thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

কথাসাহিত্যিক মকবুলা মনজুরের সঙ্গে কিছুক্ষণ

‘মানুষকে ভালো না বাসলে ভালো সাহিত্য রচনা করা যায় না’

২০১৪ মার্চ ১৫ ০১:১৭:৪৮
‘মানুষকে ভালো না বাসলে ভালো সাহিত্য রচনা করা যায় না’

সাহিত্যিক মকবুলা মনজুর। লিখেছেন দু’হাতে। মূলত কথা সাহিত্য, নাটকেই তার বিচরণ। লেখা-লেখির হাতে খড়ি শৈশবেই, যখন তার বয়স ৮ বছর। শুরু হয়েছিল ছড়া দিয়ে। তারপর গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদসহ গদ্য সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে তিনি কাজ করে চলেছেন। মকবুলা মনজুরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের মুগবেলাইয়ে। তার পিতা মরহুম মিজানুর রহমান ও মাতা মরহুমা মাহমুদা খাতুন। তার ৭ ভাই-বোনের বাকিরা হলেন-ড. মোখলেসুর রহমান, জোবেদা খাতুন, অধ্যাপিকা মোসলেমা খাতুন, চলচ্চিত্র পরিচালক ইবনে মিজান, প্রবন্ধকার আজিজ মেহের, মুশফিকা আহমেদ। মকবুলা মনজুরের স্বামী মনজুর হোসেন। বর্তমানে তার আবাসস্থল রাজধানীর উত্তরায়। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : আর এক জীবন, অবসন্ন গান, বৈশাখে শীর্ণ নদী, জল রং ছবি, প্রেম এক সোনালী নদী, শিয়রে নিয়ত সূর্য, চেনা নক্ষত্র, কনে দেখা আলো, নদীতে অন্ধকার, লীলা কমল, কালের মন্দিরা, বাউল বাতাস, ছায়াপথে দেখা, একটাই জীবন, সায়াহ্ন যূথিকা, নক্ষত্রের তলে। তিনি তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (উপন্যাস) ২০০৫, জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার শ্রেষ্ঠগ্রন্থ (কালের মন্দিরা) পুরস্কার ১৯৯৭, কথা সাহিত্যে কমর মুশতারী পুরস্কার ১৯৯০-সহ বেশকিছু পুরস্কার। সম্প্রতি দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে তার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন তার লেখার বিষয় একমাত্র মানুষ। অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে বাংলার প্রকৃতি, নদ-নদী, পাখি প্রভৃতি বিষয়। সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইসহাক ফারুকী


দ্য রিপোর্ট : কবে থেকে লেখালেখির শুরু ?

মকবুলা মনজুর : আট বছর বয়সে ছড়া লিখেছি। দৈনিক আজাদে ছাপা হতো। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছি। তারপর ছোট গল্প ও কবিতা লিখি। তাও বেশী দিন নয়।

দ্য রিপোর্ট : সে সময়ের কোনো ছড়া বা কবিতা মনে পড়ে ?

মকবুলা মনজুর : (আবৃত্তি করে শোনালেন, কোনো শিশু আবৃত্তি করছে বলে মনে হলো)

“জ্বর হলে কি হয়?

ঘন ঘন খিদে পায়

ভাত খেতে প্রাণ চায়

ঔষধের তেতোমিতে

প্রাণ বুঝি চায় যেতে

চুপচাপ শুয়ে থাকা

লাগে বড় বিশ্রী

চেহারা যা হয়েছে

আহা সেকি সুশ্রী!”

-এটুকুই মনে আছে। ৮/৯ বছর বয়সে লিখেছিলাম। আরে, ভালোই তো মনে আছে দেখছি।

দ্য রিপোর্ট : আর গদ্য সাহিত্য?

মকবুলা মনজুর : ১৮ বছর বয়স থেকে গদ্য সাহিত্যের দিকে ঝুঁকি। কবিতা তো মুহূর্তের অনুভূতি। গদ্য সাহিত্য হলো স্থায়ী।

দ্য রিপোর্ট : আপনার লেখার বৈশিষ্ট্য কী ?

মকবুলা মনজুর : মানুষ। সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানুষ। আমার গল্পে মানুষ যা, তাই। প্রকৃতি, কোকিল, হলদে পাখি, মাছরাঙ্গা, গ্রাম-সবকিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমার লেখায়।

দ্য রিপোর্ট : আপনার পরিবারেও তো লেখালেখির চর্চা ছিল...

মকবুলা মনজুর : বাবা মিজানুর রহমান লেখালেখি করতেন। আর আমার ভাইবোনেরাও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।

দ্য রিপোর্ট: আপনার লেখা-পড়ার পর্বটা সম্পর্কে বলুন...

মকবুলা মনজুর : টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে মেট্রিক পাস করেছি। সে সময় ভাষা আন্দোলন চলছিল। উত্তাল দেশ। আমরা হোস্টেলে থাকি। বড় আপারা সুযোগ মতো বের হবে। আমাদেরও বের হতে বললেন। বের হওয়ার সময় আমাদের বাধা দেওয়া হলো। আমরা লাত্থি মেরে গেট ভেঙ্গে বেরিয়েছি। বক্তৃতা দিয়ে আসার পর হলে ঢুকতে দেওয়া হলো না। আমি ও আমার ভাই প্রবন্ধকার আজিজ মেহের এক সঙ্গে টাঙ্গাইলে মামার বাসায় চলে গেলাম। এরপর রাতেই গ্রামে চলে গিয়েছিলাম।

দ্য রিপোর্ট: তারপর? বাকি পড়ালেখা...

মকবুলা মনজুর : মেট্রিক পাস করার পর ভারতেশ্বরী হোমসে ভর্তি হয়েছিলাম। রেস্ট্রিকটেড লাইফ দেখে বের হয়ে গেলাম। ভাই ও পরিচালক ইবনে মিজান নিয়ে এলেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। তারপর ইডেন কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ পাস করেছি। অনেক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করি।

দ্য রিপোর্ট : বিয়েটা কবে হয়েছিল?

মকবুলা মনজুর : ১৯৬১ সালের ২৯ জুন। ওর বাবা বগুড়ায় আইনচর্চা করতেন। আমরা পারিবারিক সূত্রে আত্মীয় ছিলাম। আমার ভাই ইবনে মিজানের সঙ্গে ওদের পরিবারের বেশ খাতির ছিল। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি।

দ্য রিপোর্ট : প্রেম? ওই সময়? বলেন কি!

মকবুলা মনজুর : প্রেমের বিয়ে কি তখন হতো না? হতো। তখনও বাবা-মায়েরা প্রেম মেনে নিতেন না। এখনও নেন না। তো, আমরা রমনা পার্কে বেড়াতে যেতাম। ও-ই আমাকে রমনা পার্কে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

দ্য রিপোর্ট : আপনি তো নাটকে অভিনয় করেছিলেন?

মকবুলা মনজুর : বগুড়ায় থাকাকালে আমরা বাসায় সাহিত্যের আসর করতাম। নাটক করতাম। আমি তখন কিশোরী। ১২/১৪ বছর বয়স। বগুড়া এডওয়ার্ড ঘূর্ণায়মাণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেছি।

দ্য রিপোর্ট: বিটিভিতে তো অনেক কাজ করেছেন। শুরুটা কবে?

মকবুলা মনজুর : যুদ্ধের আগের কথা। জামিল চৌধুরী আমাকে বিভিন্ন সময় ডাকতেন। নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। ১৯৬৮ সালে আতিকুল হক চৌধুরী আমার লেখা ‘আর এক জীবন’ নিয়ে নাটক বানান। নাম দেন ‘সূর্যের চোখে জল’।

দ্য রিপোর্ট : আর বাংলাদেশ বেতারে ?

মকবুলা মনজুর : বেতার যখন নাজিমউদ্দীন রোডে ছিল, তখন থেকেই যাতায়াত।

দ্য রিপোর্ট : বেতারে চাকরি নেননি ?

মকবুলা মনজুর : শিল্পী হিসেবে রেডিওতে যে দাপট ছিল, চাকরি করলে তা আর থাকত না। শিল্পী থাকাটাই গৌরবের।

দ্য রিপোর্ট: আপনার তো বর্ণিল চাকরি জীবন।

মকবুলা মনজুর: প্রথমে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে (বর্তমান রূপালী ব্যাংক) অফিসার পদে নিয়োগ পাই। মনে তখন শিক্ষকতার স্বপ্ন। অর্ধেক বেতনে চলে আসি হলিক্রস কলেজে। এরপর ইউনিভার্সিটি উইমেন্স কলেজ, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি।

দ্য রিপোর্ট: হলিক্রস কলেজ ছাড়ার কারণ?

মকবুলা মনজুর : মুক্তিযুদ্ধের আগে হলিক্রস কলেজে একটি ঘটনা ঘটে। এক মেয়ে মাঠে বাংলাদেশের পতাকা গাড়বে। এক ম্যাডাম তা কিছুতেই হতে দেবে না। এ নিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়। পতাকা ফেলে দেন তিনি। পরে আমি গিয়ে পতাকা মাঠের মধ্যে পুতে দিয়ে সেই যে বেরিয়ে এসেছি, আর ফেরত যাইনি। আমি চিরকালের বিক্ষুব্ধ জনতার একজন।

দ্য রিপোর্ট : মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কোথায় ছিলেন?

মকবুলা মনজুর : আমরা পুরান ঢাকায় থাকতাম। কোর্টের পেছনের দিকে ১৩নং ঝুলন বাড়ি লেনে। যুদ্ধের সময় বিপদগ্রস্ত ছিলাম। একবার পালিয়ে মৌলভীবাজারে চলে গিয়েছিলাম। আবার ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি। আমরা বেরুতে পারিনি। বিহারিরা টার্গেট করে রেখেছিল। তো, ১৫ ডিসেম্বর রাতে, হুট করে বাইরে থেকে জয় বাংলা ধ্বনি শুনতে পাই। কিছু বলতেও পারছিলাম না। চুপচাপ ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর সকালে ভাই আজিজ মেহের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছেন আর ‘রিলিজড রিলিজড’ বলে চিৎকার করছেন। আমরা রিলিজ হলাম।

দ্য রিপোর্ট : পত্রিকায় লেখালেখির দিনগুলো...

মকবুলা মনজুর : ২৫ বছর সাপ্তাহিক বেগম-এ ফিচার এডিটর ছিলাম। এরপর দৈনিক আজাদ-এর ফিচার এডিটর ছিলাম। আমরা ছোটবেলায় মুকুল ফৌজ করতাম। পটুয়া কামরুল হাসান শুরু করেছিলেন মুকুল ফৌজ। আজাদ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক মুহাম্মদ মোদাব্বের আমার লেখা ছাপাতেন।

দ্য রিপোর্ট : এখন কি লিখছেন না?

মকবুলা মনজুর : না। তেমন লিখছি না।

দ্য রিপোর্ট : আপনার লেখায় সমাজ বাস্তবতার বিষয়টি কীভাবে উঠে এসেছে ?

মকবুলা মনজুর : আমি সমাজের সমস্যাগুলো সৃষ্টিশীল বিষয়ের মাধ্যমে তুলে ধরি। একটা নাটক ছিল, শেফালীরা। যার মাধ্যমে গার্মেন্টসের মেয়েদের গল্প তুলে ধরেছিলাম। মজার ব্যাপার হলো অধ্যাপিকা লতিফা আখন্দ আমার নাটকের গল্পই আমার কাছে করে বলেছিলেন, জানো এই ধরনের একটা নাটক দেখলাম।

দ্য রিপোর্ট : ভালো সাহিত্য রচনা করতে কী প্রয়োজন?

মকবুলা মনজুর : সমাজ ও মানুষকে অনুধাবন করার ক্ষমতা। চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। মানুষকে ভালো না বাসলে ভালো সাহিত্য রচনা করা যায় না।

দ্য রিপোর্ট : সাম্প্রতিক টেলিভিশন নাটক সম্পর্কে বলবেন কি ?

মকবুলা মনজুর : এখনকার টিভি নাটকে জীবন খুঁজে পাই না। অনেকে ভারতীয় নাটক দেখাচ্ছে। ওদের চিন্তাধারা বা জীবনের সঙ্গে তো আমাদের কোনো মিল নেই। এ ছাড়া আমি বলব, অভিনয়টাও আরও ভালো হওয়া দরকার।

দ্য রিপোর্ট : আপনাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনের দিন কাটছে কীভাবে, যেহেতু আপনাদের আত্মজরা থাকে দূরে...

মকবুলা মনজুর : আমরা দু’জনে খুব ফ্রেন্ডলি। কি করে যেন সময় পার হয়ে যায়। কথা বলার অনেক বিষয় থাকে তো। বড় মেয়ে লিন্ডা, ছোট বোন বিউটি মাঝে মাঝে আসে। আর সুযোগ পেলেই অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে জয়, থাইল্যান্ডে তৈমুর ও মেলবোর্নে সুকন্যার কাছে যাই। কয়েকদিন আগেও ঘুরে এলাম।

দ্য রিপোর্ট : দ্য রিপোর্টকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মকবুলা মনজুর : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর