thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

রানা প্লাজা ট্রাজেডি

‘আমার সুরুজ, আমার সুরুজ...’

২০১৩ ডিসেম্বর ০৬ ২৩:১৮:৪৭
‘আমার সুরুজ, আমার সুরুজ...’

কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট : ‘‘সুরুজ বেঁচে আছে! এক মুহূর্ত দেরি নয়, ছুটে গেলাম রানা প্লাজায়। অনেক কষ্টে ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। সুরুজের জ্ঞান নেই। কোমরের নিচ থেকে দুই পা ভবনের ভেতরে চেপ্টে যাওয়া ছাদে আটকে আছে। মাথায় পানি দিলাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরলো সুরুজের। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। জুস আনলাম, কিন্তু কয়েক ঢোক খাওয়ার পর, কেঁদে উঠলো সুরুজ। বলল ‘ভাই আমার খাওয়া লাগবে না। আমাকে এখান থেকে বাঁচা।’ তারপরও ভাইকে বাঁচাতে পারিনি, লাশটাও…।’’ এই বলেই কেঁদে ওঠেন সুজন মিয়া।

২৪ এপ্রিল ২০১৩, দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সাভার বাজার সংলগ্ন রানা প্লাজার ৯তলা ভবন ধসে মারা যায় সহস্রাধিক হতভাগ্য পোশাক শ্রমিক। ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করা হয় এক হাজার ১১৩টি লাশ। নিখোঁজ রয়ে যায় আরও অনেক দুর্ভাগা পোশাক শ্রমিক। এই নিখোঁজদের মধ্যে সুরুজ মিয়া একজন। দুর্ঘটনার পর তার কাছাকাছি গিয়েছিলেন সুজন মিয়া। এরপরও শেষ পর্যন্ত সুরুজ মিয়া নিখোঁজ হন।

রানাপ্লাজা ধ্বংসযজ্ঞের ৭ মাস পেরিয়ে ৮ মাস চলছে। জীবিত না হোক অন্তত লাশটুকু পেলেও সান্ত্বনা পেতেন সুরুজের মা জোসনা বেগম। কিন্তু তাও জোটেনি তার ভাগ্যে। হতভাগিনী মা শোকে এখন পাগলপ্রায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের কোণায় এবং কপালে ঘাঁ হয়েছে। বেওয়ারিশ হিসেবে ৩১৮টি লাশের কবর দেওয়া হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবর স্থানে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সুরুজের কবরটুকুর সন্ধ্যান পাবেন এ আশায় বুক বেঁধে আছেন জোসনা বেগম। কিন্তু ডিএনএ রিপোর্ট না পাওয়ায় সে আশাতেও গুঁড়েবালি।

এদিকে অসহায় এ পরিবারটি এখনো পাননি কোনো সরকারি বা বেসরকারি আর্থিক সহায়তা। সুরুজের চাকরির পরিচিতি সংক্রান্ত সব তথ্য সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিয়েও মেলেনি নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ। ফলে একদিকে ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর মা জোসনা বেগম, অন্যদিকে আর্থিক অসচ্ছল পরিবারটি এখন নিদারুণ দিনাতিপাত করছে। পরিবারজুড়ে এখনও চলছে বোবা কান্না।

পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সুরুজ মিয়া। চেয়েছিলেন অভাব-অনটন দূর করে বিধবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে।

বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ধর্মকুল গ্রামের হোসেন আলী দুই ছেলে সুজন ও সুরুজকে ছোট রেখেই মারা যান। স্বামীর অবর্তমানে ভিটে মাটিহীন সংসারে অন্যের বাড়িতে কাজ করে দুই ছেলেকে বড় করেন জোসনা বেগম। খেয়ে না খেয়ে সুজন ও সুরুজকে স্কুলে পাঠান। যদিও অভাবের কারণে সুজন এসএসসি আর সুরুজ জেএসসির বেশি যেতে পারেননি। এসএসসি পাস দিয়েই সংসারের হাল ধরেন সুজন। চলে আসেন ঢাকায়। কাজ নেন সাভারের একটি গার্মেন্টে। এর বছর খানেক পরেই সংসারে সচ্ছলতা আর মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় আসেন সুরুজ। সাভারের রানা প্লাজার ৭ম তলার নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেড গার্মেন্টে চাকরি নেন হেলপারের। ৬ মাসের মাথায় কর্তৃপক্ষ কাজে খুশি হয়ে সুরুজকে ফিনিশিং আয়রনম্যানের পদ দেয়। এরই মধ্যে দুই ভাইয়ের আয়ে সচ্ছলতা আসে সংসারে। গ্রামের বাড়ি থেকে মা জোসনা বেগমকে ঢাকায় নিয়ে আসেন দুই ভাই। সাভার বাজারের পাশে সিআরপি ডাবল মুড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে ভালভাবেই কাটছিল দিন। গ্রামে ভিটে মাটি নেই, দুই ছেলের আয়ে ভিটেমাটি হবে। নাতি-নাতনি নিয়ে বাকি জীবন সুখেই কাটাবেন... এ রকম অনেক স্বপ্নই দেখতে থাকেন তিনি।

কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই সব কিছু তছনছ হয়ে যায় জোসনা বেগমের। ২৪ এপ্রিল সুরুজের কর্মস্থল রানা প্লাজা ধসে বহু মানুষ হতাহত হন।

ঘটনার দিন মঙ্গলবার, বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি ছিল। প্রতিদিনের মতো সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বের হন সুরুজ। বাসা থেকে কয়েক মিনিটের পথ রানা প্লাজা। তাই প্রতিদিন হেঁটেই অফিসে যেতেন সুরুজ। আগের দিন রাতে খাবার সময় সুরুজ বলেন, ‘রানা প্লাজায় ফাটল ধরেছে। ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু কাজে যোগ না দিলে বেতন ভাতা না দেওয়ার হুমকি দেয় মালিকপক্ষ।’ তাই বাধ্য হয়েই অন্যদের মতো সুরুজও কাজে যোগ দেন।

সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঝুঁকিপূর্ণ রানাপ্লাজা ধসে পড়ে। ৯তলা বহুতল ভবন ছাদের সঙ্গে ছাদ একাকার হয়ে পড়ে। সৌভাগ্যবান অনেকেই বের হতে পারলেও সুরুজের মতো সহস্রাধিক হতভাগ্য শ্রমিক আটকা পড়েন ধ্বংসস্তূপে।

মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। খবর পেয়ে অন্যদের মতো ছুটে যান সুরুজ মিয়ার মা জোসনা বেগম। রানা প্লাজার কাছে গিয়েই জোসনা বেগম দেখেন, হাজারো মানুষের ছোটাছুটি। চারিদিকে আর্তনাদ, হাহাকার। ছেলে বেঁচে আছে কি-না ঠাউর নেই তার। খুঁজেছেন এখানে-সেখানে। ছুটেছেন সাভারের সব হাসপাতালের বেড-বারান্দায়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছেন জোসনা বেগম।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দেন সুরুজ মিয়ার বড় ভাই সুজন। জানান, সকাল পৌনে ৯টা কী ৯টা হবে। তখন সাভারের ফুলবাড়ির একটি গার্মেন্টে ডিউটি করছি। এমন সময় সংবাদ এলো রানা প্লাজায় কী যেন হয়েছে। কেউ ঠিকমতো বলতে পারছে না। খবরটা শুনে আতকে উঠলাম। রাতে সুরুজ বলেছিল, তাদের ভবনে ফাটল ধরেছে। তাহলে কী....? বাসায় মাকে ফোন দিলাম। মা ছুটে গেলেন রানা প্লাজার দিকে। ফুলবাড়ি থেকে এক দৌড়ে রানা প্লাজার সামনে গেলাম। দেখি হাজার হাজার মানুষ। রানাপ্লাজা আর যেন রানাপ্লাজা নেই। ছাদের সঙ্গে ছাদ মিশে একাকার। চারিদিকে কান্নার রোল। সবাই ছোটাছুটি করছেন, আমিও। প্রায় আধা ঘণ্টা রানা প্লাজার আশেপাশে সুরুজকে খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। সাভারের সব হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করলাম, খোঁজ মিলল না তার। আমার নম্বর মুখস্ত ছিল সুরুজের। দুপুর ১২টার দিকে ফোনে অপরপ্রান্ত থেকে কেউ একজন বললেন ‘আপনার ভাই সুরুজ বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি রানাপ্লাজার পূর্ব দিকে চলে আসেন।’ এক উদ্ধারকর্মীকে দিয়ে আমাকে সুরুজই ফোন করিয়েছিলেন। আমি তখন রাবেয়া হাসপাতালে। সুরুজ বেঁচে আছে…এক মুহূর্ত দেরি নয়, দৌড়ে ছুটে গেলাম রানাপ্লাজায়। অনেক কষ্টে ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। সুরুজের জ্ঞান নেই। কোমরের নিচ থেকে দুই পা ভবনের ভেতরে চেপ্টে যাওয়া ছাদে আটকে আছে। মাথায় পানি দিলাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরলো সুরুজের। আমাকে দেখেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো সে। তার জন্য জুস আনলাম, কিন্তু কয়েক ঢোক খাওয়ার পর, কেঁদে উঠলো সুরুজ। বলল ‘ভাই আমার খাওয়া লাগবে না। আমাকে এখান থেকে বাঁচা।’ আমি বললাম, ‘যেকোনোভাবে তোমাকে বাঁচাবো ভাই, তুমি চিন্তা করো না।’ ভাইকে কীভাবে উদ্ধার করা যায় ছুটলাম সেনাবাহিনীর কাছে, উদ্ধারকর্মীদের কাছেও অনুনয় বিনয় করলাম। সবাই আশ্বাস দিল চিন্তা করো না, উদ্ধার হবে তোমার ভাই।’

সুজন জানায়, ‘২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার থেকে ২৭ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সুরুজকে পানীয় জাতীয় খাবার খাইয়েছি। কথাও বলেছি।’ কিন্তু তাকে উদ্ধার করতে পারিনি। তখন সে খুবই নিস্তেজ। ঠিক মতো কথা বলতে পারছিল না। অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমারও। সাথে উৎকট গন্ধ। এরপর বাইরে চলে আসার পর সেনাবাহিনীর কড়াকড়ির কারণে আর ভেতরে যেতে পারিনি।’ সুজন এসব কথা বলছিল আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন।

তিনি জানান, সুরুজ মিয়াকে উদ্ধার করা হচ্ছে, একুশে টিভিসহ কয়েকটি চ্যানেলে লাইভ দেখিয়েছে। আমাদের আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই তা দেখেছেন। কিন্তু তাকে আমরা পাইনি। সপ্তাহ খানেক এভাবে চলে যাবার পর আমরা ধরে নিয়েছিলাম, সুরুজকে আর জীবিত পাওয়া যাবে না। তার লাশটা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। কী বলব ভাই, আমি ও আমার মা ভাইকে খুঁজতে হাসপাতালের বারান্দা আর অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছি। কিন্তু কোথাও পায়নি। চোখের সামনে ভাইকে জীবিত পেলাম, নিজ হাতে খাওয়ালাম; কিন্তু ভাইরে পেলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন সুজন।

সুরুজের বড় ভাই জানান, উদ্ধার অভিযান যতদিন চলেছে হাসপাতাল আর অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে ছুটেছেন তিনি ও তার মা। ছেলের শোকে তাদের মা জোসনা বেগম কিছুক্ষণ পরপরই অজ্ঞান হয়েছেন। কিন্তু কোথাও সুরুজের সন্ধান মেলেনি।

তিনি বলেন, ‘অনেকের পরিচয় না মেলায় বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেওয়া হয়েছে। আমি ডিএনএ টেস্ট দিলাম। আশা করেছিলাম লাশটুকু না হোক অন্তত ভাইয়ের কবরটার সন্ধান পাব। মনে সান্ত্বনা দিতে পারব এইটা সুরুজের কবর। কিন্তু এতদিনেও ডিএনএ রিপোর্ট পেলাম না।’

সুজনের অভিযোগ, ওই ঘটনার পর তিনি আর কাজে যোগ দিতে পারেননি। ফলে তার চাকরিটাও চলে গেছে। সরকার হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দিল কিন্তু তারা এর কিছুই পাননি।

তিনি আরও জানান, চাকরি না থাকায় মাকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। সেখানে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তাদের। যদিও সুজন চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন আবার।

সুজন জানান, স্থানীয় সোনাতলা থানা থেকে সুরুজের চাকরির ডকুমেন্টসহ তাদের নাম ঠিকানা নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো খবর নেই।

এদিকে সুরুজের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মুখে ঘাঁ বানিয়ে ফেলেছেন তার মা। তাকে চিকিৎসা করানোর মতো অবস্থাও নেই তার।

সুরুজের হতভাগ্য মা জোসনা বেগম এখন আর স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। আগের মতো তেমন কথাও বলেন না তিনি। খুব আপনজন কাছে পেলে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। সুরুজের ব্যবহৃত প্যান্ট আর শার্ট বুকে চেপে ধরে মাঝে মাঝেই বিলাপ করেন।

হতভাগ্য এ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমার সুরুজ.....আমার সুরুজ…।’ এরপর আর কিছু বলেন না। তিনি চুপ করে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকেন।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর