thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

‘জাতির সঙ্গে মশকরা করছে নির্বাচন কমিশন’

২০১৩ ডিসেম্বর ১৫ ২৩:৩০:১২
‘জাতির সঙ্গে মশকরা করছে নির্বাচন কমিশন’

মাহফুজ স্বপন, দ্য রিপোর্ট : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সিলেকশনের ইলেকশন হিসেবেই মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এটিকে জাতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মশকরাও বলছেন তারা। তাদের মতে বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। ইসির সমালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইসির কর্মকাণ্ডে এ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক ক্ষতি হলো।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে খারাপ নজির সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের নিয়ম নীতি ভেঙ্গে নির্বাচন নিয়ে গোটা জাতির সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে। শুধু জনগণ নয়, ভোট গ্রহণের কর্মকর্তারাও নির্বাচনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। এমন অনাকাঙ্খিত নির্বাচন ও এর ফলাফল নিয়ে রাজনীতিবিদরা কতটা লাভবান হবেন, সেটা কারোরই বুঝতে বাকি নেই। এ কাজের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন।

সু-শাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সদস্য সচিব ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, এবারের নির্বাচনে বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার কলঙ্কজনক রেকর্ড হয়েছে। এটাকে নির্বাচন বলা যাবে না। বলতে হবে সিলেকশনের ইলেকশনে পরিণত হয়েছে। আমরা সংকটের দিকে যাচ্ছি বলে মন্তব্য করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম। নির্বাচন কমিশন একটি পোস্ট অফিসের দায়িত্ব পালন করছেন। এরা কানেও শুনছে না, চোখেও দেখছে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, এত বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কূটকৌশলের ফলেই দেশ এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না বরং এটা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

এদিকে সরকারদলীয় প্রার্থীদের সুবিধা ও বিজয় নিশ্চিত করতে সাজানো প্রশাসনেই নির্বাচনের ছক তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমনকি প্রার্থীতা প্রত্যাহারের সময় ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হলেও অনেক স্থানেই রবিবারও আইন ভঙ্গ করে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের প্রত্যাহারপত্র না নিয়ে জোর করে বহাল রাখার খবর পাওয়া গেছে।

এমন নজিরবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশন রীতিমত গর্ববোধ করছে বলেও মত দিয়েছেন তারা। জনগণের সাংবিধানিক ভোটাধিকারকে হরণ করে সরকারের সুরে-সুরেই কথা বলছে ইসি। এ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ গত শনিবার বলেছেন, নির্বাচন বন্ধ করার মতো কোন আইনী জটিলতা এখনো তৈরি হয়নি। ভোটের আগেই ফলাফল হাতে পাওয়ার পরও তিনি বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই কেন এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? আগে নির্বাচন হোক। তারপরে দেখা যাবে। নির্বাচনের পরিবেশ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। এখন পর্যন্ত পরিবেশ নেই এটা বলা যাবে না। কেউ সহিংসতার সৃষ্টি করলে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হবে। তারাও প্রস্তুত আছে বলে হুমকি দেন এ নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনের সময় প্রশাসনের কর্তৃত্ব তাদের হাতে থাকলেও এরশাদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি (এরশাদ) গ্রেফতার কি না, তা আমি বলতে পারবো না। তবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোন ধরনের প্রশ্ন উঠবে না বলেও জানান এ কমিশনার।

আবু হাফিজের বক্তব্যকে কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য বলে মন্তব্য করেন তারা। তাদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নজীর সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না।

নজীরবিহীন এ নির্বাচনে কমিশনের গত কয়েক দিনের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে এর স্বাধীনতা ও অস্তিত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে ফেলেছে। গত শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হয়ে গেলেও রবিবার পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের অনেকের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ দেয় কমিশন। প্রধানমন্ত্রীর একজন সাবেক উপদেষ্টা এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি দেখভাল করেছেন বলে ইসি সূত্র জানায়।

জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তরিকত ফেডারেশনকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার বিষয় নিয়েও আইনী প্রশ্ন উঠেছে। বৃহস্পতিবার সিইসির কাছে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তিন দলের ১০ জন প্রার্থীকে জোটবদ্ধ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ জানান। সে অনুযায়ী কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তাদের এসব প্রতীক বরাদ্দের নির্দেশ দেয়। বিষয়টি আরপিওর পরিপন্থী। আরপিওর ২০ ধারায় বলা আছে, একাধিক রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলে তা তফসিল ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল তা করেনি।

এদিকে আরপিওর ১৬(১) ধারা অনুযায়ি প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা লিখিত আবেদন বা বাহকের মাধ্যমে নোটিশের মাধ্যমে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন। এক্ষেত্রে নোটিশ গ্রহণ বা বাতিলের কোনো এখতিয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তার নেই। এবার এ বিধান মানেননি অনেক রিটার্নিং কর্মকর্তা। জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থী তাদের মনোনয়পত্র বাতিলের আবেদন করলেও তা গ্রহণ করেননি তারা। অপরদিকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে জোরপূর্বক মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইন অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। এসব জটিলতার কারণে বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পটুয়াখালী, নীলফামারী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও রংপুরসহ কয়েকটি জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার সংক্রান্ত রিপোর্ট কমিশনে পাঠাতে পারেননি বলে কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর ফলে সারাদেশের রিপোর্ট হালনাগাদ করে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। অথচ গত ১১ ডিসেম্বর কমিশনের জারি করা পরিপত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র বাতিলে লিখিত নোটিশ দিলে তা বাতিল বা ফেরত না দেয়ার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংরক্ষিত প্রতীক ওই দলের প্রার্থীর অনূকুলে বরাদ্দ রাখার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয় কমিশন। গত বৃহস্পতিবার ‘লাঙ্গন’ প্রতীক কোনো প্রার্থীকে বরাদ্দ না দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দেন তিনি। তারপরও ইসি তা আমলে নেয়নি। এরকম দ্বিমুখী আচরণে সরকারের তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করছে। উপজেলা পরিষদের পদ লাভজনক হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তারা মনোনয়নপত্র বাতিল করলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের প্রার্থীতা রহস্যজনকভাবে বহাল রেখেছে ইসি। এর মধ্যে জয়পুরহাট-২,গাইবান্ধা-৫ ও বগুড়া-৫ রয়েছে।

এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার আবেদন গ্রহণের সর্বময় কর্তৃত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তাদের। এ ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু করার নেই। আপিলের সুযোগ থাকলে কমিশনের পক্ষে কিছু করার সুযোগ থাকত। এখনি এসব বিষয় না জেনে বলা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/ এমএস/ এমডি/ ডিসেম্বর ১৬, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর