thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

কেউ রাখে না পরিমলের খবর

২০১৪ মার্চ ২৬ ০৯:৫৬:১৩
কেউ রাখে না পরিমলের খবর

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের এক রাত। সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ। সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নির্দেশে জোয়ানরা অস্ত্র উচিয়ে ওঁৎ পেতে আছেন। সামনের নদী বেয়ে শত্রুর গানবোট এগিয়ে আসতেই জিয়াউদ্দিনের ব্রাশ ফায়ার সারেংয়ের শরীর ঝাঁঝরা করে দিল। শুরু হলো উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়।

ঘণ্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বাচায় হানাদাররা। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে প্রায় চারশ মুক্তিযোদ্ধা দখলে নিলেন গানবোট। তাদের একজন বাগেরহাটের রামপাল থানার উজ্জ্বলকুড় গ্রামের রাম লাল শীলের ছেলে পরিমল কুমার শীল।

এর কয়েকদিন পর ওই গানবোটেই সওয়ার হয়ে অনেকের সঙ্গে পরিমলও অংশ নেন মঠবাড়ীয়ার ভয়ঙ্কর যুদ্ধে। সেদিন কমান্ডার জিয়ার নির্দেশে ৫০ জনের একটি দলের সঙ্গে পরিমলও এসএলআর হাতে নিয়ে এসেছিলেন মঠবাড়ীয়ায়। চারদিক থেকে আরও তিনশ মুক্তিযোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশ নেন। দুই রাত-একদিন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে ১২ জন হানাদারসহ ১৫০ জন শত্রু আত্মসমর্পন করে। শত্রুর নৌকা-রসদ ও অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ তাদের দখলে আসে। বিনিময়ে বইতে হয় এক সহযোদ্ধার লাশ।

সে সময় শত্রুদের দেওয়া আগুনে পরিমল হারিয়েছেন পিতৃভিটা। স্মৃতি হাতড়ে জানান, তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ শেষে বশিরহাট ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের অধীনে যুদ্ধ করেন। সেখান থেকে সুন্দরবনের শরণখোলায় কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নির্দেশে বিভিন্ন যুদ্ধাভিযানে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সে সব অভিযানের অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতিতে সাজানো তার জীবন এখন বিবর্ণ।

তিনি দ্য রিপোর্টকে জানান, তার ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা বাবাকে ছেড়ে গেছে। এখন তাকে দেখার কেউ নেই। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন যশোর শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক এলাকার এক ভাড়া বাড়িতে।

দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত ৬৩ বছর বয়সী পরিমল অনেক কিছুই আজ মনে করতে পারেন না। দেহে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। দুই চোখ নষ্ট হতে বসেছিল। সাবেক সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটোর সহযোগিতায় একটি চোখ রক্ষা পেয়েছে। ওই ঝাপসা চোখেই প্রতিদিন জীবিকার জন্য ক্ষৌরকর্ম চালাতে হয়। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি সমস্যা তার শরীরে প্রতিদিন ছোবল বসাচ্ছে। তবুও সংসারের ঘানি বইতে হচ্ছে এ যোদ্ধাকে।

এদিকে স্ত্রী মলিনা রানী মস্তিষ্কজনিত রোগে আক্রান্ত। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছেনা তার। নিত্যদিনের খাবার-ঘরভাড়া জোগাড় হয় না। তাই ভেবে তিনি চোখের জল ফেলেন।

পরিমল বলেন, ১৯৭৭ সালে মাস্টার রোলে ডাক বিভাগের আরএমএস’র চাকরির সুবাধে যশোরে আসা। খুলনায় চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পর যশোরে আসেন। ১৯৯৭ সালে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে চাকরি থেকে অকালে অবসর নেন। পরে সুস্থ হয়ে সিভিল সার্জনের সনদপত্র দেখিয়ে এবং রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়েও চাকরি ফিরে পাননি।

তাকে কাছ থেকে দেখেছেন সাংবাদিক একেএম গোলাম সরওয়ার। তিনি বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখানো নিয়েও চলে ছিনিমিনি খেলা। এমন বৈরি পরিবেশে অনেকের রক্ত আর ঘামে ভেজা এ দেশ ও সমাজ তার কাছে কেবলই অচেনা মনে হয়।’ মুজিব বাহিনীর যশোর অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার আলী হোসেন মনি বলেন, ‘একদিন সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত হবে বলে স্বপ্ন দেখেন পরিমল।’

অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর ৫৫২ জনের একটি তালিকায় তার নাম উঠেছে। তালিকাটি জমা পড়ে আছে যশোর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার টেবিলে। কবে গেজেটের জন্য ঢাকায় পাঠান হবে তা সেখানকার কর্মকর্তারা বলতে পারছেন না। উপরের নির্দেশ এলেই নাকি পাঠান হবে বলে পরিমল জানান।

এ ব্যাপারে যশোর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেল হাসান বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ভেঙে যাওয়ার পর থেকে মাস তিনেক ধরে তালিকাটি আমাদের কাছে রয়েছে। এই তালিকা নিয়ে কিছু আপত্তি উঠেছে। আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসক আপাতত ওটা রেখে দিতে বলেছেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশ মোতাবেক পরবর্তীতে তালিকাটি মন্ত্রণালয় বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পরবর্তী কমান্ড কাউন্সিলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

পরিমল আক্ষেপ করে বলেন, এর আগেও কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম উঠেছিল তার। তবে সেসব তালিকা আর আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৯৬ সালে সরকার বাদপড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্তির উদ্যোগ নেয়। এ তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত করাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৎকালীন এক কর্মকর্তার চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারায় তালিকায় নাম ওঠাতে ব্যর্থ হন।

যশোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ‘২০০৪ সালে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যশোরের সে সময়কার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াজেদ চুলচেরা যাচাই বাছাই শেষে বাদ পড়া ১৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠান। কিন্তু পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত গেজেট আর প্রকাশ হয়নি।’

পরিমল বলেন, এ নিয়ে লেখালেখি হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক সরকারি কর্মকর্তারা দৌড়ঝাঁপও করেন। পরিমল অসুস্থ শরীরে হাজিরও হন তাদের সামনে। তৈরি হয় ওই ৫৫২ জনের তালিকা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরিমলের দাবি যা কিছু করা হয় তা যেন তার মৃত্যুর আগেই হয়। মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম দেখে যেতে চান।

এদিকে স্বাধীনতার ৪৩তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে পরিমল সোমবার থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। বিনা চিকিৎসায় যশোরের টিবি ক্লিনিকের ভাড়া বাড়িতে পড়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। এ খবর কে রাখে?

(দ্য রিপোর্ট/এম/কেএন/ডব্লিউএস/মার্চ ২৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর