thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

রাজনৈতিক অস্থিরতা

শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা

২০১৩ ডিসেম্বর ১৭ ১২:৩১:৪২
শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা

রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্থবির হয়ে পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা কার্যক্রম। হরতাল, অবরোধ, ঈদ, সাপ্তাহিক ছুটি এবং বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কারণে গত দুই মাসে মাত্র ১৩ দিন চালু ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। আর চলতি মাসে এ পর্যন্ত একদিনও ক্লাস হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই চিত্র বিরাজ করছে।

এ অবস্থায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন বিভাগে চলমান সেশন জট আরো প্রকট হলে, নতুন শিক্ষাবর্ষ (২০১৩-১৪) শুরুর ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, চলতি বছর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে টানা হরতাল কর্মসূচিতে বাধাপ্রাপ্ত হয় জবির শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কর্তৃপক্ষ এপ্রিল মাস থেকে শনিবার ক্যাম্পাস খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বর্তমানে শনিবারও রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতামুক্ত না হওয়ায় সঙ্কট উত্তরণের বিকল্প পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কিছুই করার নেই জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, শিক্ষা কার্যক্রম যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে রাজনীতিবিদদের নজর দেয়া উচিত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই উদ্বেগজনক। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এলে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি বিভাগে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেও মৌখিক পরীক্ষার জন্য আটকে আছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া কোনো কোনো বিভাগে পরীক্ষা শেষ হলেও ক্লাস শুরু এবং ফলাফল প্রকাশ করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। অনেক বিভাগে নির্ধারিত ক্লাস অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু সময়মতো পরীক্ষা শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিভাগে ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও অনেক বিষয়ের মিডটার্ম পরীক্ষা আটকে আছে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে যোগাযোগ করে জানা যায়, ৫ ডিসেম্বর থেকে বিভাগটির চারটি শিক্ষাবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা স্থগিত করেছেন।

এ ব্যাপারে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কাজী নাফিয়া রহমান বলেন, চলতি মাসেই আমাদের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় শুধু পরীক্ষা পিছিয়ে যায়নি, আটকে আছে ক্লাস-মিডটার্মও। এভাবে চলতে থাকলে সময়মতো সেমিস্টার শেষ হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

এদিকে সমাজকর্ম বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা ৩ অক্টোবর শেষ হলেও গত দুই মাসে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হয়নি। ৪ নভেম্বর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনটি পরীক্ষা শেষ হলেও আটকে আছে আরও তিনটি পরীক্ষা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিভাগে এ ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, আইন, মার্কেটিং, ফিন্যান্স, সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মতো যে কয়েকটি বিভাগে সেশন জট নেই, সেসব বিভাগেও সেশন জট শুরু হওয়ার আশঙ্কায় আছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

এ ব্যাপারে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ হালিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা অনেক কঠিন। তবুও নানা সঙ্কট থাকলেও আমরা সময়মতো শিক্ষাবর্ষগুলো শেষ করার চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে আমরা সফল হলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ইতোমধ্যে প্রায় দুই মাসের জন্য পিছিয়ে পড়েছি। এজন্য প্রয়োজনীয় ক্লাস কমিয়ে এনেও কয়েকটি সেমিস্টারে এখনও মিডটার্ম শেষ করতে পারিনি। ফাইনাল পরীক্ষার জন্য কিছু প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়, ফলে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে।

হরতাল-অবরোধের কারণে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। অনুষদ দুটির বেশ কয়েকটি বিভাগে ইতোমধ্যে এক থেকে দেড় বছরের সেশন জট রয়েছে। শিক্ষাবর্ষ অনুযায়ী বর্তমানে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ সম্মান দ্বিতীয়, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ চতুর্থ, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ ষষ্ঠ, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ অষ্টম সেমিস্টার, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার ও ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টার ফাইনাল উত্তীর্ণ হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া ২০০৬-০৭ ও ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল আরো আগেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ সপ্তম, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ পঞ্চম, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা তৃতীয় সেমিস্টারে রয়েছে।

ইংরেজি বিভাগের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ দুই বছর পিছিয়ে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার, ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ সম্মান অষ্টম সেমিস্টার, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ সপ্তম সেমিস্টার, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ ষষ্ঠ সেমিস্টার ও ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম সেমিস্টারে রয়েছে।

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ সম্মান অষ্টম সেমিস্টার, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ ষষ্ঠ, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ চতুর্থ ও ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় সেমিস্টারে রয়েছে।

পরিসংখ্যান বিভাগে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হলেও ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার, ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ সম্মান অষ্টম সেমিস্টার, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ সপ্তম, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ ষষ্ঠ ও ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা চতুর্থ সেমিস্টারে রয়েছে। বিভাগটির ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষেও সাত মাসের সেশন জট রয়েছে।

মনোবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ ষষ্ঠ ও ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম সেমিস্টারে রয়েছে। এছাড়াও ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পাঁচ মাস পিছিয়ে আছে।

ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাবর্ষই এক বছর পিছিয়ে আছে। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও প্রায় আট মাস পিছিয়ে পড়েছে।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাবর্ষেই এক বছরের সেশন জট রয়েছে। ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম সেমিস্টারে রয়েছে।

রসায়নবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা হলেও ফলাফল প্রকাশ হয়নি।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের এখনও মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ সম্মান অষ্টম সেমিস্টার, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ পঞ্চম ও ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম সেমিস্টারে রয়েছে। আগের তুলনায় বর্তমানে সেশন জট কমে এলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বিভাগগুলোকে দীর্ঘ জটিলতার দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

পরিসংখ্যান বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, অন্যান্য বিভাগে একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা সম্মান শেষ করার প্রস্তুতি নিলেও আমাদের তৃতীয় বর্ষই শেষ হয়নি। রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে আমরা দীর্ঘদিনের জন্য পিছিয়ে পড়ব। চাকরির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো যত বাড়বে ততই জবির পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় জটিলতা তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জবির নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম প্রায় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এবার ২৩ নভেম্বর ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলেও এরপর আর ভর্তিসংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত হলে নতুন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করতে জটিলতা তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষ সঙ্কটসহ নানাবিধ সঙ্কট থাকায় চলমান শিক্ষাবর্ষগুলো দ্রুত শেষ না হলে নতুন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট জবির পুরো প্রক্রিয়ার ওপর এক বড় চ্যালেঞ্জ।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোস্তফা হাসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম শুরুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান শিক্ষাবর্ষগুলোর ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে নেয়া। তা না হলে নতুন শিক্ষাবর্ষে তার প্রভাব পড়বে।

এদিকে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন তিনটি বিভাগের (লোক প্রশাসন, চারুকলা এবং সঙ্গীত ও নাট্যকলা) যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু টানা অবরোধে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিভাগ তিনটিকে গোছানোর কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

আবাসন সঙ্কট, শ্রেণীকক্ষ সঙ্কটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাটা কঠিন ছিল। দীর্ঘ আট বছরে ক্রমাগত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

(দ্য রিপোর্ট/এলআরএস/সাদি/শাহ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর