thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

বার্ন ইউনিটে বোবা কান্না

২০১৩ ডিসেম্বর ০৩ ১২:০৫:৫৮
বার্ন ইউনিটে বোবা কান্না

কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চতুর্থ তলা। ৪১৬ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন আর ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন এক মধ্যবয়সী নারী।

এ সময় বারবার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গিয়ে জানা গেল তিনি হতভাগ্য আবু তালহার ছোট বোন। নাম আফরোজা বেগম। গত শনিবার সকাল ১১টায় বার্ন ইউনিটে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এসময় পাশ দিয়ে যাওয়া দর্শনার্থীদের চোখেমুখেও ছড়িয়ে পড়ে আফরোজার কান্নার ছায়া!

১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে শিশুপার্কের সামনের সড়কে বিহঙ্গ পরিবহনে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন চালকসহ ১৯ জন। এদের মধ্যে আবু তালহা একজন। বয়স পঞ্চাশের কোটায়। পেট্রোলে তাঁর মুখ, পিঠ ও দুই হাতসহ পুড়ে গেছে শরীরের ৩০ শতাংশ। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বার্ন ইউনিটের ৪১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে কাতরাচ্ছেন তিনি।

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে হার্ডওয়ারের ব্যবসা করেন আবু তালহা। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ব্যবসায়িক কাজে বিহঙ্গ পরিবহনে মিরপুর যাচ্ছিলেন তিনি। শিশুপার্কের সামনে পৌঁছাতেই বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ধরে যায় বাসটিতে। অনেকেই জানালা-দরজা দিয়ে লাফিয়ে রক্ষা পেলেও শেষ রক্ষা হয়নি আবু তালহাসহ হতভাগ্য ১৯ জনের।

ঘটনার পর পরই তাদের ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটে। ইতোমধ্যে তাঁদের মধ্যে ২ জন মারাও গেছেন।

আবু তালহার বোন আফরোজা হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন, জানাচ্ছেন তালহার সর্বশেষ অবস্থার কথা। ফাঁকে ফাঁকে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গেও।

এ সময় তিনি বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। অশ্রুসিক্ত আফরোজা জানান, ভাইয়ের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। শুক্রবার অক্সিজেন দিতে হয়নি। কিন্তু আজ (শনিবার) দিতে হয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে।

কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে কেন তিনি অপরাজনীতির শিকার হলেন? দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র থাকলে হয়তো এটি হতো না।’ তালহার মতো সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে সরকার এবং বিরোধী দল ফায়দা লুটছে বলেও মন্তব্য তাঁর।

এ সময় আফরোজার সঙ্গে তাঁর ভাবি তালহার স্ত্রীও ছিলেন। তিনি স্বামীর মাথার পাশে বসেছিলেন। মাঝে মধ্যেই বাইরে আসলেও সংবাদ মাধ্যমগুলোকে এড়িয়ে গেছেন।

আবু তালহার পাশে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বিহঙ্গ পরিবহনের ড্রাইভার মাহবুবুর রহমান। পেট্রোল বোমায় তার মুখ, হাতসহ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। মাহবুবের বাড়ি গাইবান্ধায়। গত দুই বছর আগে মাহবুব ঢাকায় এসেছে। স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে থাকেন মিরপুরের দুয়ারীপাড়ায়। বাস চালকের চাকরি করে সংসার চালায় মাহবুব, গ্রামের বাড়িতেও টাকা পাঠান সে। কিন্তু দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় তার কর্মজীবন হোঁচট খেয়েছে তো বটেই, জীবনটাই অনিশ্চিয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মাহবুবের দুই চোখে অন্ধকার দেখছে স্ত্রী শাহনাজ পারভীন। ৮ বছরের স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছে।

একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ব্যাংকার শফিকুল ইসলাম। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সুরিটোলা শাখায় কর্মরত তিনি। ওই দিন মিরপুরের বাসায় ফেরার পথে অন্যদের সঙ্গে তিনিও শাহবাগে অগ্নিদগ্ধ হন। মুখ ও দুই হাতসহ শরীরের ২৩ শতাংশ পুড়ে গেছে তাঁর।

শফিকুলের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তাঁকে অনেকবার ফোন দেয়ার পরও রিসিভ হয়নি। অনেক পরে একজন ফোন রিসিভ করে ঘটনাটি জানান। এর পর আমরা হাসপাতালে ছুটে আসি।’

জুয়েল বলেন, ‘রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলতে চাই না। শুধু বলবো এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

বার্ন অ্যান্ড সার্জারি ইউনিটের রেজিস্ট্রার ডা. আশরাফুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে জানান, আজ (শনিবার) ৩৮০ বা ৪ শ’ মতো রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের প্রায় অর্ধেকই হরতাল বা অবরোধ কেন্দ্রিক। এদের শরীরের ১০ থেকে ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বিশেষ করে শাহবাগের ঘটনায় যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এদের শ্বাসনালী ও মুখ পুড়ে যাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছে।’

এদিকে রাজধানীর শাহবাগে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ১১ সদস্যের বোর্ড গঠন করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানদের সমন্বয়ে শনিবার সকালে এ বোর্ড গঠন করা হয়। তাঁরা সংশ্লিষ্ট রোগীদের দেখে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও ওষুধ দিয়েছেন।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এনডিএস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৩, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর