thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

 

পহেলা বৈশাখ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিক নির্দেশক মামুন রশীদ

২০১৪ এপ্রিল ১৪ ১৭:৩২:৪৩
পহেলা বৈশাখ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিক নির্দেশক
মামুন রশীদ

অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন থেকে আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাঝে ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার আনন্দ পেরোতে না পেরোতেই আমরা হারিয়েছি ধর্মনিরপেক্ষতার পথ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবার সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায়। সংবিধানে সংযোজিত হয় রাষ্ট্র ধর্ম। ফলে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার— শ্লোগান, যা ধারণ করে বাঙালী মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা হারিয়ে যায়। বাকী ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা— যা আমাদের এই মাটি, আলো, হাওয়া, রৌদ্রের ভেতর থেকে উঠে আসা। তাকেও কেমন তিলে তিলে মিশিয়ে দিতে দিতে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ মেরে দেবার চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। দেশের ভেতরে-বাইরে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের তকমা এঁটে দিতে আমাদের কত না ফিকির। এর উল্টোটাই হবার কথা ছিল। অথচ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের পরিচিত হওয়ার সম্ভাবনা এখনো অপার।

জাতিগতভাবে আমাদের ভেতরে যে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা, তা এখনো আমাদের সত্ত্বায় জেগে আছে। জেগে যে আছে, হারিয়ে যায় যে যায়নি, বাঙালী যে অসাম্প্রদাকিতার পতাকা এখনো লালন করে বুকের নিভৃতে— এই সত্য উপলব্ধি হয় পহেলা বৈশাখে। বাঙালীর প্রাণের এই উৎসব— পহেলা বৈশাখই মনে করিয়ে দেয় আমাদের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার কথা। বারো মাসের তেরো পার্বণের বাঙালীর জীবন থেকে নানা কারণে যদিও হারিয়ে যাচ্ছে উৎসবের রং। আমরা আটকে পড়েছি দিবসের ফাঁদে। আমাদের উৎসব-পার্বণ হয়ে উঠছে দিবসকেন্দ্রিক। দিবসকে কেন্দ্র করেই বাঙালী আজ ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। নিজেকে উজাড় করে মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে আবার ফিরে আসা ঘরে। কিন্তু এতে কি মেটে প্রাণের তৃষ্ণা?

পৃথিবীর সব সমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যবাহী জাতিরই রয়েছে নিজেদের নববর্ষ, নিজস্ব ক্যালেন্ডার। আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব একটি বর্ষপঞ্জি। সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাসের প্রচলনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও নববর্ষ পালিত হতো বিচ্ছিন্নভাবে। পহেলা বৈশাখ আমাদের বাংলা নতুন বছরের প্রথম মাস। বিশাখা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে আসা এই নামের মধ্য দিয়েই বাঙালীর জীবনের উৎসবের শুরু। সম্রাট আকবরের সময় খাজনা আদায়ের জন্য ব্যবহার হতো হিজরী পঞ্জিকা। চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল হিজরী বর্ষপঞ্জি আমাদের জীবনের সঙ্গে মেলে নি। ফলে অসময়ে কৃষককে খাজনা পরিশোধে সমস্যায় পড়তে হতো। এ থেকে পরিত্রাণের জন্যই বাংলাপঞ্জির নবরূপ।

সম্রাট আকবরের নির্দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী ১৫৮৪ সনে সৌর সন এবং হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলাপঞ্জি পুনর্বিন্যাস করেন। আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা সন গণনারীতি শুরু হয়। এক সময়ে ফসলী সন হিসেবে পরিচিত এই বর্ষপঞ্জি পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত। বৈশাখে নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু নতুন বছরের। আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এক সময় দিনটি পালিত হতো আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই উৎসব কালক্রমে আজ আমাদের সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষাভাষিরা এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে। চেষ্টা করে অতীতের দুঃখ-গ্লানি ভুলতে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে এবং ভারতে চন্দ্রবর্ষ অনুসারে সাধারণত ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বাঙালীর জীবনে নতুন বছরের উৎসবে যোগ হয় আমাদের জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। মানুষ বাড়িঘর পরিষ্কার করে, বন্ধু-আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে যায়, বিশেষ খাবারের আয়োজন করে। মানুষ একত্র হয়, মিলন মেলা গড়ে ওঠে। সেখানে আমাদের ঐহিত্যের অংশ নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আয়োজন চলে। গ্রামের এই উৎসবের মতো এখন নগরেও বৈশাখে বসে মিলন মেলা। রমনার বটমূলে ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন সূর্যকে আহবান আর ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রাও এখন আমাদের উৎসবের অংশ। পহেলা বৈশাখের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। সেইসঙ্গে পান্তা-ইলিশও হয়ে উঠেছে বৈশাখের অন্যতম অংশ। ফলে নানা উৎসবের আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা পহেলা বৈশাখের উৎসব আজ পরিণত হয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠানে।

গতিশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা অনেকক্ষেত্রেই হারিয়ে ফেলছি ছন্দ। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি ঐতিহ্য থেকে। এ রকম ধারণা আমাদের মাঝে গেঁথে দেবার চেষ্টা হলেও তা যে খুব বেশি হালে পানি পায় নি, তার উদারহরণ দিবসভিত্তিক আমাদের উৎসবগুলো। শুধু পহেলা বৈশাখই নয়, আমাদের স্বাধীনতা দিবস, আমাদের বিজয় দিবস, ভাষা শহীদদের স্মরণে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবসে— ঢাকা শহরেই নয়, সারাদেশেই মানুষ ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। দিবসভিত্তিক এই দিনগুলোতে নারী-পুরুষ-শিশুদের উৎসবের রঙে মেতে ওঠার উচ্ছ্বাস মনে করিয়ে দেয়, দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মানুষ স্বস্তি চায়। অথচ সকালে পথে বেরিয়ে আসা এই মানুষগুলো যখন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায়, তখন তাদের মনে কি সত্যিকার অর্থেই থাকে উৎসবের রং? তারা কি রাঙিয়ে নিয়ে যেতে পারে নিজেদের নতুন কোনো রঙে? যে রং তাকে, তাদের এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে দেবে? সত্যিকার অর্থে সে রকম কোনো দিকনির্দেশনা আমাদের নেই। সেই দিক দেখানোর কেউই আমাদের মাঝে নেই।

আমরা এখন প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজেদের বলার কথা। অন্যের শেখানো বুলি, আর অন্যের ভাব ধার করে আমরা নিজেদের প্রকাশ করছি। ফলে আমাদের নিজস্বতা বলে থাকছে না কিছুই। সাধারণ মানুষও তার নিজের কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। একটি জাতি যখন চাইবার ভাষা হারিয়ে ফেলে তখন জাতি হিসেবে তাদের মৃত্যু ঘণ্টাই বেজে ওঠে। আমরা একদিকে যেমন রাজনীতির ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি হারিয়ে ফেলেছি আমরা কোথায় যেতে চাই— সেই পথ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষ এখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সামষ্টিক হবার আগ্রহ সে খুইয়ে ফেলছে দিক নির্দেশনার অভাবে, কাণ্ডারীর অভাবে। অথচ দিবস ভিত্তিক দিনগুলোতে পথে নেমে আসা মানুষ দিন শেষে শুধু ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরতে চায় না। তারও মনের ভেতরে গুণগুণ করে— এগিয়ে যাবার ইচ্ছে। ব্যক্তি মানুষের এই ইচ্ছেকে যদি আমরা সমষ্টির রূপ দিতে পারি তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাবার পথ সুগম হয়। আমাদের নিজেদের ফিরে পাবার সেই পথ প্রশস্ত হতে পারে পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসবের ভেতর দিয়ে। আর এই এগিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন মুক্ত মন। শুরুতে যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছিলাম, সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের ফিরিয়ে দিতে পারে পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে এ ধরনের উৎসবের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা যত বাড়বে— আমাদের মুক্ত মানুষ হয়ে ওঠার পথ তত বেশি মসৃণ হবে। আর মুক্ত মানুষই পারে দেশকে সত্যিকারের ভালোবাসতে, দেশকে এগিয়ে নিতে। এবারের পহেলা বৈশাখের উৎসব হোক আমাদের সেই চলার পথের সেতু।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর