- ‘মার্কিনীদের হাতে সমুদ্র দখল হতে এ রকম আরো সাত শ কবর আমাদের নির্মাণ করতে হবে।’

এভাবে জগতের উপর কত ঘৃণা নিয়ে আমার স্ত্রী মৃত্যুর গল্পটা লিখতে বলেন।

তিনি বলেন-- ‘পাবলো, আমাদের সবচোখ তো বেড়ালেল চোখ। আমাদের সব হাত তো আতাগাছের হাত। ১৯৪৮-এর ১৫ই আগস্ট থেকে আমরা সব হারিয়েছি।’

আমি বলি-- ‘হ্যা, সেই দিন থেকে ধ্বংসের অক্ষরেখায় আমরা ঝুলে আছি।’

তারপর দু’জনা বিড়বিড় করে বলি।

‘অনেক দিন আগে এই বাংলায় যারা যারা নোঙর ফেলেছিল। আর আমাদের মুখে এটে দিয়েছিল কুলুপ। তারা সবাই ছিল ফরসা চামড়ার লোক। ’

তারপর থেকে এখনও আমি গল্প লিখে উঠতে পারিনি। হয়তো কোন একদিন গল্প লিখব। আপাতত দু’জন মিলে একটা প্রজাপ্রতি ধরি। তার ডানা ছিঁড়ে সেলাই করি রঙিন ফতুয়া’র মতো, আর তাকে প্যাকেজিং করি। খামের উপরে লিখি পররাষ্টমন্ত্রী সমীপেষু আর চিঠি ফেলে আসি ডাকবাক্সে।

১৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২০

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর