thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

দেশজ দায়বদ্ধতার ছবি ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’

২০১৪ জুন ২২ ২২:৩৭:২৯
দেশজ দায়বদ্ধতার ছবি ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’

মুহম্মদ আকবর, দ্য রিপোর্ট : বাস্তব কাহিনীকে কবিতার ফ্রেমে আবদ্ধ করা কঠিন। অনেকাংশে চ্যালেঞ্জও বটে। কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতাটি রচনা করলেন তখন তিনি একজন আপাদমস্তক কবি। ধ্যান জ্ঞান শুধুই কবিতাকে নিয়ে। সুতরাং কঠিনকে সহজতর রূপে প্রকাশ করা তো তারই কাজ। এ রকম অন্যদেরও। কবি গুণ সেটা সফলতার সঙ্গে করেছেন এবং সে কারণেই হয়ত কবিতাটি পাঠক নন্দিত হয়েছে। কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘নেকাব্বর’ বাঙালি শিক্ষিত জনসমাজের প্রিয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের মানসপটে একটা স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছে। কবি মাসুদ পথিক প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে কবি গুণের সেই ঐতিহাসিক কবিতা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণকে’ উপজীব্য মনে করেছেন। নিঃসংকোচে বলতে হয়, মানুষের মানসপটে আঁকা ‘নেকাব্বরকে’ বৃহৎ পরিসরে তাদের সামনে উপস্থাপন করা মাসুদ পথিক-এর জন্য এক বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ। নির্দিষ্ট বাজেটে সেই কাজ সমাপ্ত করা তো আরও বড় প্রতিবন্ধক। তবুও মাসুদ পথিক চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন এবং অনেকাংশেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সৃজনশীল দর্শকের পাশাপাশি কবি নির্মলেন্দু গুণকেও সে নির্মাণ আনন্দ দিয়েছে। বলাকা-২ সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পর কবি গুণ চোখের জল মুছতে মুছতে এমন অভিমতই ব্যক্ত করেন। বন্ধু নেকাব্বরের সঙ্গে তার স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোকে একই ফ্রেমে দেখে আবেগকে সামলাতে পারেননি। কেঁদে ফেলেন। তাহলে এই চলচ্চিত্রটিতে কী আছে? কোন বিষয়টা একজন দেশের প্রধানতম কবিকে কাঁদাতে পারে? একজন লেখকের ইমোশনের জায়গাকে তাহলে মাসুদ পথিক পুরোপুরি ধরতে পেরেছেন কি?

বিষয়টাকে সহজ করার জন্য সিনেমা সম্পর্কে খানিক জেনে নেওয়া যেতে পারে। প্রথমেই একটি ক্লোজ শট- শিশির ভেজা ঘাসের এক মনোরম চিত্র। তারপর একের পর এক বৈচিত্র্যপূর্ণ চিত্রগ্রহণ। কবি রেলওয়ে স্টেশন থেকে নামলেন নিজের বাড়ি যাবেন বলে। খানিক হেঁটে সামনে দেখতে পান অনেকগুলো মানুষ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবি ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে তার সেই কৈশোরের সতীর্থ নেকাব্বরের লাশ শিশির ভেজা ঘাসে বড় অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে দেখতে পেলেন। বেদনায় পাথর হয়ে যান কবি। এক অন্তহীন ভাবনা নিয়ে তিনি রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বসে ডাইরিতে আবদ্ধ করতে থাকেন একজন দেশজ চেতনার মানুষ বন্ধু নেকাব্বরের জীবনগাথা। দর্শকের সাসপেন্সের কথা বিবেচনা করে খুব বেশি সময় সেখানে দৃশ্যায়ন করা হয়নি। কবি ফ্লাশব্যাকে চলে যান অতীতের স্মৃতিময় মুহূর্তের যে দিনগুলোতে নেকাব্বরের সঙ্গে নির্মলের (কবির) ভাবনার অটুট বন্ধন ছিল।

এর পরের কাহিনী দেখে মনে হতে পারে একজন কৃষকের সঙ্গে মাতব্বর কিংবা জমিদারের সম্পর্ক নিয়ে তো অনেক সিনেমা হয়েছে, মাতামাতি হয়েছে এ আর নতুন কী। ঘটনা এক কিন্তু দর্শন ভিন্ন। এই সিনেমার কৃষকরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে বিশ্বাসী। এখানকার কৃষক স্বজনহারা নেকাব্বর বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ, জীববৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী তথা প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যকে উপলব্ধিতে বিশ্বাসী ও যথেষ্ট পারঙ্গম। এর প্রমাণ ফাতেমার ছোট ভাই ও বোন যখন পাখি শিকার করে কে নেবে এই নিয়ে টানাটানি করে তখন নেকাব্বর লুঙ্গির ভেতরে গোঁজা কয়েকটি পয়সা দিয়ে পাখিকে মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেয় যা লং শট ক্লোজ শটে চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। আবার বাড়ির আঙিনায় কখনও লেবুর পাতার ঘ্রাণ এবং সে পাতায় মাকড়সার জালের সৌন্দর্য অনেক না পাওয়ার মধ্যে অনুভব করে। পথে শিক্ষকের সঙ্গে দেখা। এত মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কেন নেকাব্বর স্কুলে যায়না- এমন প্রশ্নের উত্তরে নেকাব্বরের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর- শিক্ষার জন্যে কী স্কুলে যাওয়া লাগে? এই মাঠ আর বিস্তীর্ণ আকাশ থেকে কত শেখার আছে আমাদের!

একজন হতদরিদ্র মানুষ হিসেবে আরেকজন দরিদ্রের সঙ্কটে এগিয়ে আসার চিন্তা তো তার স্বভাবজাত। ঘরের বাঁশের পালায় ঢুকিয়ে রাখা পয়সাগুলো দিয়ে গরিব বৃদ্ধাকে সাহায্য করে নেকাব্বর। আবার প্রতিনিয়ত কমরেড মনি সিংহ-এর চিন্তা ভাবনার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখে। নিয়মিত সে সব মিটিংয়ে অংশ নেয়। এক সময় বিদ্রোহ করে। তার এ চেতনা নিজের অবস্থার পরিবর্তন নয়। সমাজ পরিবর্তনের। যতই যা ঘটুক জৈবিক চাহিদাকে কী আর মানুষ উপক্ষো করতে পারে? উপেক্ষা করতে পারেনি নেকাব্বর। সে গ্রামের আইনুদ্দিনের মা মরা মেয়ে ফাতেমার প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। বিয়ের আগে তাদের একাধিকবার সঙ্গমও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেনি। কারণ মাতবরের ছেলের ড্রাইভারের সঙ্গে তার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা আর মাতবরের সঙ্গে কৃষকদের হাতাহাতিতে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে যায় নেকাব্বর। নেকাব্বরের নামে হুলিয়া জারি হয়। এটা জানতে পেরে সে কবি নির্মলের শরণাপন্ন হয়। নির্মল তাকে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং-এ নিয়ে বিপ্লবী মামুনের কাছে তুলে দেয়। মামুন নেকাব্বরের কথা এর আগেই নির্মলের মুখে শুনেছে। নেকাব্বরের অনুপস্থিতিতে গ্রামে চলে অন্য কাহিনী। মাতবর ফাতেমাকে বিয়ে করতে চায়। কুনজর পরড় মাতবরের পোষ্য মুন্সীর। কিন্তু মাতবর তাকে থামিয়ে দেয়। মাতবরের ভয়ে নামমাত্র নীরব থাকলেও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে মুন্সী। একদিন সন্ধ্যায় ছাগল নিয়ে হাওর থেকে বাড়ি ফিরতে গেলে ফাতেমাকে ধর্ষণ করে মুন্সী। বাসায় ফিরে কাউকে না বলে নেকাব্বরকে গভীরভাবে অনুভব করতে থাকে ফাতেমা। ফাতেমার জন্য প্রচণ্ড টান অনুভব করলে মামুন নেকাব্বরকে রাতের ট্রেনে বাড়ি আসতে বলে এবং সে তাই করে। বাড়ি এসে এসব জানর আগেই শুরু হয় যুদ্ধ। নেকাব্বর যুদ্ধে চলে যায়। যুদ্ধরত অবস্থায় পা হারায়। এরপর কাটে ৪২ বছর। নেকাব্বর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নির্মলকে খুঁজতে থাকে। একদিন খুঁজে পায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নির্মল তাকে একান্ত সান্নিধ্যে পেয়ে নানা অবেগঘন কথা বলে বাড়ি যাওয়ার কথা জন্য। নেকাব্বর বাড়ি আসে। এখানে এসে দেখে তার ভিটে মাটিও নেই। নেই তার ফাতেমা। হানাদারদের ঔরসজাত সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় সে। ফাতেমা বেঁচে নেই, নেই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকে।

মারা যায় নেকাব্বর। তারপর আবার নির্মল অর্থাৎ নির্মলেন্দু গুণ ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ফিরে আসে। এবং দেখে নেকাব্বরকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। গুণ পিছে পিছে যায়। যে নেকাব্বর যুদ্ধ করেছে সে হয়ত প্রয়োজন মনে করেনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখানোর। ফলে মৃত্যু পরবর্তী সময়েও মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা পায়নি নেকাব্বর। নেকাব্বরের সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

পরিচালক মাসুদ পথিক হয়ত চিত্রগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনেক অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করতে পারতেন কিন্তু তা না করে তিনি আবহমান বাংলার লোকজ উপাদান লরেন্স অপু রোজারিও ও বায়েজিদ কামালের ধারণকৃত দৃশ্যে দৃশ্যে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। যাকে আরও গভীরভাবে দেশজ সংগীত আবহের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সিনেমার সংগীত পরিচালক ড. সাইম রানা।

কবি নির্মলেন্দু গুণ, অসীম সাহা, সাইম রানা ও মাসুদ পথিকের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়ে শিল্পী বারী সিদ্দিকী, মমতাজ, বাপ্পী রাজ, বেলাল খান, প্রিয়াংকা গোপ সিনেমাটির এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছেন। সরকারি অনুদানের এ সিনেমা উৎসর্গ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহকদের।

(দ্য রিপোর্ট/এমএ/এপি/এএল/এনআই/জুন ২২, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর