thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বের বলি নিরীহ ফারুক

২০১৩ ডিসেম্বর ০১ ০১:১৫:২৫
ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বের বলি নিরীহ ফারুক

মীর হোসেন, দ্য রিপোর্ট : লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরার স্বপ্ন ছিল আসাদুজ্জামান আল ফারুকের। কলেজের লেখাপড়ার পাটও চুকিয়েছিলেন। চাকরির পরীক্ষা দিতে ১০ দিন আগে ঢাকায় আসেন তিনি। স্বপ্ন ছিল- সবার মুখে হাসি ফোটাবেন। এ স্বপ্ন আর পূরণ হলো না তার।

ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে শুক্রবার রাতে প্রাণ হারান ফারুক।

দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ফুয়াদ হাসান পল্লব গ্রুপের নেতা উজ্জ্বল খানের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক সাকিবুল হাসান সুইম গ্রুপের সংঘর্ষের সময় এ গুলির ঘটনা ঘটে। আর এ সংঘাতের কারণ চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রি নিয়ে বিরোধ। নিহত ফারুক কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে সম্প্রতি মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

সুইম গ্রুপ ফারুককে তাদের পক্ষের কর্মী বলে দাবি করলেও স্বজনরা বলছেন, ফারুক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। গোলাগুলির মাঝে পড়ে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শনিবার নিউমার্কেট থানায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ থেকে ১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন কলেজ ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সুইম। তবে পুলিশ ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে এখনো গ্রেফতার করেনি।

এদিকে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় সংগঠনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকসহ আটজনকে বহিষ্কার এবং কলেজ কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ জানান, শনিবারই তিনি ও সম্পাদক স্বাক্ষর করে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন।

যেভাবে নিহত হন ফারুক

জানা গেছে, শুক্রবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা কলেজের ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনে গুলিবিদ্ধ হন ওই হলের দ্বিতীয় তলার ২০৯ নম্বর কক্ষের ছাত্র ফারুক। একটি গুলি তার গলার নিচে বিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত ১টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসেন (২৪), পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সুলতান মাহমুদ (২৩) ও সাজুকে (২৪) আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাকিব ও সুলতানের বাম পায়ে গুলি এবং সাজুর ডান পায়ে ককটেলের স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। শনিবার সকালে সুলতান ও সাজু চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

চিকিৎসাধীন রাকিব দ্য রিপোর্টের কাছে দাবি করেন, বৃহস্পতিবার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল খান ও তার সহযোগী একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। এ বিষয়ে কথা বললে সুইন ও তার গ্রুপের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। উজ্জ্বল সভাপতি পল্লব গ্রুপের অনুসারী। এ কারণে পল্লব গ্রুপের কর্মীরা এ হামলায় অংশ নেয়। তারা ককটেল ফাটিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। এতে তাদের গ্রুপের কর্মী ফারুক মারা যান।

ফারুকের রুমমেট সাব্বির আহসান মামুন জানান, ক্যাম্পাসে রাজনীতি ও মারামারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না ফারুক। ঘটনার সময় তিনি হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় পল্লব-উজ্জ্বল গ্রুপের কর্মীরা গুলি ছুড়লে ফারুক গুলিবিদ্ধ হন।

ঘটনার নেপথ্যেঅন্তর্দ্বন্দ্ব

দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানকালে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র জানান, সাধারণ সম্পাদক সুইমের পক্ষের কয়েকজন অনুসারী (নর্থ হলের বাসিন্দা) সাউথ হলের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী উজ্জ্বলকে তার কক্ষে ঢুকে লাঞ্ছিত করে। এ নিয়েই সংঘর্ষের সূত্রপাত। সভাপতি পল্লবের ঘনিষ্ঠজন উজ্জ্বলকে লাঞ্ছিত করায় তার কর্মীরা গিয়ে সুইমের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়।

দু’পক্ষের মধ্যে এ সময় গুলি বিনিময় হয়। পরে ফারুকের মৃত্যুর খবরে তার বন্ধুরা নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে কয়েকটি দোকান ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে।

সূত্র জানায়, পলাশ নামে সুইমের এক বন্ধুসহ দু’জন নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে হলে ফিরছিলেন। এ সময় পল্লবের অনুসারী সহ-সভাপতি হেমায়েত এবং সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল তাদের কাছে চাঁদার ভাগ চান। তারা টাকা দিতে অস্বীকার করলে প্রথমে তাদের মারধর ও পরে সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন এবং টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বিষয়টি জানার পর হেমায়েত ও উজ্জ্বলকে নর্থ হলের সামনে ডেকে নেন সুইমের লোকজন। এরপর সেখানে মীমাংসার একপর্যায়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। পাঁচদিন আগে একটি চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রির টাকার ভাগাভাগি নিয়েও দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলছিল বলে জানায় একটি সূত্র।

সাকিবুল হাসান সুইম বলেন, ‘উজ্জ্বল খানকে কিছুদিন আগে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। শুক্রবার রাতে তার বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে তাকে ফোন করা হলে বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে উজ্জ্বল বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে হামলা চালায়।’

হত্যা মামলা দায়ের, তবুও গ্রেফতার নেই

নিউমার্কেট থানার ওসি ইয়াছির আরাফাত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে একটি গণ্ডগোল হয়েছে। এর বেশি কিছু জানা যায়নি। মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেফতার করা হবে।’ তিনি আরও জানান, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাকিবুল হাসান সুইম বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। এতে উজ্জ্বল খান, আজিজ, চয়ন, হেমায়েত, শহীদুজ্জামান, শুভ্রদেব, আলী খান, ইকবালসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হাসান সর্দার বলেন, ‘কী নিয়ে সংঘর্ষ বাধে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

কলেজের তদন্ত কমিটি গঠন

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ড. আয়েশা বেগম বলেন, ‘ফারুকের মৃত্যুর ঘটনায় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুফিয়া বুলবুলকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিবারে মাতম

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ফারুকের লাশ গ্রহণ করেন তার চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম মিলন। তিনি দ্য রিপোর্টকে জানান, ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র ফারুক মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। যুব উন্নয়ন অধিদফতরে চাকরির পরীক্ষার জন্য ১০ দিন আগে ঢাকায় আসেন ফারুক। পঞ্চগড় শহরের চিনিকল এলাকায় ফারুকের বাড়ি। তার বাবা মুনির হোসেন চিনিকল জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে মুনির হোসেন কেঁদে বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছি। আশা ছিল সে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। সংসারের অভাব দূর হবে....।’

স্বজনরা জানান, ফারুক চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন। পরিবারটির আশা-ভরসার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি।

(এমএইচ/এনডিএস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০১, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর

জেলার খবর - এর সব খবর