thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ 24, ৫ চৈত্র ১৪৩০,  ৯ রমজান 1445

শত শত গ্রাহক সংশয়ে হতাশায়

বাগেরহাটের উমেদার মান্নান কি বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন ?

২০১৯ জানুয়ারি ১৬ ০৮:৪০:৪২
বাগেরহাটের উমেদার মান্নান কি বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন ?

খুলনা ব্যুরো : উমেদার মান্নান কি বিদেশ পালিয়ে গেছে ? প্রশ্নটা এখন চাউর হয়েছে গোটা বাগেরহাট-খুলনা এলাকায়।

তার কাছে বহু মানুষের আমানত রয়েছে। এসব আমানত আদৌ গ্রাহকরা ফেরত পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আরো ঘনীভূত হয়েছে।

আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এই মানুষটির ব্যাপারে অবশ্য তার অফিসের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করছেন তিনি বিদেশ যান নি, দেশেই আছেন। তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অফিস চালাচ্ছেন।

এদিকে উমেদার মান্নানের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন মিডিয়াই বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লি. কর্তৃক উচ্চহারে মুনাফা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহের খবর প্রকাশের পর থেকে আমানত সংগ্রহ ভাটা পড়ে । এই কারণে প্রতি মাসের দেয়া লাভ্যাংশ প্রদান বিঘ্নিত হয়। গত ২/৩ মাসে থেকে এই অফিস থেকে কোন আমানতকারী লাভ্যাংশ/ অগ্রিম বা আমানত ফেরত প্রদান বন্ধ ছিল। প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক লোক- খুলনা- বাগেরহাট অফিসে এসে আমানত ফেরত পাবার জন্য ধর্না দিচ্ছিলেন ।

এই অবস্থার মধ্যে গত ২০-২২ ডিসেম্বর আমানত রাখা গ্রাহকরা খবর পায় আব্দুল মান্নান তালুকদার দুই কোটি টাকার জমি বিক্রি করেছেন। শত শত গ্রাহক এ খবর শুনে ২৪ ডিসেম্বর বাগেরহাট অফিসে এসে ভীড় জমায় । এই সময় উত্তেজিত গ্রাহকরা মান্নন তালুকদারে অফিসের বাইরে থাকা, কয়েকটি গাড়ি, জেনারেটর , সিসি ক্যামেরা যে যা পেয়েছে তা খুলে নিয়ে যায় ।

এই ঘটনার আগেই আব্দুল মান্নান তালুকদার স্ত্রী, তিন সন্তান নিয়ে বাগেরহাট ছেড়ে গেছেন। এবং বাগেরহাট ও খুলনা অফিসে নোটিশ টানিয়ে দেয়া হয় যে, বড় দিন, জাতীয় নির্বাচন,ইংরাজী নববর্ষের কারণে নয়দিন অফিসের কার্যক্রম ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারী পযর্ন্ত বন্ধ থাকবে । এবং ৫ জানুয়ারী ২০১৯ থেকে অফিস চালু হবে । বসুন্ধারা অফিসে হামলা, গাড়ী লুঠ পাটের খবরের বিষয় বাগেরহাট পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, কোন আমানতকারী তাদের কাছে কোন অভিযোগ দেননি, আর মান্নান পালিয়েছে বা হামলার কোন ঘটনা পুলিশ জানে না ।

তবে নিউ বসুন্ধধারা রিয়েল এস্টেট নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসমাইল মৃধা জানান ২৪ ডিসেম্বর গ্রাহকরা তাদের এমডি মান্নান তালুকদারের অফিস/ বাসভবনে হামলা করে ভাংচুর চালায়। হামলা কারীরা সিসি ক্যামেরা, জেনারেটর সহ বেশ কিছু সামগ্রি নিয়ে গেছে । তিনি জানান পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছিল, কিন্তু তারা কোন জিডি বা মামলা করেনি। বলেন খোয়া যাওয়া পন্যর তালিকা করা হচ্ছে । তিনি জোর দিয়ে বলেন পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছেন। তিনি আরো জানান মান্নান তালুকদার ঢাকায় আছেন এ মাসের শেষ দিকে ফিরে আসবেন।

গত ৭জানুয়ারি সোমবার বাগেরহাটে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সবকিছু বন্ধ দেখা যায়। দুই লোকের সাথে দেখা হয়, তারা জানান, তারা রাতের বেলায় অফিসে থাকেন। অফিস খোলা আছে বলে তারা দাবি করেন, এবং আর কোন কথার জবাব না দিয়ে চলে যান। তবে বেলা বারোটা পর্যন্ত কেউ অফিসে আসেন নি। ওই অফিসের সামনেই একজন গ্রাহকের সাথে কথা হয়, তাঁর নাম শহিদুল ইসলাম। তিনি পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিদর্শক। তিনি পাঁচ লাখ টাকা জমা রেখেছেন। প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা করে মুনাফা পেতেন, কিন্তু নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে কোন মুনাফা পাননি। তবে তার স্থির বিশ্বাস যে, মান্নান তালুকদার ফিরে আসবেন এবং গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবেন। তিনি বলেন হামলা, মামলা বা গাড়ি লুঠপাট করলে কেউ টাকা ফেরত পাবে না । তিনি অফিসের গাড়ি অন্যরা জোর করে নিয়ে যাবার কথা জানান।

এ ব্যাপারে বাগেরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান খান এবং ভাইস চেয়ারম্যান সরদার মাসুদুর রহমান জানান আব্দুল মান্নান তালুকদার দুবাই পালিয়ে গেছেন গ্রাহকদের টাকা দেবার ভয়ে ।

উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান আরো বলেন , মান্নান তালুকদারের কাছ থেকে টাকা ফেরত না পেয়ে এবং তার প্রতারণার কথা বুঝতে পেরে, সুলতানপুর, বাধাল এবং কোটা এলাকায় তিনজন স্ট্রোক করে মারা যাবার খবর তার কাছে এসেছে । তাদের অনেক টাকা জমা রয়েছে ।

ফকিরহাটের এক ব্যবসায়ী বর্তমান প্রতিনিধিকে জানান, তার ৬০ লাখ টাকা জমা রয়েছে । দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তিনি চলে যান।

ষাটগম্বুজ এলাকার জাহাঙ্গীর আলম জানান, বছরখানেক আগে পাঁচ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন, মুনাফা পেতেন যথারীতি প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা। নভেম্বর হতে মুনাফা পাননি। সেদিনও খোঁজ নিতে এসেছিলেন, কবে মুনাফা পাবেন, মান্নান কবে ফিরবে ? তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, ব্যাটা পালিয়ে গেছে। আরও কয়েকদিন দেখবেন, তারপর পুলিশের কাছে অভিযোগ করবেন বলে জানান।

মান্নান তালুকদার পালিয়েছে, তা অস্বীকার করেন নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের প্রধান শাখার সহকারী ম্যানেজার (হিসাব)মাহমুদ হাসান সবুজ। এই অফিসটিও মিঠাপুকুর এলাকায়, প্রধান কার্যালয়ের অদূরে। এই দুই অফিসের মধ্যেকার রাস্তা এবং অফিস সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। সবুজ দাবি করেন, আগের দিন তাদের এমডির সাথে ভিডিও ফোনে কথা হয়েছে। তিনি জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আসবেন। এসে তিনি ছোট-খাট গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করে দেবেন।

প্রধান শাখায় যখন সবুজের সাথে এই প্রতিনিধিসহ একাধিক সাংবাদিকের কথা হচ্ছিল, তখন প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট ও গ্রাহক দাবিদার গোটা বিশেক লোক ঘিরে ধরে সংবাদ মাধ্যমকে আক্রমণ করে নানা উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেন। তারা এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক খবর না প্রকাশের জন্যে হুশিয়ারিও দেন। বলেন, ‘খবরের কাগজে ও টেলিভিশনে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খারাপ খবর প্রচার করে প্রতিষ্ঠানের আয় কমিয়ে দিয়েছে। মানুষ বিনিয়োগ করছে না।’তবে তারা খুবই জোরের সঙ্গে বলেন, ‘তাদের এমডি মান্নান তালুকদার আবার ফিরে আসবেন এবং সকলের পাওনা পরিশোধ করবেন।’

প্রসঙ্গত, ‘রিয়েল এস্টেটের নামে হাতানো হলো ২০০০ কোটি টাকা’ শীর্ষক সংবাদ বিভিন্ন মিডিয়াতে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তারপর দুর্নীতি দমন বিভাগ, বাংলাদেশ বাংক তাদের কার্যক্রম তদন্ত করেছে। বাগেরহাট কালেক্টরেট অফিস থেকে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়া চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী (উমেদার, এলএমএসএস) এম এম এ মান্নান তালুকদার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে মানুষের কাছ থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন। তাদের ভাষায় এটি অংশিদারি ব্যবসা। এর প্রধান কার্যালয় বাগেরহাটের মিঠাপুকুরে। শাখা অফিস আছে খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, পিরোজপুর ও যশোরে। নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লি:-এর নামে প্রতিষ্ঠানটি মূলত: জমি কেনাবেচা করে।

এই বিষয়ে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পঙ্কজ কুমার রায়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে বা প্রতিষ্ঠানগতভাবে কেউ কোন অভিযোগ করেনি। আর অভিযোগ না করলে অর্থ-সংক্রান্ত কোন বিষয়ে আমরা জড়াতে পারি না। অবশ্য, কোন বৈধ কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বললে আমরা বিষয়টি অবশ্যই দেখবো।’

মাত্র আট বছরের ব্যবধানে অন্যের টাকা সংগ্রহ করে সম্পদের মালিক বনে যাওয়া আব্দুল মান্নান তালুকদার বাগেরহাট শহরে খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। জেলা শহরের যেকোন অনুষ্ঠানে প্রশাসনের বড় কর্তা, রাজনীতিক, গণ্যমান্যদের সাথে তিনি প্রথম সারিতে আসন পেতেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক দিয়ে সার্টিফিকেটবিহীন এই লোকটি চরম ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। স্থানীয় বাগেরহাট প্রেসক্লাবে মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে তিনি আজীবন সদস্য পদ গ্রহণ করেছেন। ‘দৈনিক বাস্তবতা’ নামে একটি সংবাদপত্রের প্রকাশক তিনি; যদিও কাগজটি নিয়মিত বেরোয় না; তবে অনলাইনে পত্রিকাটির নামফলক (মাস্টহেড)-এর অস্তিত্ব আছে। এই পত্রিকাটির নামে অনেক সাংবাদিকও আছে বাগেরহাট জেলা ও উপজেলা স্তরে।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ পরিচালক আবুল হোসেন জানান, দুদকের ঊর্ধতন কতৃপক্ষ নির্দেশে নিউ বসুন্ধধার রিয়েল এস্টে-এর রিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছেন। সহকারী পরিচালক শাওন মিয়া বিষয়টি তদন্ত করছেন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তারা ইতিমধ্যে লেন–দেন বিবরণি সংগ্রহ করেছেন। এসব লেন দেনে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমান পাওয়া গেছে । তবে তাদের ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে বড় কোন অংক নেই । তিনি জানান এসব কাগজ পত্র পর্যালোচনা করে মানি লন্ডারিং আলামত পাওয়া গেছে । তিনি আরো জানান আব্দুল মান্নান তালুকদার আয়কর বিভাগে হিসাব দাখিল করে বলেছেন তার বাৎসরিক আয় ৩ লাখ টাকা আর সোনালী ব্যাংক সহ বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে আয় দেখিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা । ব্যাংক হিসাবে বছরে শত কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে বিধি মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জানুয়ারি ১৬,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর