thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে

২০১৯ অক্টোবর ২৪ ১৩:০৯:০১
যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে

ফেনী প্রতিনিধি: ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন ওই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। ২৭ মার্চ এ বিষয়ে মামলা করেন নুসরাতের মা। নুসরাতের অভিযোগ ও মামলায় সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রেফতার হলে তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা পরিকল্পনা করে নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের।

গত ১ এপ্রিল আসামি শামীম, নূর উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের ও রানা আসামি সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করে। সেখানে সিরাজ-উদ-দৌলা তার মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে নির্দেশনা দেন।

হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নিলে আসামিরা নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। ফলে শামীম, কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে যেকোনও কিছু করার পরিকল্পনা করে।

মামলার চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শামীমকে ১০ হাজার টাকা দেন। ওই টাকা দিয়ে শামীম পরিকল্পনা মোতাবেক তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মণিকে দিয়ে দুইটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনায়। পরে ৩ এপ্রিল আসামি শামীম, নূর উদ্দিন ও কাদেরসহ কয়েকজনকে নিয়ে জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করে। সিরাজ-উদ-দৌলা নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যা এবং হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

যেভাবে হত্যা
৪ এপ্রিলের পরিকল্পনা মোতাবেক বেলা আনুমানিক ৩টায় মাদ্রাসার পাশের টিনশেডকক্ষে আসামি শামীম, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও মণিসহ আরও কয়েকজন মিটিং করে এবং নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। একইদিন রাত সাড়ে ৯টায় আবার মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ এপ্রিল বিকাল ৫টায় ভূঁইয়া বাজার থেকে শামীম এক লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়।

৬ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে শামীম, নূর উদ্দিন, কাদের মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আসে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে আসামিরা যার যার অবস্থানে চলে যায়। শামীম পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। মণির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটিসহ মোট তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় রাখা হয়। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাতমোজা পরিধান করে তৃতীয় তলায় অবস্থান করে।

নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বে অবস্থান করা উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। নুসরাত দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়। নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সঙ্গে ছাদে উঠলে মণি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে ছাদে যায়। ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে।

নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়। শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে নিয়ে আসে। পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দুভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মণি নুসরাতের হাত পেছনে বেঁধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ফেলে। জাবেদ পায়ে গিঁট দেয়। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে।

মণি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শামীমের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামে। এরপর পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। ওই সময় মণি পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যায়। মণি ও পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। জাবেদ ও শামীম সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলে। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরকা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢোকে। শামীম নেমে মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় ও মাদ্রাসার পুকুরে বোরকা ফেলে দেয়।

জোবায়ের সাইক্লোন শেল্টার থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরকা ও হাতমোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়। নূর উদ্দিন সাইক্লোন শেল্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে।

এছাড়া আসামি মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন শেল্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারারত থাকে। মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারারত থাকে। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়।

নুসরাত অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। ওই সময় নূরও নুসরাতের গায়ে পানি দেয় এবং কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়। পরবর্তীতে নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেয়। ওই জবানবন্দিতে তাকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনাটি একইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/অক্টোবর ২৪,২০১৯)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

অপরাধ ও আইন এর সর্বশেষ খবর

অপরাধ ও আইন - এর সব খবর