thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

তারানকোর দিকে তাকিয়ে…

২০১৩ ডিসেম্বর ০৯ ০০:০৮:২৩
তারানকোর দিকে তাকিয়ে…

দ্য রিপোর্ট কূটনৈতিক প্রতিবেদক : সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এদিকে নির্বাচন নিয়ে সমাঝোতা করতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। একের পর এক বৈঠক করলেও এখনো ইতিবাচক কোনো ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেওয়া সমাঝোতার উদ্যোগ সম্পর্কে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব বলেছিলেন ইলেকশন রিসিডিউল করা যায় কিনা। আমরা বলেছি, সংবিধানের আলোকেই ইলেকশন রিসিডিউল করার সুযোগ রয়েছে।

গণফোরাম সভাপতি আরো বলেন, জাতিসংঘের দূত আমাদের কাছে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, আমরা বলেছি বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। প্রতিদিন সারাদেশে মানুষ মারা যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। এমন পরিস্থিতিতে একদলীয় নির্বাচন এ দেশের জনগণ মানবে না। নির্বাচন করতে হলে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে হবে। এখন এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বৈঠক সফল না হলে একদলীয় নির্বাচন এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

তারানকোর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এ সফরের সফলতা সম্পর্কে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘একমাত্র আল্লাহই জানেন এর সফলতা সম্পর্কে। এখন দুই দলকেই এগিয়ে আসতে হবে। নেগোসিয়েশন মানেই কমপ্রোমাইজ। রিজিট পজিশনে থেকে নিশ্চয়ই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্য দুই দলকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমীন বেপারি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘তারানকো এ পর্যন্ত যাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খুব ভালোভাবেই জানেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেই সারাদেশে আওয়ামী লীগের পতন ঘটবে এবং নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। তাই তারানকো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের কথা বললেও সবাই নির্বাচনে আসবে না। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সব দল নির্বাচনে যাবে না। প্রধানমন্ত্রীও যেহেতু পদ ছাড়তে চাচ্ছেন না। তাই উদ্দেশ্য মহৎ হলেও তারানকোর সফর সফল হচ্ছে না।’

তারানকোর ব্যস্ত সময় : অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো রবিবার সকালে প্রথমে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, পরে নির্বাচন কমিশন, এরপর প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং এরপর নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এসব বৈঠকের প্রতিটিতেই একদলীয় নির্বাচন বাতিল এবং তফসিল পেছানোর বিষয়টিই উঠে এসেছে। সন্ধ্যায় তারানকো বৈঠক করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণের সঙ্গে, এরপর বিএনপি নেতা শমসের মবিনের সঙ্গে। হোটেল সোনারগাঁওয়ে রবিবার বিকেলে সাড়ে ৩টায় জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক থাকলেও সেটি স্থগিত হয়। তবে রবিবারও যথারীতি জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের কেউ সাংবাদিকদের কিছু বলেননি।

নির্বাচনের তফসিল পেছানোর সুযোগ আছে : নির্বাচনের তফসিল পেছানোর সুযোগ আছে বলে তারানকোর সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের সদস্যরা। তারা বলেছেন, জাতিসংঘ এবং নাগরিক সমাজ চায় সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি অন্য কারও অধীনে হবে, এটা নিয়ে জাতিসংঘ বা নাগরিক সমাজ কিছু ভাবছে না। রাজধানীর একটি হোটেলে রবিবার বিকালে তারানকোর সঙ্গে বৈঠক শেষে বের হয়ে এসব কথা বলেন নাগরিক সমাজের সদস্যরা।

বৈঠকে নাগরিক সমাজের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রমুখ।

বৈঠক শেষে বের হয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, তারানকো তাদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানতে চেয়েছেন। তারা বলেছেন, আইনত নির্বাচন এখনো পেছানো সম্ভব বলে তারা মনে করেন। আমরা বলেছি, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান দরকার। একতরফা নির্বাচনের এই রেলগাড়িটা থামাতে হবে।

কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন পেছানো যায়- জানতে চাইলে কামাল হোসেন বলেন, তারা অতিথি হিসেবে সেখানে গেছেন এবং প্রশ্নোত্তর পর্বের মতো কথা হয়নি। এটা নির্বাচন কমিশনও জানে কীভাবে করা যায়।

এ সময় বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন দুইপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে নির্বাচন পেছানো যেতে পারে। এরপর কামাল হোসেন বলেন, ধন্যবাদ কথাটি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। আমরাও বলেছি, তফসিল পেছানো যায়।

এই উদ্যোগের সাফল্য আসার সম্ভাবনা কতটুকু-এমন মন্তব্যের জবাবে কামাল হোসেন বলেন, আমি তো আশাবাদী। একতরফা নির্বাচন হলে যেটা হবে সেটা আমাদের কারও জন্যই সুখকর হবে না। এখন বাংলাদেশে যা হচ্ছে সেটা নিশ্চয় আমরা কেউ কামনা করি না।

আরেক প্রশ্নের জবাবে কামাল হোসেন বলেন, ওনারা সচেষ্ট আছেন একটি সমঝোতার জন্য। সবার জন্য যেটা সুবিধা হয়, সেটাই হবে। তাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমরা বলেছি চেষ্টা চালিয়ে যান।

আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, আমরা একতরফা নির্বাচন চাই না। দেশের মানুষ চায় ২০০৮ সালের মতো একটা নির্বাচন হবে যেখানে ৮৭ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি থাকবে। জাতিসংঘ চায় সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এ জন্য সবাই কাজ করছে।

নির্বাচন ভাল করার জন্য কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নাকি সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্ভব- জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, না, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কিছু বলছি না। আমরা কেবল ২০০৮ সালের মতো সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই।

নির্বাচন পেছানোর দাবি এরশাদের : আগামী নির্বাচনের তফসিল পেছাতে জাতিসংঘের ভূমিকা চেয়েছে জাতীয় পার্টি। এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে জাতীয় পার্টির সঙ্গে রবিবার সকালে সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।

এ সময় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়াও দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে রুহুল আমিন হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা জাতিসংঘের এই প্রতিনিধির কাছে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, সব দল অংশ না নিলে নির্বাচনে যাবে না জাতীয় পার্টি। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় এই মুহূর্তে নির্বাচনে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। জনগণ এই নির্বাচন মেনে নেবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না।

জাতিসংঘ দূত কী বলেছেন জানতে চাইলে হাওলাদার বলেন, তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চেয়েছেন।

জিএম কাদের বলেন, সবাই বসে একটি পদ্ধতি বের করতে হবে যাতে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এবং সবার মতামতের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া নির্বাচনের তফসিল ১০ দিন পেছাতে হবে। আমাদের দলের চেয়ারম্যান বারবার বলে আসছেন, সব দল নির্বাচনে অংশ না নিলে জাপা নির্বাচনে যাবে না। পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব।

তিনি আরও বলেন, অনেক যোগ্য প্রার্থী আছে যারা এই তফসিলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তাই নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করতে হবে যাতে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।

সমঝোতা হলে অনেক কিছুই সম্ভব : এরশাদের সঙ্গে বৈঠকের পর রবিবার সকাল ১১টার দিকে তারানকো যান নির্বাচন কমিশনে। সেখানে এক ঘণ্টারও বেশি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে কোনো পক্ষই আলোচ্য বিষয় নিয়ে কিছু বলেননি।

সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ রবিবার সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সব দলের মধ্যে সমঝোতা হলে অনেক কিছুই করা সম্ভব, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে এ কথাই জানানো হয়েছে।

প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কী কথা হলো তা জানতে চাইলে সিইসি বলেন, প্রতিনিধি দল সমঝোতা হলে নির্বাচন পেছানো যাবে কিনা, তা জানতে চেয়েছেন। সমঝোতা হলে অনেক কিছুই করা সম্ভব তা তাদের বলা হয়েছে।

গওহর রিজভীর সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠক : প্রধানমন্ত্রীর আর্ন্তজাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভির সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠক করেছেন তারানকো। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠক শেষে রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনির্ধারিত এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

পঙ্কজ-তারানকো বৈঠক অনুষ্ঠিত : তারানকো গুলশানে রবিবার সন্ধ্যায় ভারতীয় হাইকমিশনে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদের এই বৈঠকের বিষয়বস্তু জানা যায়নি। কূটনীতিকদের মধ্যে পঙ্কজ শরণের আগে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিলেন তারানকো।

শমসের মবিনের বাসায় তারানকো : বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে নৈশভোজ এবং বৈঠক করেন তারানকো। তবে বিএনপির দলীয় সুত্র জানায়, রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারানকো তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় নৈশভোজে যোগ দিতে গেছেন।

কূটনৈতিক একটি সূত্র জানায়, শমসের মবিনের বাসায় এ নৈশভোজটি পূর্বনির্ধারিত ছিল না।

জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চেয়েছে এএইচআরসি : এদিকে নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট আয়োজনে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চেয়েছে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি)।

ঢাকা সফররত জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকোকে লেখা একটি খোলা চিঠিতে কমিশনের নির্বাহী পরিচালক বিজো ফ্রান্সিস বলেন, কেনিয়ায় নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ যে ভূমিকা রেখেছিল, বাংলাদেশেও একই ধরনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

এএইচআরসি মনে করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনে, দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশটির মানুষের জীবনজীবিকা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যত দ্রুত সম্ভব এটা করা প্রয়োজন।

একযুগ ধরে গৃহযুদ্ধের মধ্যে থাকা কেনিয়ায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে সাম্প্রতিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদাহরণ টেনে খোলা চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশেও সেরকম একটি গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের অবশ্যই কেনিয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো উচিত।

(দ্য রিপোর্ট/জেআইএল/এইচএসএম/শাহ/এসবি/ডিসেম্বর ০৯, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর