thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

গল্প

শিকার

২০১৯ জুলাই ২১ ০৯:২৭:৫৪
শিকার

মুহাম্মদ শরীফ উল ইসলাম

রোববার সন্ধ্যায় আটলান্টার কোহিনূর রেস্টুরেন্টে প্রবাসী বাঙ্গালীদের আড্ডাটা জমেছিল বেশ ভালই। বাংলাদেশের ভিক্ষাবৃত্তি বিদেশী রেস্টুরেন্টে মজাদার আড্ডার বিষয়ে রূপান্তরিত হল। একজন বলে উঠলেন ভিক্ষা বৃত্তি যতটা সহজ মনে হয় আসলে ততটা সহজ নয়। ভিক্ষাদাতাকে ভিক্ষা প্রদানে উৎসাহিত করতে দেহ ভঙ্গী ও বাচন ভঙ্গী দুইই ব্যবহারে ভিক্ষুককে পারদর্শী হতে হয়। কখন কিভাবে ভিক্ষা দাতার সামনে কী রকম অঙ্গ ভঙ্গী ও কখন কী বলতে হবে কিভাবে বলতে হবে অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে নাকি ইতিমধ্যে গোপনে কয়েকটা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভিক্ষুকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। তবে আফসোসের বিষয় বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তিতে বিকলাঙ্গ শিশুদের প্রাধান্য বেশী। এক অপরাধ চক্র শিশুদের অপহরণ করে তাদের হাট পা ভেঙ্গে বিকলাঙ্গ করছে এবং শহরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় তাদের দিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে। তাদের আয়ের সিংহভাগ এই চক্র ভোগ করছে।

আড্ডার উপসংহারে আমরা এই সিদ্ভান্তে উপনীত হলাম যে, এই পৈশাচিক অপরাধীদের খুঁজে বের করা উচিৎ এবং আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করান জরুরী প্রয়োজন। আমরা প্রবাসীরা এ ব্যপারে বড় ভূমিকা পালন করতে পারি।নিরুপায় শিশুদের এই সব শিকারির হাত রক্ষা করার জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করে ফেল্লাম।আগামি মাসে আমি দেশে যাচ্ছি তাই দেশের ভিক্ষা প্রথার উপর একটা সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত সচিত্র প্রতিবেদন কমিটির কাছে পেশ করার জন্য আমার উপর দায়িত্ব অর্পিত হল এবং কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরাও দেয়া হল। ফার্মগেট ওভার ব্রিজ থেকেই আমার কার্যক্রম শুরু করলাম। ওভার ব্রিজের নীচে ও উপরে অনেক ভিক্ষুক দেখলাম। এক জায়গায় দেখলাম এক অশীতিপর বুড়া পরনে লুঙ্গী ও পাজামা পরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছে। অনেকগুলো লোক তাকে ঘিরে রয়েছে। বুড়া ক্ষীণ কণ্ঠে কি যেন বলছে। আমি নিচে যেয়ে হতবাক হয়ে গেলাম, An old helpless man begging your help. Please don’t go away. Give me some taka to eat.

বঙ্গদেশে বঙ্গভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজিতে ভিক্ষা? কারণটা কি? ভিক্ষা দাতাকে মোহিত করে ভিক্ষা দানে উৎসাহিত করানই ভিক্ষুকের কাজ। তাহলে নিশ্চয়ই এই বুড়া প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ভিক্ষুক। ইংরেজি ভাষায় কথা বলে ভিক্ষা দাতার মনে করুণার উদয় করা – এই ব্যক্তি এক সময় সম্ভ্রান্ত ছিল। ভাগ্যের কোন দুষ্ট চক্রে পড়ে বিপদে আপ তিত হয়েছে, তাকে সাহায্য করা যায়। তাই লোকে সাহায্য করছে। বার বার আফসোস করছে। হায়রে কপাল, হায়রে কপাল।

কিন্তু আমার ধারনা এই বুড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ভিক্ষুক চক্রের আদ্যোপান্ত খবর এই বুড়ার পিছনে লেগে থাকলে পাওয়া যেতে পারে। বুড়ার কণ্ঠস্বর যখন আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম তখন মনে হল এটা আমার পরিচিত। চেহারাটা মনে হয় চেনা চেনা। অনেকক্ষণ নিরীক্ষণের পর মনে হল এ কি আমার বন্ধু জায়েদের বাবা হাজী জালাল শেখ। তা কি করে হয়? হাজী জালাল শেখ তো গ্রামের উচ্চবিত্ত মানুষ। জালাল শেখ চল্লিশ দশকের কোন এক সময় তিন চার বার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে পারেন নি। জাহাজের খালাসীর চাকরি নেন। খালাসী থেকে কালক্রমে জাহাজের মাস্টার হন। এলাকার সবাই তাঁকে মাস্টার হিসাবেই জানে। শোনা যায় জাহাজের তেল চুরি মালামাল চুরি করে অনেক পসার জমিয়েছেন। গ্রামে পাকা বাড়ি বাড়ি সংলগ্ন অনেক জমি জমা করেছেন।

আমাদের এলাকায় আট দশটা গ্রামের মধ্যে একটাই মাত্র হাই স্কুল। চার পাশের গ্রামের ছাত্ররা এই স্কুলে পড়াশুনা করে। আমি ৭ম শ্রেণির ছাত্র, তখন জালাল শেখের ছেলে জায়েদ আমার সহপাঠী হয়। জায়েদ্দের বাড়ি মধুমতী কুলে।আমার মামা বাড়ি যেতে হয় মধুমতী পার হয়ে। মামা বাড়ি যেতে মাঝে মাঝে জায়েদ্দের বাড়ি দু চার ঘনটা বেড়াতাম। জায়েদ্দের মধুমতী কুলের বিস্ত্রীত জমিতে সোনালী কাউন আমার মন কেড়ে নিত। আমরা ৭ম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা শেষে দীর্ঘ ছুটি। ছুটি মানেই মামা বাড়ি যাওয়ার আনন্দ। আমি ও আমার কেবলই বড় বোন সকাল ১০তায় মামা বাড়ির পথে জায়েদ্দের বাড়ি গেলাম।দেখলাম জায়েদ তাদের ঘরের বারিন্দায় পাটি পেতে অংক করছে।পাসে মোড়ায় আমাদের সমবয়সী একটি মেয়ে বসা। খুবই সুন্দরী, অবশ্যই সে সেজেছিল সুন্দর করে। জায়েদ কে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কেরে? এটাকে নূতন দেখচি।জায়েদ কোন জবাব দিল না।জায়েদের মা এসে আমার বোনকে জড়িয়ে ধরল, আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করল। আমি বললাম কাকিমা এ মেয়েটা কে

কাকিমা বললেন, পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে।

আমি কিছুই বুঝলাম না।

কয়েকদিন পরে শুনলাম জায়েদ্দের বাবা এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছে।

কলেজ ভার্সিটি জীবনে জায়েদকে সব সময় মনমরা দেখতাম। জায়েদ একদিন আমাকে বলল জানিস আনিস আমার বাবা তার নতুন বউকে নিয়ে জাহাজে সমুদ্রে ঘোরে, আমাদের কোন খোঁজ খবর নেয় না। খুবই কষ্টে আছি । মাঠের ফসল বিক্রি করে মা আমার পড়াশুনার খরচ চালায়।মাঝে মাঝে মামাদের কাছে হাত পাততে হয়। পড়াশুনা শেষ একটা চাকুরী না পাওয়া পর্যন্ত আমার মার কোন সুখ নাই।

বুড়ার চেহারাটা মনে হয় জায়েদের বাবার মত। কণ্ঠস্বরও ঠিক বোঝা কষ্ট কর কিন্তু লোকটা ভিক্ষা করছে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।তবুও সাহস নিয়ে বুড়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞহাসা করলাম Are you jalal sheikh, father of jayed? বুড়া আমার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ পরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। এবং বলল I am deadbody of jalal sheikh, he died 10 years ago. এক রাশ প্রশ্ন মনে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম, এতক্ষণ আমি কোন স্বপ্ন দেখি নাই তো?

বিকেল বেলা চাপুলিয়ায় জায়েদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।দুর থেকে জায়েদের বাড়ীর কোন ঠিকানা দেখলাম না। সেখানে দেখা যাচ্ছে ঘন অরণ্য। কাছে যেয়ে দেখলাম যেখানে জায়েদের বাড়ি ছিল সেখানে শাল সেকুন কাঠের বিশাল বাগান। বাগানের প্রবেশ পথে তিন চারটে সিমেন্টের বেঞ্চ। বেঞ্চে আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব কয়েকজন নিয়ে গল্পে মশগুল। চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে দেখামাত্র বললেন আরে আনিস যে? কেমন আছ, স্বাস্থ্য মাসাল্লাহ ভাল হয়েছ, তুমি কি আমার বাগান দেখতে এসেচ।তা একা এলে কেন? বউ বাচ্চা সাথে নিয়ে আসবে। আমার এই বাগান দেখতে তোমার ঢাকা কুমিল্লা সিটাগাং থেকে লোক আসে , তারা এখানে বনভোজন করে। আমার ইনশাল্লাহ ভাল ইনকাম হচ্ছে। গোপনে বিদেশী মাল বিক্রি করি। চেয়ারম্যান চাচা এখানে জায়েদ্দের বাড়ি ছিল না?

বুঝলে আনিস সবই বুদ্ধির খেলা, আমার তোমাদের মত প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী নাই। ডিগ্রী না থাকলে কী হয়েছে ব্রেন তো আছে। ব্রেনের জোরে জালাল মাষ্টারের বাড়ি আজ আমার শখের বাগান। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী বড় কথা না। আমাদের প্রধান মন্ত্রীর কথা ধর, তাঁর কি কোন ডিগ্রী আছে, না নাই। অথচ প্রধান মন্ত্রী, কত ডক্টরেট, ব্যারিস্টার তাঁর ধামাধরা মন্ত্রী। তোমরা যারা ধর্ম ধর্ম করে লাফালাফি কর, তাদের কথাই ধর , ইসলামে নারী নেতৃত্ব নেই, তোমার নিজামই সাইদই পীর সাহেবরা কার নেতৃত্বে চলছে? মহিলা প্রধান মন্ত্রীকে কি তেল দিচ্ছেনা ? দিচ্ছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৩০ বছর পরও কি এসব রাজাকার ধর্ম ব্যবসায়ীরা দেশের মন্ত্রী হচ্ছে না। আসলে ওরা জানে কাকে কখন কী পরিমাণ তৈল দিতে হবে। ধর্মের নামে তৈল, বড়ই ধনা ণতরী , ১০০% কার্যকারিতা গ্যারাণ্টেট।তৈলের জোরেই ওরা টিকে আছে টিকে ঠাকবে। যুগে যুগে ওরা তৈল প্রদানে পারদর্শিতা দেখিয়েছে ভবিষ্যতে সে রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখবে। ওদের টিকি ছেড়ে কোন শালায়? দর্পণ কবিরের মত লেখকরা লেখনীর মাধ্যমে ওদের অণ্ডকোষ চেপে ধরলেও বাস্তবে ওদের অণ্ডকোষ চেপে ধরা অত সহজ নয়। আসল কথা হচ্ছে ব্রেন। নদীর এই আবহাওয়ায় আমার একটা বাগান করার শখ হল/ দাবার চাল চাললাম । এসব কাজে বেশী মাথা ঘামান লাগে না। জালাল মাষ্টারের একটা জোয়ান বউ ছিল। তা বোধ হয় তুমি জান। মাস্টারের ছেলে জায়েদ তো তোমার ক্লাশ মেট ছিল তাই না।

বুড়া মানুষের জোয়ান বউ, বুঝলে আনিস জোয়ান বউ হচ্ছে তোমার আগুনের ঢেউ। আমি এই ঢেউ নিয়ে খেলা করলাম। দিলাম মাগীরে কু পরামর্শ। বললাম শোন, শাহানা তুই হচ্ছিস উঠতি বয়সী মেয়ে, সামনে তোর সারা জীবন পড়ে আছে। তোর বুড়া নাগর আজ বাদে কাল যাবে কবরে। তখন তোর অবস্থা হবে কী? বুড়ার জোয়ান ছেলেপুলে তোকে তো কুত্তার মত তাড়িয়ে দিবে। আমার কথা মত কাজ কর/ বুড়োর সব সম্পত্তি ফাঁদে ফেলে তোর নামে লিখে নে।

পরের দিন ভোরবেলা নদীর ঘাটে বউটার হাত পা বেঁধে ফেলে রাখলাম। দিলাম জালাল মাস্টার ও তার বউ ছেলেমেয়ের নামে ATTEMPT TO MURDER CASE

আর যায় শালা কোথায়? একবারেই স্যালাইনের মত কাজ করল। মামলা মোকাদদমা থানা পুলিশের খরচ যোগাতে জালাল মাস্টার আমার কাছে পানির দামে জমি বিক্রি করতে লাগল।

কয়েকমাস পরে আসাদ গুণ্ডারে ৫০০ টাকা দিয়ে বউটারে খুন করালাম। দোষ চাপল জালাল মাস্টার ও তার ছেলেমেয়ের উপর। খুনের মামলায় বসত বাড়ি সব আমার কাছে বিক্রি করে দিয়ে কোথায় গেছে জানি না । শুনেছি হাজত খাঁটার পর বুড়াটা শহরে ভিক্ষা করে খায়। তাও নাকি শালা ইংরেজিতে ভিক্ষা মাগে।বুঝলে আনিস সবই তার কপালে ছিল। বুড়া বয়সে জোয়ান বউ, ভীমরতি সাঁই ভীমরতি। তোমাদের THREE W আর কি। WEALTH, WINE আর WOMEN সব ধবংশের মূল। আফসোস লাগে একই গ্রামের মানুষ, মুরব্বী বড় ভাইয়ের মত। পোলাপানগুলো অযথা জেল খাটছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল,বাড়ির দিকে রওনা হলাম। চেয়ারম্যান বললেন বিদেশে থাক, টানার অভ্যাস আছে নাকি, আমার কাছে বিদেশী মাল আছে। ইচ্ছা হলে আর কিছুক্ষণ থাক। এক গ্লাস টেনে যাও।

বিদেশে থাকলেও ওটার অভ্যাস করতে পারি নাই।

তাজ্জবের কথা শোনালে, পানিতে থেকে পানি খাও না।

বাড়ির দিকে হেঁটে চললাম, কাকীমার মুখটা হৃদয়ে ভেসে ঊঠল,কানে বাজতে ছিল, পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ২১,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

সাহিত্য এর সর্বশেষ খবর

সাহিত্য - এর সব খবর