thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

 

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের তপ্তবীজ মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

২০১৪ মার্চ ২৬ ১৩:১৫:১৯
কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের তপ্তবীজ
মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

এ কথাটা আগেই বলে নিই, কবিরা তাদের কবিতায় তপ্তবীজ বুনে দিয়ে প্রতিটি বিপ্লবের আয়োজন করে, করেছে। কবিত্ব শক্তিকে ব্যবহার করে সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে তারা। সেই আরব দেশের উদাহরণ টেনেও বলা যায়- তাদের প্রতিটি গোত্রেই একজন প্রধান কবি থাকতেন যে কিনা উদ্বুদ্ধ করত সৈন্য-সামন্তদেরকে। প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে এমন রেওয়াজ। এর ব্যতিক্রম ঘটেনি আমাদের দেশেও। একাত্তরে 'মুক্তিযুদ্ধ' নামে আমাদের যে মহাকাব্য রচিত হল নিপাট গৌরবের- তাতে কবিদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। শব্দে শব্দে আগুনের ফুলকি তুলেছিল আমাদের কবিরা। প্রকৃত পক্ষে আমাদের 'মুক্তিযুদ্ধ' এমন একটা প্রভাব সমাজ জীবনে রেখেছে; যা ওতপ্রোতভাবে আমাদের গৌরবেরই প্রলম্বিত সোনালী শৃঙ্খল, অথবা তা এমনই এক সিলসিলা (পরম্পরা) যা অস্বীকারের কোনো মওকা নেই। অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কবিতা সাহিত্যের একটি প্রধান শাখা। ফলে সে-দিন এই শাখায় কী ধরনের কারুকাজ বিনির্মিত হয়েছিল তা নির্ণিত হওয়া দরকার। সেই সময়কার অধিকাংশ কবিই দুর্বিনীত আবেগের চূড়ান্ত স্থান থেকে কার্তুজের মতো ছুঁড়ে দিয়ে ছিলেন কবিতার শব্দাবলী।

যেমন :

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।

(এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়/ হুমায়ুন আজাদ)

কবিরা তাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও পশ্চিমের হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে শাণিত রেখেছিলেন কলমকে। দ্রোহ ও ঘৃণায় তাদের কলঙ্কের বিরুদ্ধে কবিরা অসংখ্য পঙ্‌ক্তি রচনা করেছেন।

পল্লী কবি জসীমউদ্দীন তার 'দগ্ধগ্রাস' কবিতায় উত্তপ্ত সময়টিকে এভাবে চিহ্নিত করেছেন-
'কী যে কী হইল পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি
সারা গাঁও ভরি আগুনে জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল থেকে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান
পিতার সামনে শিশুরে কাটিল করিল রক্ত স্নান।
কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়, যূপকাষ্ঠের গায়
শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায়'

৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত থেকে বাংলাদেশ জ্বলতে থাকে। সমগ্র দেশ যখন হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত অত্যাচারের দুঃস্বপ্নে প্রোথিত, বাংলাদেশের কবিতায় এর স্বরূপ ফুটে ওঠে বাস্তব হিসেবে। ফলে বাংলাদেশের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রচিত হয়েছে শত শত পঙ্‌ক্তিমালা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় বিশ্বসাহিত্যে নানা ধরনের পরিবর্তন ও প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটি কবিতায় এসেছে বিষয় উপমা মিথ উৎপ্রেক্ষা হিসেবে। দেশ ও সমাজের অঙ্গীকারে সোচ্চার হয়ে ওঠে কবিতা। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নবচেতনার উন্মেষের আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হতে থাকে প্রবলভাবে। কবি হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, শহীদ সাবের, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন কবির, শহীদ কাদরী, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শিকদার আমিনুল হক, অসীম সাহা, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অসংখ্য কবির কবিতায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, মনিরুজ্জামানের গানেও এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জাতীয়তাবাদী চেতনা, স্বদেশপ্রেম এবং মানবতাবাদী আবেগের স্ফূরণ ঘটেছিল তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবিতার বিষয়-আঙ্গিককে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছেন কবিরা। কবি জসীমউদ্দীন 'দগ্ধগ্রাস' কবিতা রচনার পর ফের 'মুক্তিযুদ্ধ' নামেও আরেকটি কবিতা লেখেন। সুফিয়া কামালের 'আজকের বাংলাদেশ' ও শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি', নির্মলেন্দু গুণের 'স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের কীভাবে হলো', রফিক আজাদের 'একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ', সানাউল হক খানের 'সাতই মার্চ একাত্তর', হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা সংকলন, উদ্যত সঙ্গীত, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের 'শহীদ স্মরণে', অসীম সাহার 'শরণার্থী', আবুল হাসানের উচ্চারণবুলি শোকের, হুমায়ুন কবিরের বাংলার কারবালা, আসাদ চৌধুরীর রিপোর্ট ৭১, হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাতাসে লাশের গন্ধসহ অসংখ্য কবিতায় প্রত্যক্ষভাবে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ।

কবি ও শিল্পী মানুষের চেতনালোকে সকলের চেয়ে অধিকতর অগ্রসর। তারা সর্বকালেই সমস্ত চৈতন্য এবং অনুভূতির পুরোভাগে থাকেন। যেমন প্রকৃতির বর্ণ-বৈচিত্র্যকে তারা অনুভব করেন তেমনি মানুষের অস্থিরতা,যন্ত্রণা, আগ্রহ ও প্রশান্তিকে তারা সহজেই অনুভব করেন। তাই সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক এবং সমাজ-জীবনে যে বিপর্যয়টা আকস্মিক, কবি বা শিল্পীর কাছে তা পূর্ব থেকেই অনুভূত। নিশ্চয় এটা লক্ষ্য করা গেছে যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধপ্রস্তুতি, যোদ্ধার ভূমিকা, বর্বর পাকিস্তানী হানাদারের নৃশংসতা, নির্যাতন, আর্তনাদ, অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানসিকতা, পাকিস্তানী বাহিনীর দালালি, মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রাম, মহান বিজয় এসব ঐতিহাসিক দলিল চিত্র অঙ্কন করেছেন প্রবীণ-নবীন কবিরা। সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায়-

'তুমি আমার বাতাস থেকে নাও তোমার ধুলো

তুমি বাংলা ছাড়ো'

মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় কবিরা বিচ্ছিন্নভাবে নয় মাসের ঘটনাপ্রবাহ ধারণ করতে পেরেছেন সার্থকভাবে।
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল অধিকভাবে। ফলে মানবাধিকার অন্বেষণ ও মানবতা প্রতিষ্ঠাই ছিল পদ্যের লক্ষ্য। কবি শামসুর রাহমানের 'তোমাকে পাওয়ার জন্য' কবিতায়-

'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্য
আর কত ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কত দেখতে হবে খাণ্ডব দাহন?'
অবরুদ্ধ দেশে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন আবেগের উচ্চারণ রয়েছে কবির হৃদয়বিদারক আকুতি ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। হুমায়ুন কবিরের কবিতা 'কারবালা'য় গণমানুষের মানসিকতা ও মুক্তিচেতনার উপস্থাপনা একান্তভাবে এসেছে। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে মুক্তির বাণী, যুদ্ধের কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারবালার সেই যুদ্ধের ভয়াবহতার মুক্তিযুদ্ধকে তুলনায় এনেছে-

'কারবালা হয়ে যায় সমস্ত বাংলাদেশ, হায়
কারবালা হয়ে যায়'
বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত কবিতাগুলো সময়ের কবিতা দলিল হিসেবে থেকে যাবে। আধুনিক বাংলা কবিতায় কালক্রমিক অর্থবহতায় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

কবি রফিক আজাদের 'একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ' কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে-
'তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামি অলঙ্কারে সাজাতে
ভীরু কাপুরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে
ধরতে হল শক্ত হাতে মর্টার, মেশিনগান-
শত্রুর বাংকারে, ছাউনিতে ছুড়তে হল গ্রেনেড
আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি'

মহাদেব সাহার কবিতায় হৃদয়ের রক্তক্ষরণের আক্ষেপ ফুটে উঠেছে জোরালোভাবে-
'এতো হত্যা রক্তপাত আমি থামাতে পারি না'
মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, রক্তস্রোত, স্বজন হারানোর কথায় ব্যথিত চিত্রগুলোয় কবির বিক্ষুব্ধ চিত্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অবলীলায়। যেখানে কবিরা হাজারো প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দেশপ্রেমে আত্মত্যাগের মহিমাকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধজয়ের অপার স্বপ্নকে লালন করে-
'বাঁচাও বাঁচাও বলে এশিয়ার মানচিত্র কাতর
তোমার চিৎকার শুনে দোলে বৃক্ষ নিসর্গ নিয়ন'
আল মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্বহারা মানুষের করুণ কান্না ও এশিয়ার মানুষের মধ্যে আন্তরিক সহানুভূতির প্রতিফলনের চিত্র ফুটে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধকালে এ দেশের মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা, বিভীষিকাময় অবরুদ্ধ সময়, সমাসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা, অন্যদিকে মুক্তি ও মৃত্যুর মুখোমুখি সময়, পাকিস্তানী হানাদারের অমানবিক বর্বরতার দৃশ্যাবলী, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা ও দমননীতির রক্তচক্ষুর দৃষ্টির বিপক্ষে বাঙালীর দামাল ছেলেরা অকুতোভয় সাহসীভাবে পাকি. হানাদারদের পরাস্ত করে নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা, নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার দৃপ্তশপথ, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে কবিতাগুলো নিজস্বতা ধারণ করেছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে।
মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য শহীদ হয়েছে। হারিয়েছে স্বজন। মা হারিয়েছে সন্তান, ভাই হারিয়েছে বোন, সন্তান হারিয়েছে মা-বাবা এ দুঃখ-পরিতাপগুলো আবুল হাসানের উচ্চারণগুলো শোকের কবিতায় প্রতিফলিত হয়-
'তবে কি আমার ভাই আজ ওই স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন তিমিরের বেদিতে উৎসব?'
এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে, শত্রুমুক্ত করার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারাই এ কোটি মানুষের ভরসা ও আশার আলো। হুমায়ুন আজাদ 'মুক্তিবাহিনীর জন্য' কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রতি অগাধ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন-
'তোমার পায়ের শব্দে বাংলাদেশে ঘনায় ফাল্গুন আর ৫৪ হাজার বর্গমাইলের এই বিধ্বস্ত বাগানে এক সুরে গান গেয়ে ওঠে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল'
মহান মুক্তিযুদ্ধ হাজার বছরের বাঙালীর অহঙ্কার। বাঙালী জীবনে প্রতিটি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে স্পর্শ করে গেছে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের মহিমায় আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ এ ভূমির জাগ্রত অমর কাব্যের পটভূমি, যেখানে আপামর জনসাধারণের সঙ্গে এ দেশের কবিরাও তাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অসীম সাহার কবিতায় ন্যায়যুদ্ধ, শোকগাথার চিত্র, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যুদ্ধের ভাবনা এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান গভীরভাবে ফুটে উঠেছে-
'এই যুদ্ধ ন্যায়যুদ্ধ, সকলেই তৈরি হয়ে নাও'
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর গৌরবগাথার ইতিহাস। হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার নানা অনুষঙ্গ কবিদের কবিতায় ফুটে উঠেছে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর 'বাতাসে লাশের গন্ধ' কবিতায় কবির স্বজন হারানোর ব্যথায় আকুতি অনুভবের প্রতিফলন ঘটে-
'রক্তের কাফনে মোড়া-কুকুর খেয়েছে যারে শকুনে খেয়েছে সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা'
মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো '৭১ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালীর জীবন ও রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্যে আলোকিত চিরন্তন শিখা হয়ে নতুন উজ্জীবনের সন্ধান দেবে। প্রেরণা জাগাবে মননে মেধায়।


বাংলা কবিতার পাশাপাশি বিশ্বকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে ভিনদেশীয় কবিদের কবিতায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালান গ্রিন্সবার্গ 'যশোর রোডে সেপ্টেম্বর' শিরোনামের কবিতায় প্রকৃত চিত্র, জনদুর্ভোগের জীবনযাপন উঠে এসেছে দৃঢ় বলিষ্ঠভাবে-
'লক্ষ লক্ষ আত্মা উনিশ শ একাত্তর
যশোর রোডে ঘরহীন উপরে সূর্য ধূসর
দশ লক্ষ মারা গেছে আর যারা পারছে
পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতার দিকে হাঁটছে।'
'৭১ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বন্ধু-শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের 'ও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ'-এর গানে ভয়াবহতায় নিমজ্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মৃত্যুঞ্জয়ী আত্মত্যাগ ও মহিমা ফুটে উঠেছে।
জর্জ হ্যারিসনের গানে-
'হাজার হাজার সহস্রলোক
মরছে ক্ষুধায়
দেখিনি তো এমন নির্মম ক্লেশ
বাড়াবে না হাত বল ভাইসব
কর অনুভব
বাংলাদেশের মানুষগুলোকে
ও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ
এত দুর্দশা
এ যন্ত্রণার নাই কোনো শেষ
বুঝিনি তো এত নির্মম ক্লেশ'
মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের প্রতিটি বাঙালীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অধ্যায়। সেদিক থেকে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বীরত্বগাথা বা মহাকাব্য রচিত হয়নি। যদিও যুদ্ধবিধ্বস্ত দুঃস্বপ্ন, সাহস ও বিক্রমের নতুন মাত্রার শিল্পিত বিবরণ, গৌরব ও আত্মদানের ফলাফল, যুদ্ধবিজয়ের বহুমুখী বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা এ দেশের কাব্যধারায় স্বতন্ত্র ও যথার্থ কণ্ঠধ্বনির আপসহীন কাব্য নিদর্শন। কবিতাগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ, ঐতিহাসিক ভিত্তিতে স্বকীয় সত্তায় গৌরবময় মহিয়ান হয়ে আছে। নয় মাসে জীবন ও মৃত্যুর সার্বক্ষণিক দেখা দেয় উপলব্ধিতে। শিল্প-সাহিত্যে এক নতুন ভাবনার উন্মেষ ঘটে চরম অভিজ্ঞতায়।

গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি ক্ষেত্রে সঞ্চার করেছে নতুন এক মাত্রা। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিষয় ও আঙ্গিক উভয় প্রান্তেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেখা দেয় নবতর এক শিল্পভাষা। একাত্তর-পরবর্তীকালে, মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম ও বিজয়ের অবিমিশ্র অভিব্যক্তি, যা একান্তই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। দীর্ঘ সিকি শতাব্দী ধরে নিজেকে শনাক্ত করার যে সাধনায় বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তার সাফল্যে সাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণে যুদ্ধোত্তর কালে এসেছে নতুন মাত্রা। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি প্রকরণ-পরিচর্যায়ও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি ঘটেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচিত হয়েছে, কখনো-বা সাহিত্যের বিষয়াংশ সৃষ্টি হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিস্নাত হয়েছে।

আমরা আগেই বলেছি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কবিরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন এক-একজন শব্দযোদ্ধা। একাত্তরের অগ্নিগর্ভ সময়ে শোণিতাক্ত শব্দে আমাদের কবিরা বাণীবদ্ধ করে রেখেছেন তখনকার আপন অনুভূতি। এমনি অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন "আমরা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুম থেকে চিৎকার করতাম কোনো কোনো রাতে। বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্ককে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে। এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারি না, যেদিন হত্যা কিংবা ধর-পাকড়ের কোনো-না-কোনো খবর কানে না এসেছে। সেই নরকবাসের সাক্ষী হয়ে আছে তখনকার লেখা। স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের কবিদের নতুন কাব্যরূপ সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেছে, তার পরিচয় পাই কবি আল মাহমুদের উচ্চারণে "গত কয়েকমাস আমার স্বদেশভূমি স্বাধীনতার যুদ্ধে রক্তাক্ত হয়েছে।বাংলাদেশকে স্বৈরাচারী বর্বরতার হাত থেকে মুক্ত করার এই সর্বাত্মক যুদ্ধে আমার দেশবাসী প্রতিটি তরুণ-তরুণীর সাথে আমিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এ ব্যাপারে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এ ছিল বাঙালী জাতির অস্তিত্বের লড়াই।"

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী কবিদের চৈতন্যে তুলেছিল প্রবল অভিঘাত। ফলে এমন কোনো কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো-না-কোনো কবিতা লিখেছেন। অগ্রজ থেকে অনুজ- সকল কবির হাতেই শিল্পিতা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানামাত্রিক চেতনা। বাংলাদেশের কবিতার অন্তরঙ্গে যেমন মুক্তিযুদ্ধের সঞ্চারিত হয়েছে, তেমনি তার বহিরঙ্গেও উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা-পরবর্তী কবিতায় এমন কিছু শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়, যা একান্তই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। এ সব শব্দের মধ্যে আছে বুলেট, বেয়নেট, রাইফেল, মর্টার, অ্যামবুশ, গেরিলা, বধ্যভূমি, ট্রিগার, য়ুনিফর্ম, হেলমেট, বারুদ, বুট, আল বদর, রাজাকার ইত্যাদি। উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প নির্মাণেও বাংলাদেশের কবিতায় এল মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অনুষঙ্গ। যেমন-

ক. চকিতে অক্ষরগুলো পাতা থেকে দ্রুত

তুমুল বেরিয়ে পড়ে, বুঝি

জঙ্গী ট্রাক থেকে ঝুপঝাপ

লাফিয়ে নামছে সৈন্যদল।

(শামসুর রাহমান / 'অস্থি')

খ. সল্টলেক একাকী ঘুমিয়ে আছে
যেন পরিত্যক্ত দেশ-প্রেমিকের খালি বাড়ি
রাজাকার, আল-বদরের ভয়ে ভীত,
মৃত ম্রিয়মাণ।

(নির্মলেন্দু গুণ / 'সল্টলেকের ইন্দিরা')

গ. স্বাধীনতা সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।
(রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ / 'বাতাসে লাশের গন্ধ')

মুক্তিযুদ্ধ নতুন শিল্পভাষ্য নির্মাণ করেছে এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভবিষ্যতেও নির্মিত হবে আরো অনেক শিল্প-আখ্যান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া, মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ-অবিনাশী শিল্পউপাদান। আবেগ যেমত সমাপ্ত হবার নয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের তপ্তবীজ দীর্ঘকাল রোপিত হবে আমাদের কবিতায়-সন্দেহাতীতভাবে এ কথা বলা যায়।

কবিদের এমত সৃজনশীলতা একদিকে রক্ষা করে চলেছে প্রকৃত ইতিহাসকে এবং অন্যদিকে জাতিসত্তার অহঙ্কারকে উপস্থাপিত করেছে মীমাংসিত অবয়বে। ইতিহাসের যাবতীয় তর্ক ও অমীমাংসা আমাদের কবিদের সৃষ্টির পরিবৃত্তে প্রকৃত সমীকরণের উপসংহার টেনে দিয়েছে। সে জন্য এখনও আমরা ফিরে যাই আমাদের কবিতার নিকটে যেখানে শব্দযোদ্ধারা পরিণত হন একেকজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধায়।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর