thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১০ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

হালখাতা ও ময়মনসিংহের কিচ্ছা গান ড. আমিনুর রহমান সুলতান

২০১৪ এপ্রিল ১৪ ২২:২৫:১০
হালখাতা ও ময়মনসিংহের কিচ্ছা গান
ড. আমিনুর রহমান সুলতান

বাংলা নববর্ষের সঙ্গে হালখাতার আনুষ্ঠানিকতা সম্পৃক্ত। অসম্প্রদায়িক উৎসবের মধ্যে প্রাণের এবং বাঙালীর মহামিলনের উৎসব বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা দেশ ছিল। ফলে গোটা বাংলাদেশটাই গ্রামজীবন ও সংস্কৃতি ভিত্তিক পরিচালিত হতো। গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতি লোকসংস্কৃতি ধারা বিকশিত ছিল। বাংলা নববর্ষের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের লোকসংস্কৃতির প্রভাব এ কারণেই দারুণভাবে প্রতিফলিত।বাঙালী-হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবারই মিলনক্ষেত্র ছিল নববর্ষকে কেন্দ্র করে লোক-অনুষ্ঠানমালায়। এখনও তার ব্যতিক্রম নয়। হালখাতা লোক-আচার-অনুষ্ঠানের অন্যতম উপাদান। আর এই হালখাতা অনুষ্ঠিত হতো নববর্ষকে কেন্দ্র করে। হালখাতার আয়োজক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক আর নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা হলেন ক্রেতা। বিশেষ করে যে সব ক্রেতা সারা বছর সাংসারিক এবং অন্যান্য প্রয়োজনে বাকীতে পণ্য কেনাকাটা করত।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান ‘হালখাতা’কে বছরের হিসাব-নিকাশ চুকানোর আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নিরূপণ করেছেন— যা সবার কাছেই যথার্থ বলে মনে হবে। হালখাতা অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ নির্মল আনন্দেরও খোরাক পেত। তা ছাড়া সামাজিক মর্যাদারও এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেত। শামসুজ্জামান খান যথার্থই বলেছেন, “শুধু অর্থনৈতিক অনুষ্ঠান বলেই এর গুরুত্ব বেশী ছিল তা নয়; এর সামাজিক গুরুত্ব ছিল অনেক।” প্রসঙ্গটাকে তিনি আরও খোলাসা করেছেন এভাবে, “যিনি নববর্ষের হালখাতার দিনে দোকান বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করে হিসাব হালনাগাদ করতে পারতেন তিনি শুধু দোকান বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে মিষ্টিমুখ করেই ফিরতেন না— আত্মমর্যাদা ও গর্ব নিয়েও ফিরতেন। আর যিনি এই বকেয়া শোধ করতে অপারগ হতেন তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতো এবং তাঁকে লোকসমক্ষে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকতে হতো।” [শামসুজ্জামান খান, বাংলাদেশের উৎসব, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৩]

হালখাতাকে কেন্দ্র করে মালিক শ্রেণী তিন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্ব দিতেন— এক. ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নানান আঙ্গিকে সাজসজ্জা। এই সাজসজ্জায় প্রতিফলিত হয় লোকশিল্পের নানা মোটিভ। দুই. মিষ্টি মুখ করানো ও পান সুপারীর আপ্যায়ন। তিন. লোকগান। আর এই লোকগানে পরিবেশিত হতো বাউল গান, বিচার গান, কবি গান, কিচ্ছা গান প্রভৃতি।

বর্তমানে হালখাতার আনুষ্ঠানিকতা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ফলে হালখাতাকে কেন্দ্র করে লোক-আচার-অনুষ্ঠানেরও বিলুপ্তি ঘটছে বলা যায়। তারপরও ময়মনসিংহে গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও বিশেষ করে মিষ্টির দোকানে, মনিহারীর দোকানে, ওষুধের দোকানে এখনো হালখাতার প্রচলন রয়েছে।

এই হালখাতাকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায় কিচ্ছা গানের ঐতিহ্য ক্ষীণ ধারায় হলে প্রবহমান। ময়মনসিংহের কিচ্ছা গানের বয়াতী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন গৌরীপুরের মেডুলার সহর আলী বয়াতী, ঈশ্বরগঞ্জের পাথর আলী বয়াতী। তাঁরা মৃত্যু বরণ করলেও ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের উত্তরাধিকার বা শিষ্য তৈরী করে গেছেন। এক্ষেত্রে ঈশ্বরগঞ্জের ফরিদ বয়াতী, হারুন বয়াতী ও গৌরীপুরের শামীম বয়াতী অন্যতম।

কিচ্ছা গান পরিবেশনায় থাকেন একজন বয়াতী এবং কয়েকজন দোহার বা পাইল। গত শতকের আশি ও নব্বই-এর দশকেও সহর আলী কিংবা পাথর আলী বয়াতীরা যখন কিচ্ছা গান পরিবেশন করতেন তখনও বাদ্যযন্ত্রের বা লোকপোশাকের ব্যবহার ছিল না।

বয়াতীর গায়ে জড়ানো থাকত একটি চাদর। এই চাদরেই নানান চরিত্রের উপযোগী পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যেমন— বধূর ঘোমটা পরা অবস্থা বা কোনো নারীর শাড়ি পরার পরিবেশ বুঝানোর ক্ষেত্রে একমাত্র চাদরই ছিল অন্যতম উপাদান। চাদর দিয়েই নারীর কুচি দিয়ে পরা শাড়ির কারুকাজকে এমনভাবে দর্শকদের মাঝে উপস্থাপন করতেন যে, দর্শকরা আনন্দে মোহিত হয়ে হাসিতে ও হাত তালিতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন।

লোকবাদ্য ছিল না বটে, তবে হাত ও মুখ দিয়ে তাঁরা নানান ধরনের লোকবাদ্যের সুরময় ধ্বনি সৃষ্টি করতে পারতেন। কিচ্ছার ফাঁকে ফাঁকে এই ধরনের পরিবেশনা দর্শকদের বাড়তি আনন্দ যোগাত। দোহাররা একই সঙ্গে সুর তোলার সঙ্গে সঙ্গে কখনো কখনো হাতের মাধ্যমে লোকবাদ্যযন্ত্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করতেন।

বয়াতীর চাদর ছাড়া আরেকটি উপাদান প্রায় সব সময় থাকত, তা হল বালিশ। এই বালিশ দিয়েই ঘোড়া বানিয়ে বয়াতী ঘোড়া দৌড়িয়ে দর্শকদের মন কেড়ে নিতেন। বালিশই বিভিন্ন পাত্রের চাহিদা পূরণ করত।

বর্তমানে কিচ্ছা গানের পরিবেশনায় সংযোজন হয়েছে বিভিন্ন লোকবাদ্য যেমন— হারমোনিয়াম, বাঁশি, ঢোল, করতাল, চটি, খুনজুড়ি প্রভৃতি এবং লোকপোশাক যেমন— নকশা করা ও জরি জড়ানো রেশমের শাড়ি, ওড়না, ক্যাপ, লুঙ্গি প্রভৃতি। আর বালিশ তো আছে। বালিশকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। কিচ্ছা গানে বয়াতীর হাতে বালিশ না থাকলে কিচ্ছা যেন জমেই ওঠে না। এ ছাড়াও লোকখেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠের বা প্লাস্টিকের শিশু, ফকির বা দরবেশের হাতের লাঠি।

এক্ষেত্রে নেত্রকোণার কেন্দুয়া অঞ্চলের ‍কুদ্দুস বয়াতী পথিকৃতের কাজটি করছেন। তিনিই যুগের চাহিদার কথা ভেবে কিচ্ছা গান পরিবেশনকালে ব্যবহার করতে শুরু করেন উপর্যুক্ত বাদ্যযন্ত্র ও পোশাক। তারই ধারাবাহিকতা প্রবহমান।

ময়মনসিংহের অনেকগুলো কিচ্ছার গান এখনো পরিবেশিত হয়ে আসছে। কিচ্ছাগুলো হল— ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, দস্যু কেনারাম, চন্দ্রাবতী, দেওয়ানে ভাবনা, কাজল রেখাসহ আলমাছ গুলরেহান পরী, সুন্দরমতি আমীর সাধু, বাদুর খাঁ চিমুরাণী, বীরাঙ্গনা সখিনা, গুলেহরমুজ, মতি লাল বাদশা, শাহ এমরান চন্দ্রবান, মায়ের কোলে কাঠের পুতুল, গাজী কালু চম্পবতী, কমলা রাণী, অসমা, মিল্লিক বাহাদুর, তাজের মিল্লিক, হারুনুর রশীদ, ফিরোজ খাঁ দেওয়ান, হরবুলা সুন্দরী রূপকুমার প্রভৃতি।

অধিকাংশ কিচ্ছার মধ্যে মধ্যযোগীয় সাহিত্যের বিয়োগান্তক কাহিনী এমনভাবেই পরিবেশিত হয় যে, পাশ্চাত্যের ট্র্যজেডি ধারার কাহিনীকেও হার মানায়। শুধু তাই নয়, বিয়োগান্তক কাহিনীগুলো বাঙালীর বা বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। রূপকথার রাজ্যে কে না প্রবেশ করতে চায়। কিচ্ছায় এমন সব রূপকথা আছে যা বাস্তব নয়, তারপরও রূপকথার রাজ্যে প্রতিটি দর্শকই ভ্রমণ বিলাসী হয়ে ওঠেন। সন্তান না হওয়ার যন্ত্রণা একমাত্র নারীই উপলব্ধি করতে পারেন। অধিকাংশ কিচ্ছায় নারীর মা হয়ে ওঠার বাসনা এবং সে বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্যে পীর-ফকীরের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেয় যা, লোক-আচার ও বিশ্বাসের পরিপোষক।

গর্ভবতী মায়ের দশমাস পূর্ণ হওয়ার কালটিতে নানান ধরনের রীতি এবং লোকখাদ্যের প্রতি আগ্রহ আবহমান বাঙালী রমণীর স্বরূপকে তুলে ধরে। যেমন— গর্ভবতী অবস্থায় আচার খাওয়া কিংবা পুড়া মাটির টিকলী খাওয়ার উপস্থাপনায় বয়াতী দর্শকদের মাঝে রস সৃষ্টিতে নানান ভঙ্গিমা করে থাকেন। বয়াতী একই সঙ্গে গায়ক, কথক, নৃত্যক, ও অভিনেতার ভূমিকা পালন করে থাকেন।

তামাশা করার ক্ষেত্রে বয়াতী যত পারদর্শী হন, দর্শকরা ততই মোহিত হন। বয়াতীর সঙ্গে অনেক সময় সঙ্গ দেন দোহারদের মধ্য থেকে একজন ডায়না। কিচ্ছার ফাঁকে ফাঁকে ডায়না ও বয়াতীর রসপূর্ণ কৌতুক দর্শকদের দম ফাটানো হাসির উদ্রেগ করে।

বাংলা নববর্ষ এখন আর গ্রামীণ নয়। গ্রাম থেকে শহরে ওঠে এসে শাহরিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আবার গ্রামে পরিব্যপ্ত। হালখাতার প্রায় বিলুপ্তি ঘটলেও নববর্ষের বা বৈশাখী উৎসবের আয়োজনের কমতি নেই গ্রাম বাংলায়। ফলে নববর্ষের বা বৈশাখী উৎসবের আয়োজনে কিচ্ছা গান নতুন আঙ্গিকে পরিবেশিত হচ্ছে।

লেখক : কবি ও গবেষক। উপপরিচালক, গবেষণা উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
amitrakkhar@yahoo.com

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর