thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

ডেল্টা গ্রুপের ২২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, তদন্তে নামছে দুদক

২০১৯ জুলাই ২১ ১১:৩২:৪৫
ডেল্টা গ্রুপের ২২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, তদন্তে নামছে দুদক

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: সাত ব্যাংক থেকে দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে—এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর ঋণের এ টাকা ডেল্টা গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী একেএম ফারুক আহমেদ বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক। গত ১৫ জুলাই প্রকৌশলী ফারুকের বিরুদ্ধে ব্যাংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দুদক পরিচালক (অনুসন্ধান) কাজী সফিকুল আলম অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে অভিযোগ অনুসন্ধান ও সমন্বয়ও করেন তিনি। তবে বারবার যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে কাজী সফিকের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি মোট সাতটি ব্যাংক থেকে ডেল্টা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দুই হাজার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ঋণের বিপরীতে একই সম্পত্তি একাধিকবার বন্ধক রেখেছে এই শিল্প গ্রুপটি। যেসব সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা বিক্রি করে ঋণের অর্ধেক টাকাও উঠে আসবে না বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক।

গাজীপুরের কাশিমপুরের জারুন দক্ষিণ এলাকায় দুই লাখ ৫৬ হাজার ৩৩২ ফুট জমিতে ডেল্টা গ্রুপের ১০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ছয় তলা দুটি, পাঁচ তলা একটি ও তিন তলা বিশিষ্ট একটি ভবন আছে ডেল্টা শিল্প পার্কে। গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা সাড়ে চার হাজার। এই গ্রুপের ঢাকা অফিস বারিধারা ডিওএইচএসের ছয় নম্বর লেনের ৩৮৯ নম্বর বাড়িতে।

ডেল্টা গ্রুপের চেয়ারম্যান ছাড়াও প্রকৌশলী ফারুকের আরও পরিচয় আছে। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা বিএনপির সভাপতি তিনি। এলাকায় তালুকদার ফারুক নামে তিনি পরিচিতি।

ডেল্টা গ্রুপের বিরুদ্ধে গত ১৫ জুলাই অভিযোগ দায়ের করেন শামীম আহসান। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে তিনি এ অভিযোগ জমা দেন।

অভিযোগে যা বলা হয়েছে
ঋণে জর্জরিত ১০ প্রতিষ্ঠান: গাজীপুর জেলার কাশিমপুর জারুন (দক্ষিণ) এলাকায় একই কম্পাউন্ডে অবস্থিত ডেল্টা গ্রুপের ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওয়েবসাইটে ডেল্টার প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে—প্লট ৩৮৯, লেন ৬, ডিওএইচ বারিধারা, ঢাকা। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—দ্য ডেল্টা কমপোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ডেল্টা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, ডেল্টা এক্সেসরিজ লিমিটেড, ডেল্টা অ্যাপারেলস লিমিটেড, দ্য ডেল্টা ব্লিন্ডেড ইয়ার্ন মিলস লিমিটেড, দ্য ডেল্টা ইয়ার্ন ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, দ্য ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, দ্য ডেল্টা কার্টন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সাফা হাইটেক প্যাকেজিং লিমিটেড ও লিলি কসমেটিকস লিমিটেড।

এসব প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে তিনি জনতা ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও নিয়েছেন ৩৫০ কোটি টাকা। এসআইবিএল থেকেও একই পরিমাণ টাকা নিয়েছেন তিনি। এছাড়া, সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি, ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড থেকে সাতশ’ কোটি, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক থেকে আড়াইশ’ কোটি এবং ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড থেকে দুইশ’ কোটি টাকা ঋণ নেন প্রকৌশলী ফারুক।

ডেল্টা গ্রুপের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ
দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগে আরও বলা হয়, ঋণে জর্জরিত ডেল্টা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। সাত মাসের বেশি সময় ধরে তাদের বেতন নেই। অন্যদিকে, ডেল্টার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ফারুক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিপুল বিত্ত-বৈভব। এসব সম্পদের তথ্য তার আয়কর নথিতেও নেই। ব্যাংকেও জামানত হিসেবে রাখা হয়নি।

ব্যাংক এবং আয়কর নথিতে ফারুকের গোপন করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে—১. বারিধারা ডিওএইচএস রোড নম্বর-৭, বাড়ি-৪৩২ নম্বরে চার হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের (প্রতিটি দুই হাজার ৩০০ স্কয়ার ফুট) দু’টি ফ্ল্যাট। মূল্য প্রায় ছয় কোটি টাকা। ২. গুলশান-২, রোড-৭১, বাড়ি-৯/বি, (ফ্ল্যাট সি-৬) সাড়ে ছয় হাজার স্কয়ার ফুটের একটি আলিশান ফ্ল্যাট। নাভানা থেকে কেনা এই ফ্ল্যাটের দাম ১৫ কোটি টাকা। বারিধারা ও গুলশানের ফ্ল্যাটের কথা তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি।

এছাড়া, প্রকৌশলী ফারুক সিঙ্গাপুরে ভাগ্নের নামে কিনেছেন দুই হাজার ৭০০ স্কয়ার ফুটের একটি ফ্ল্যাট। তার সেকেন্ড হোম মালয়েশিয়ায়। তবে বিদেশে কত টাকা পাচার করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি।

অভিযোগে আরও বলা হয়—প্রকৌশলী ফারুক উৎপাদন করে নয়, বরং ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করেই ‘বড়’ হয়েছেন। তৈরি পোশাক এবং তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট ডেল্টা গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই নাজুক। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের সঙ্গে ব্যাংকের কিছু পদস্থ কর্মকর্তাও জড়িত। তাকে ‘খেলাপি’ ঘোষণা দিলে অনেকে জড়িয়ে যাবেন, অনেকের চাকরি চলে যাবে, অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হবে, এই আশঙ্কায় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো ডেল্টা গ্রুপের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা চাপা দিয়ে রেখেছে।

দুদকে ফারুকের বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ

১. দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন ডেল্টা গ্রুপের চেয়ারম্যান।
২. গোপনে প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
৩. একই সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকে বন্ধক রেখেছেন।
৪. ভুয়া এলসি দেখিয়ে তিনি ‘মানি রাইজ’ করেছেন।
৫. আমদানি করা তুলা গোপনে বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
৬. শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮০ শতাংশের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
৭. গোপনে বিক্রি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দু-চারটি লাইন চালু রেখে গ্রাহক খুঁজছেন।
৮. একই জমির একাধিক ভুয়া ডকুমেন্ট বন্ধক রেখে ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের জন্য নিম্নমানের যন্ত্রপাতি এনেছেন।
৯. অল্পকিছু দিন চলার পরই মেশিনগুলো সক্ষমতা হারায়।
১০. ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বার্ষিক অডিট আটকে রাখেন।
১১. কখনও কখনও ভুয়া পরিদর্শন রিপোর্ট তৈরি করে দাখিল করেন।
১২. ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০০৭ সালে গুরুতর অপরাধ দমন অভিযান সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ফারুক।
১৩. পরে দুদক থেকে দায়মুক্তি সনদ নেন।
১৪. বিপদে পড়লে দায়মুক্তি সনদ দেখিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ব্যবসায়িক জগতে ডেল্টা গ্রুপের কোনও নামডাক নেই। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করা ফারুক আশির দশকে প্রকৌশল পেশা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এরশাদ সরকারের আমলে কৌশলে গাজীপুর বিসিক শিল্পনগরীতে শিল্প প্লট বাগিয়ে নেন। সেই প্লট দেখিয়ে ১৯৯২ সালে প্রথম বিনা জামানতে ব্যাংক থেকে নেন ২৫ লাখ টাকা। তখন থেকেই ফারুকের উত্থান ঘটে।

ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) কায়সার ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমাদের ক্লায়েন্ট ডেল্টা গ্রুপের যে প্রতিষ্ঠানটির মালিক, তার অবস্থা ভালো না। সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার ঋণ নিলেও এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। এছাড়া তাদের ডেনিম প্রজেক্ট তিনবার সময় নিয়েও উদ্বোধন হয়নি।’

ইসলামী ব্যাংকের মালিবাগ শাখার ব্যবস্থাপক এবং এসভিপি আবু সুফিয়ান ডেল্টার ঋণের বিষয়ে কোনও তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তবে জনতা ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (রিকভারি) ফজলুল হক বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা সুবিধাজনক নয়। ডেল্টা গ্রুপের ভুয়া এলসির একটি অভিযোগের তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে।’ জনতা ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার (মনিটরিং অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ডিভিশন) আবদুল আউয়াল বলেন, ‘ডেল্টা গ্রুপের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রির চেষ্টা চলছে।’

এসআইবিএল, সাউথইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকে যোগাযোগ করে ডেল্টা গ্রুপের বিষয়ে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ডেল্টা গ্রুপের ঢাকা ও গাজীপুর অফিস অভিযোগের বিষয়ে কোনও বক্তব্য দেয়নি। বিষয়টি জানতে প্রকৌশলী ফারুককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠিয়েও তার জবাব মেলেনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ২১,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর