thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বঙ্গবন্ধু : ছাত্রনেতা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

২০১৯ জানুয়ারি ১০ ০০:২৫:৪৯
বঙ্গবন্ধু : ছাত্রনেতা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

শহিদুল ইসলাম সাইফ

বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সূর্যোদয় হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কিন্তু ঘোর আঁধার ঠেলে তখনো আলোকের পথে অভিযাত্রা তখনো শুরু হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন একটি অরুণরাঙা মুখ বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিকে প্রফুল্ল করে তুললো তখন শুরু হলো আলোকের অগ্রযাত্রা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিরোচিত প্রত্যাবর্তন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ। বিশ্বনেতৃত্বের অমর নাম, ইতিহাসের মহানায়ক, রাজনীতির সিংহপুরুষ, স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহান শিক্ষক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মূলত এক সম্মোহনী শক্তির অধিকারী মানুষ ছিলেন। বাঙালির অধিকারের জন্য, পাকিস্তানি শোষণের যাঁতাকল থেকে মুক্তির জন্য বাঙালি জাতিকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক মন্ত্রে সম্মোহিত করেছিলেন।

পেছনে তাকালে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার সত্য উন্মোচিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তারুণ্যে ভরপুর এক উদ্যমী যুবক। আর তারুণ্য এমন এক শক্তি, যার বিরুদ্ধে কখনো-কোনো অপশক্তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। এই তেজোদ্বীপ্ত শক্তিতে বলীয়ান হতে, পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজকে এক ভীতের উপর দাঁড় করাতে উনি গঠন করেন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। তিনি তাঁর শাণিত দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেন, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি ভাষাগত, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত বৈষম্য ও চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত বাঙালিকে দিনে-দিনে পঙ্গু করে দিচ্ছে। আরো উপলব্ধি করেন, বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের একটাই পথ, তা হচ্ছে- প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রাম। তখন থেকেই গ্রেফতার আর কারাবরণ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী । ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর ছয়দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্ব পার করে ৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি বুঝতে পারেন বাঙালি জাতির মুক্তির যে স্বপ্ন হৃদয়ের গভীরে তিনি লালন করে চলেছেন তা অর্জনের জন্য চূড়ান্ত প্রতিবাদ ছাড়া গত্যন্তর নেই, আর তার নাম ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্ন দেখেন সহজাতভাবে এবং তিলে তিলে গড়ে তোলা নেতৃত্ব গুণে। মুক্তির সেই প্রবল স্বপ্নকে তরঙ্গায়িত করে আপামর জনসাধারণের মধ্যে এক বিরাট আকুলতায় পরিণত করেন। ততোদিনে তিনি হয়ে উঠেন বাংলা ও বাঙালির আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক, মুক্তিকামী বাঙালির শেষ অবলম্বন। সাড়ে-সাত কোটি মানুষ এক তর্জনীর সুরে, দুর্লভ তেজোদীপ্ত কাঠিন্য, সংগ্রামী শপথের দীপ্তির এক অপূর্ব মিথস্ক্রিয়ার ঐকতানের মন্ত্রে দীক্ষিত হলো। ২৫ মার্চ ১৯৭১, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কিন্তু তার আগেই তিনি ঘোষণা করলেন, -“এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন”।

স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষ্যে শুরু হয় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, সিপাহি, বিভিন্ন পেশাজীবীর সমন্বয়ে এক প্রতিরোধ ও সশস্ত্র সংগ্রাম। যে আঘাতে নাজেহাল হয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দী থাকলেও তাঁর পূর্ববর্তী নির্দেশনা ও মজলুম জনতার পাশে থাকার যে আজন্ম আদর্শের চেতনা, সে চেতনাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি পায় বাংলার মুক্তিকামী জনতা। অবশেষে বীরের জাতি বাঙালির কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং বাঙালি পায় কাঙ্ক্ষিত জয়।কারান্তরীন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সময় কাটাতে থাকেন। তাঁর মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য নানা মানসিক চাপ দিতে থাকে পাকিস্তানি ঘাতকরা। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসির আদেশ কিংবা মৃত্যুভয় তাঁর অসীম সাহসিকতা ও হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজিত হয়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলার মুক্তি, বাঙালির মুক্তি। পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও স্বাধীকারের বিষয়ে অটল ছিলেন তিনি।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ শহীদের রক্তে, মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে রক্তস্নাত বিজয়কে বাঙালির কাছে পূর্ণ বিজয় মনে হয়নি। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখনো স্বদেশে অনুপস্থিত! এই বিজয়ের আনন্দ কোনভাবেই পূর্ণতা পায়না। যে মহান ব্যক্তির অঙ্গুলি-হেলনে সাড়ে-সাত কোটি বাঙালি উদ্বেলিত হয়ে আমরণ শত্রুর সামনে দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনলো, সেই বঙ্গবন্ধু ছাড়া মুক্তির আনন্দ পূর্ণ পায় না। বাঙালি তাঁকে ফিরে পেয়েই বিজয়ের পূর্ণ-স্বাদ গ্রহণ করতে চায় এবং এ জন্যই উতলা হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে বাঙালিরপ্রত্যাশার দিন শেষ হলো। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু পকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে যান। সেখানে কোনো দেশের রাষ্ট্রপতির আনুষ্ঠানিক কোন সফর না হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মি. এডওয়ার্ড হিথ -এর কাছে থেকে পেলেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। সেখান থেকে ভারতে এলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে লালগালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়।১০ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সদ্য অর্জিত বিজয়ের পূর্ণতা উদযাপনে লক্ষ-লক্ষ উৎসুক মানুষ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর মানুষেরকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হলো। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বক্তৃতায় তিনি বলেন, -“ফাসি মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা”। বাঙালি ও বাংলাদেশকে যে বিজয়ের স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন, তা অর্জনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, অন্ধকার কারাগারের প্রকোষ্ঠ থেকে বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য অপেক্ষা করেছেন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে পূর্ণতা দিয়ে সাড়ে-সাত কোটি বাঙালির আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির যোগফল এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন।

যে তারুণ্য-শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন সেই একই তারুণ্যদীপ্ত নের্তৃত্ব স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এসেও বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন।আজ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পেছনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, যা বাঙালি জাতির অন্তরে গ্রোথিত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ হিসেবে।

লেখক : রাজনীতিক

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জানুয়ারি ১০,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর