thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন

২০২০ আগস্ট ১৫ ০৯:১৮:৫৪
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দীনকে শেষবারের মতো কল দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিলকে বলেছিলেন, তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে। পরে লাইন কেটে যায়।

যে কালরাতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, নগরীকে ঘিরে ধরেছিল অনিশ্চয়তা। দেশের নেতৃত্ব অচল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কর্নেল জামিল তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। তিনি সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কল করেন এবং তাঁদের সেনা পাঠাতে বলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার নির্দেশ দেন এবং তৎক্ষণাৎ ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির দিকে ছুটে চলেন।

সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছালে পিজিআর কনভয় কর্নেল জামিলকে থামায়। তিনি কারণ জানতে চান। তাঁকে বলা হয়, সামনে সেনা ইউনিট রয়েছে এবং গোলাগুলি চলছে। তিনি সেনাদের সামনে এগোনোর জন্য বোঝাতে চেষ্টা করেন। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি জিপে চেপে বসেন এবং নিজে গাড়ি চালিয়ে ৩২ নম্বর রোডে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

গুলি করা হয় কর্নেল জামিলকে। গাড়ির ভেতর লুটিয়ে পড়েন তিনি। শাহাদতবরণ করেন কর্নেল জামিল, যিনি অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন। নীতি ও কর্তব্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য কর্নেল জামিলকে দান করেছে শহীদের মর্যাদা। যে রাতে অনেক সাহসী মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন, সে রাতে কর্নেল জামিল একচুলও টলেননি তাঁর কর্তব্যবোধ থেকে। সাহসিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন কর্নেল জামিল। জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন কর্তব্যবোধকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন অনেক মানুষ যাদেরকে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে অথবা বরণ করে নিতে হয়েছে মৃত্যুকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে আরেক বীরের নাম বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী। জাতির পিতার মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি তিনি। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ১৭ হাজার মুজিব ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে রংপুর চিলমারী পর্যন্ত সাতটি ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে কাদের সিদ্দিকী দীর্ঘ ২২ মাস যাবৎ প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যান। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত হন ১০৪ জন মুজিব প্রেমী যোদ্ধা। নিহতদের মধে যেমন ছিলেন চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ, গাইবান্ধার মুন্না, দুলাল দে বিপ্লব, বগুড়ার সারিয়াকান্দির আবদুল খালেক খসরুর মতো সমতলের মানুষেরা, তেমনি ছিলেন ফনেস সাংমা, অ্যালসিন মারাক, সুধীন মারাকরাদের মতো আদিবাসীরা। জাতির পিতার জন্য যাদের আত্মত্যাগ আমাদের বলে দেয়, বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে জাতির পিতার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে।

প্রায় দুই বছর ব্যাপী চলমান সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে আহত যোদ্ধার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এছাড়াও শুধু পিতা মুজিবকে ভালোবাসেন বলে সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন ও জেল-জুলুমের স্বীকার হন অগণিত যোদ্ধা ।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় মৃতদের তালিকা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্ট সেনা অভিযান চালিয়ে মুক্তাগাছার প্রতিবাদী ৫ মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলী, নিখিল দত্ত, সুবোধ ধর, দিপাল দাস, মফিজ উদ্দিনকে হত্যা করা হয়। সেই অভিযানে বেঁচে যান বিশ্বজিৎ নন্দী নামের এক কিশোর যোদ্ধা। কিন্তু গুরুতর আহত অবস্থায় আটক করা হয় তাঁকে। এরপরই শুরু হয় বিশ্বজিৎ এর দুর্বিষহ জীবন। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার অপরাধে ১৯৭৭ সালের ১৮ মে সামরিক আদালতে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয় ১৯ বছরের তরুণ বিশ্বজিৎকে। ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে ৭ বছর কাটাতে হয় বিশ্বজিৎকে। তবে বিশ্বজিৎ সৌভাগ্যবান। বিশ্বজিৎ এর মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ প্রভাবশালী বিশ্বনেতারা বিশ্বজিৎকে সমর্থন করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সেনা সরকার বিশ্বজিতের ফাঁসি মওকুফ করে তাঁকে যাবজ্জীবন দেয়। পরে ১৯৮৯ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতার ভূমিকা বিতর্কিত হলেও সব নেতাই কিন্তু চুপ করে থাকেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যার কারণে তাঁকে কারাভোগ করতে হয়। এছাড়া আওয়ামী নেতা জাহাঙ্গীর কবীর নানককে বরিশালে থানায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পিটিয়েছে। দীর্ঘদিন অসুস্থ অবস্থায় জেলে ছিলেন তিনি। আ. লতিফ সিদ্দিকী, বজলুর রহমান, মানু মজুমদারও কারাভোগ করেন। চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন তদানীন্তন শ্রমিক নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর সামরিক সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেছিলেন তিনি। এজন্য বিদ্রোহের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তৎকালীন সরকার। সরকারের রোষানলে পড়ে এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নয়, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে দীর্ঘ ১০ বছর কারাভোগ করেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কান্দা গ্রামের আজগর আলী, যিনি পরিচয়ে সাধারণ কিন্তু কর্মের দ্বারা অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দেশের ৮-১০ হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে আজগর আলীও প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে শেরপুরের নকলা উপজেলার ধামনা গ্রামে প্রতিরোধ যোদ্ধার একটি দল গ্রামের একটি বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিলে গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে আজগর আলীকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর কারাবাসই হয় তাঁর নিয়তি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক জান্তা যাকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুগামী মনে করেছে তাঁর ওপরই ধরপাকড় চালিয়েছে। এই কারণে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আবদুর রাজ্জাক ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আরও আছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে নিয়েও অস্বস্তি ছিল সামরিক সরকারের। এই কারণেই তাঁদের কারাবন্দী করা হয়, পরবর্তীতে হত্যা করা হয় অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে।

জাতির পিতার মৃত্যুতে তাঁর সন্তানদের যেমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা ছিল বাংলাদেশে তেমনটি দেখা যায়নি একথা সত্যি। কিন্তু এই বিষয়ে সমালোচনা করার আগে মোশতাক, জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামরিক পরিস্থিতির কথাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতাহীন এক কারাগারে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকায় কার্ফু জারি করা হয়েছে অসংখ্যবার, রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে সেনাবাহিনী। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও ’৭৫ এর ১৮ই অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, মধুর ক্যান্টিনসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার ও দেয়াল লিখনে ভরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানায় ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা৷ এরপর ২০শে অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তৎকালীন ত্রাসের রাজত্বে এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছিল পিতার প্রতি সন্তানের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কারণেই।

এমনকি ১৯৭৬ সালের ২৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনস্থ অফিসের কর্মকর্তা মুহিতুল ইসলাম লালবাগ থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা রুজু করতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু মামলা নেয়নি ডিউটি অফিসার, বরং অফিসারের হাতে চড় খেয়ে বিদায় নিতে হয় মুহিতুল ইসলামকে। এভাবেই অপমান, নির্যাতন, হত্যা ও জেল-জুলুমের মধ্যে চলতে থাকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা দেশে আসলে তার নেতৃত্বে যে প্রতিবাদ আরো গাঢ় হয়।

এই মর্মস্পর্শী ঘটনার প্রতিবাদে শুরুতেই কেন কোনো গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠল না! এই প্রশ্নের জবাবে অনেকে বলেন, ঘটনার আকস্মিকতা এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়া। কিন্তু এই বিষয়ে সমালোচনা করার আগে মোশতাক, জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামরিক পরিস্থিতির কথাও আমাদের বিবেচনা করতে হবে। সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল বাক স্বাধীনতাহীন এক বৃহৎ কারাগারে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকায় কার্ফু জারি করা হয়েছে অসংখ্যবার, রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে সেনাবাহিনী। পিতা মুজিবকে ভালোবেসে সামরিক সরকারের নির্মম নির্যাতন ও জেল-জুলুমের স্বীকার হন অগণিত যোদ্ধা। তৎকালীন ত্রাসের রাজত্বে এসব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছিল জাতির পিতার প্রতি সাধারণ মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কারণেই। বাঙালি অকৃতজ্ঞ নয়, বাঙালি বেঈমান নয়।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/১৫আগস্ট, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

SMS Alert

রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর

রাজনীতি - এর সব খবর