thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৪ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

‘সবাই বাঁচার শেষ চেষ্টা করছিলেন’

২০১৪ মার্চ ২৬ ২১:৪৩:০৯
‘সবাই বাঁচার শেষ চেষ্টা করছিলেন’

মানুষ কেবল ছুটছিল আর ছুটছিল। যে যেখানে পেরেছে ছুটেছে। অনেকেই রক্তাক্ত। তারপরও জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছিলেন তারা।

২৫ মার্চ সেই ভয়াল রাতের কথা দ্য রিপোর্টের কাছে বর্ণনা করলেন তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী সত্তরোর্ধ্ব মমতাজ বেগম। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়; ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তিরও সাক্ষী তিনি। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের বাসিন্দা মমতাজ বেগম ২৫ মার্চও ওই এলাকায় বসবাস করতেন।

সেই কালরাত্রি সম্পর্কে মমতাজ বেগম বলেন, ‘চারদিকে খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। আমার বাবা শেখ তাইজুদ্দিন ভয়ে বাড়ির সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন। আমরা ছাদে উঠে লুকিয়ে দেখি মানুষ যে যার মতো পালাচ্ছে। অনেকের শরীরে গুলি লেগেছে। তারপরও জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন তারা।’

‘সারারাত গোলাগুলি চলেছে। আম্মা রান্না করেছিলেন কিন্তু কেউই রাতে খেতে পারেনি। রাতে আমাদের চোখে ঘুম ছিল না। শুধু নামাজ পড়েছি, আল্লাহর নাম নিয়েছি। আল্লাহর রহমতে আমাদের বাড়িতে পাকবাহিনী হামলাও করেনি। ২৬ মার্চও আমরা কেউই বাড়ি থেকে বের হইনি। বাবা শুধু খবর শুনতে চাইতেন। তখন তো টেলিভিশন ছিল না। তাই বাংলাদেশ বেতার শুনতাম। কিন্তু বাংলাদেশ বেতারে শুধু পাকিস্তানিদের পক্ষের সংবাদ শোনাতো’ যোগ করেন তিনি। মমতাজ বেগম বলেন, ‘২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠিয়ে নিলে বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওয়ানা হন। আমরা হাতের সামনে যা পেয়েছি তাই নিয়েই রওনা হই। তখন সবাই ছোটাছুটি করছিল। কোনো যানবাহন ছিল না, লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ার জন্য যে যার মতো হেঁটে রওয়ানা হন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য আমার মামা একটি স্পিডবোট পাঠিয়ে দেন। পোস্তগোলা ঘাটে গিয়ে আমরা ও আমাদের আরও কয়েকজন আত্মীয় বোটে উঠি। নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের বোটে উঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার বাবাসহ বাকি পুরুষরা ঢাকায় রয়ে যান। ঘাট থেকে বিক্রমপুরের শ্রীনগরে রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কারফিউ শেষ হয়। তখন অনেকেই আমাদের যেতে মানা করেছিলেন। কিন্তু আওয়াজ যাতে না হয় সে জন্য স্পিড বোট আস্তে আস্তে চালিয়ে আমরা গ্রামে পৌঁছাই। সেখানে অনেক দিন ছিলাম। শ্রীনগর থানায় পাকিস্তানি মিলিটারি তাদের ক্যাম্প করে। মিলিটারিরা যখন লেফ্ট-রাইট করত, আমাদের বাড়ি থেকে তা স্পষ্ট দেখা যেত। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে খালপাড় ছিল। সেখান দিয়ে ট্রলারে করে পাকবাহিনীরা প্রতিনিয়ত যাতায়াত করত। আমি তখন ১০ম শ্রেণীতে পড়ি। আমি, আমার ছোট বোন ও খালাদের কথা চিন্তা করে বাবা আমাদের অনেক ভেতরে হোগলাগাঁও নামক গ্রামে এক খালার বাসায় পাঠিয়ে দেন।’‘পরে জানতে পারি আমাদের বাড়ির আশপাশের অনেক হিন্দুবাড়ি পাকবাহিনী আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ জন্য আমার মা নাইলনের রশি হিজল গাছের সঙ্গে বেঁধে আমাদের সব আসবাবপত্র পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে রাখেন। এরপর বাবা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাদের আরও ভেতরে কোনাবাড়িতে আমার এক নানীবাড়িতে পাঠিয়ে দেন’ বলেন তিনি।মমতাজ বেগম বলেন, ‘একদিন শুনতে পেলাম মুক্তিবাহিনী শ্রীনগর থানা দখল করে ফেলেছে। এ খবর শোনার পর আমরা বাড়িতে ফিরে আসি। মুক্তিবাহিনী প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া করত। আম্মা ও নানী মুক্তিবাহিনীর জন্য রান্না করে দিতেন। আমরা তো সামনে আসতাম না।

কিন্তু লুকিয়ে দেখেছি আমার ছোট তিন ভাইকে তারা স্টেনগান চালানো শেখাতেন। ডিসেম্বর মাসে পাকবাহিনী খালপাড় দিয়ে পার হতে গেলেই মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করত। তখন দেখেছি মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে একটি গরু জবাই করার বড় ছুরি ছিল। পাকবাহিনীর অনেক সৈন্যকে জবাই করে মুক্তিবাহিনী সেই ছুরিটির সদ্ব্যবহার করেছে। আমাদের পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা সবাইকে বিজয়ের পর দেখেছি। কিন্তু একজনকে আর দেখতে পাইনি। তিনি মারা গেছেন কিনা তা কেউ কিছু বলতে পারেনি। সবাই বলে তিনি নিখোঁজ। ৯ মাস যুদ্ধের পর বিজয় পেলে জানুয়ারিতে আমরা আবার ঢাকায় এসে নতুন করে জীবন শুরু করি।’

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এনডিএস/এজেড/মার্চ ২৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর