thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বাবাকে খুন করেও রুশবাসীর মন জয় করে নিল ৩ বোন

২০১৯ আগস্ট ২২ ১৭:০৯:৩৩
বাবাকে খুন করেও রুশবাসীর মন জয় করে নিল ৩ বোন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ২০১৮ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ার তিন কিশোরী বোন মিলে ঘুমন্ত বাবাকে হত্যা করেছিলেন। অথচ তাদের মুক্তির দাবিতে ইতোমধ্যে তিন লাখের বেশি মানুষ পিটিশনে সইও করে ফেলেছে।

কেননা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বাবার হাতে বহু বছর ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এই তিন বোন।

রাজধানী মস্কোতে একটি ফ্ল্যাটে মেয়ে ক্রেস্টিনা (১৯), অ্যাঞ্জেলিনা (১৮) এবং মারিয়ার (১৭) সঙ্গে বসবাস করতেন ৫৭ বছর বয়সী বাবা মিখাইল খাচাতুরইয়ান। ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় মিখাইল একে একে তিনজনকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান।

ঘরবাড়ি ঠিকঠাক পরিষ্কার না করার জন্য তিনজনের সঙ্গেই তিনি ভীষণ রাগারাগি করেন। এমনকি তাদের মধ্যে পিপার গ্যাসও স্প্রে করেন শাস্তি হিসেবে।

এর কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে যান মিখাইল। আর তখনই তিন মেয়ে একটি ছুরি, হাতুড়ি এবং পিপার স্প্রে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘুমন্ত বাবার ওপর। সব আক্রোশ ঝেড়ে হিংস্রভাবে আঘাত করে হত্যা করেন বাবাকে।

মিখাইলের দেহে ৩০টিরও বেশি ছুরিকাঘাতের ক্ষত পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মারাত্মক আঘাত ছিল মাথা, ঘাড় ও বুকে।

বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তিন বোন মিলে পুলিশকে ফোন করেন এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর আত্মসমর্পণ করেন।

ক্রেস্টিনা, অ্যাঞ্জেলিনা ও মারিয়াকে গ্রেপ্তারের পর শুরু হয় মামলার তদন্ত। এর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে খাচাতুরইয়ান পরিবারে চলে আসা ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পারেন, টানা তিন বছরের বেশি সময় ধরে বাবা মিখাইল খাচাতুরইয়ান নিয়মিত মেয়েদেরকে মারধর ও নানাভাবে নির্যাতন করতেন। তাদেরকে ঘরে আটকে রাখতেন তিনি। এমনকি নিজের তিন মেয়েকে যৌন নিপীড়নও করতেন মিখাইল।

হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বাবার বিরুদ্ধে পাওয়া এই প্রমাণগুলো যুক্ত করা হয়েছে।

তিন বোনের মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিনজন মেয়েকে লোকজনের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা হতো। ফ্ল্যাটের ভেতর আটক অবস্থায় প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হতে হতে তাদের মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস সিনড্রোম (পিটিএসডি) দেখা দিয়েছিল।

ঘটনার প্রথম থেকেই মামলাটি পুরো রাশিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এসব তথ্য প্রকাশের পর মানবাধিকার কর্মীরাও মেয়েদের পক্ষে লেগে যান। তারা যুক্তি দেখান, এই তিন বোন অপরাধী নন, বরং অপরাধের শিকার। নিপীড়ক বাবার কাছ থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় না পেয়ে বছরের পর বছর নির্যাতন সইছিলেন তারা।

রাশিয়ায় এখনো পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য কোনো আইন নেই। ২০১৭ সালে আনা নতুন কিছু আইনি পরিবর্তন অনুসারে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি প্রথমবারের মতো পরিবারের কোনো সদস্যকে আঘাতের অভিযোগ আনা হয়, আর সেই আঘাত যদি হাসপাতালে ভর্তি করার মতো গুরুতর না হয়, তবে তাকে শুধু সামান্য কিছু অর্থ জরিমানা করা হবে অথবা সর্বোচ্চ দু’সপ্তাহ জেল হাজতে রাখা হবে।

বিবিসি জানায়, রুশ পুলিশ সাধারণত পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে ‘পারিবারিক বিষয়’ হিসেবে ধরে নেয় এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির তেমন কোনো কাজেই আসে না।

মিখাইল তার স্ত্রীর ওপরও একইভাবে নির্মম নির্যাতন চালাতেন। নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে অরেলিয়া ডুনডুক পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। তাকে বাঁচাতে প্রতিবেশীরাও গিয়েছিলেন পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে। তারাও মিখাইলকে খুব ভয় পেতেন। কিন্তু কোনোবারই পুলিশ তাদেরকে কোনো সাহায্য করেনি।

২০১৫ সালে অরেলিয়াকে মিখাইল বাসা থেকে বের করে দেন। তারপর থেকে মেয়েদের সঙ্গে চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারেননি অরেলিয়া। মেয়েদের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক রাখা তার জন্য নিষিদ্ধ ছিল।

মামলার অগ্রগতি বেশ ধীরে চলছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। ক্রেস্টিনা, অ্যাঞ্জেলিনা ও মারিয়া এখন আর পুলিশি হেফাজতে না থাকলেও তাদের ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে: তারা সাংবাদিক বা একে অপরের সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারেন না।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করছেন, হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। তাদের যুক্তি, তিন বোন সকালেই ছুরিটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাবা ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনজন মিলে পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডটি চালান। হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নেয়া ছিল বলে তাদের দাবি।

রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, অ্যাঞ্জেলিনা হাতুড়ি, মারিয়া ছুরি এবং ক্রেস্টিনা পিপার স্প্রে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছিলেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিন বোনকে সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে।

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, হত্যাকাণ্ডটি মূলত আত্মরক্ষার্থে ঘটানো হয়েছে।বাবাকে খুন করে রুশবাসীর মনে জায়গা করে নেয়া তিন বোন

রাশিয়ার দণ্ডবিধিতে শুধু তাৎক্ষণিক সহিংসতার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষা নয়, টানা নির্যাতন বা অপরাধের শিকারের ক্ষেত্রেও পাল্টা হামলাকে আত্মরক্ষা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিম্মি অবস্থায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি নির্যাতনকারীকে হত্যা করলে সেটি ‘আত্মরক্ষার্থে হত্যা’।

আর এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতেই তিন বোনের আইনজীবী দাবি করছেন, বছরের পর বছর টানা অপরাধের শিকার হয়ে এ কাজ করেছেন তারা। তাই তাদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত।

তিনি আশা করছেন, মামলাটি শিগগিরই খারিজ করে দেয়া হবে। কেননা ইতোমধ্যে ক্রেস্টিনা, অ্যাঞ্জেলিনা ও মারিয়ার ওপর অন্তত ২০১৪ সাল থেকে বাবা মিখাইলের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।

মানবাধিকার কর্মীসহ রাশিয়ার অধিকাংশ সাধারণ জনগণও এখন আইনের পরিবর্তন চান। এছাড়া নির্যাতিত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাও চান তারা।

আর এখন সবাই দেখার অপেক্ষায় আছেন, শেষ পর্যন্ত কী ঘটে এই তিন বোনের ভাগ্যে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ২, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

বিশ্ব এর সর্বশেষ খবর

বিশ্ব - এর সব খবর