thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

মৃত্যুই ভেঙ্গেছে নীরবতা তার

২০১৩ ডিসেম্বর ২০ ২৩:৫৯:৪৬
মৃত্যুই ভেঙ্গেছে নীরবতা তার

বাহরাম খান

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন বাংলাদেশের রাজনীতির এক নীরব নাম। সরব থাকার মতো জায়গায় থেকেও তিনি নীরব থেকেছেন। থাকতে পেরেছেন। নীরব থাকার যোগ্যতা তার ছিল। তার পরিবারের সদস্যদেরও আছে। সেই প্রমাণ দেশের মানুষ পেয়েছেন। ৮০ বছর বয়সেও তিনি নীরবতা ভাঙ্গেননি। মৃত্যুই তার নীরবতা ভেঙ্গেছে। সরব হয়েছে মানুষ। তার চেয়েও বেশি মিডিয়া।

জোহরা তাজউদ্দীনের পরিচয়ে স্বামী হিসেবে জড়ানো হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নাম। বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু জোহরা তাজউদ্দীনের পরিচয় শুধু তার স্বামীর পরিচয়ে আড়াল হওয়ার মতো নয়। তিনি নিজেই এক আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছেন।

এই আলোকবর্তিকা নিভে গেল শুক্রবার। কালের সাক্ষী হলো ইউনাইটেড হাসপাতালের ইটপাথর। গত নভেম্বর থেকে যখন তিনি অসুস্থ তখন থেকেই খোঁজ রাখছিলাম। রিমি (সিমিন হোসেন এমপি, জোহরা তাজউদ্দীনের মেয়ে) আপার সঙ্গে এমনিতে অনিয়মিত যোগাযোগ ছিল। জোহরা তাজউদ্দিন অসুস্থ শুনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলাম। দিল্লির মিদান্তা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় দু-একদিন পর পর যোগাযোগ ছিল। এত তাড়াতাড়ি এই গুণী মানুষ, রাজনীতিক চলে যাবেন তা ভাবতে পারিনি।

সিমিন হোসেন রিমি তাজউদ্দীন আহমেদ পাঠচক্র পরিচালনা করেন। পাঠচক্রের সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ। পাঠচক্রের পারিবারিক আবহে তাজউদ্দীন পরিবারের অনেক কিংবদন্তিতুল্য ঘটনা জানার সৌভাগ্য হয়েছে। বিশেষ করে জোহরা তাজউদ্দীনের রাজনীতি, পারিবারিক জীবন, সংসার চালানো, স্বাধীনতা যুদ্ধের দুঃসময়সহ অনেক কিছু।

জোহরা তাজউদ্দিন ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। জীবনসঙ্গী হিসেবেও বেছে নিয়েছিলেন একজন রাজনীতিবিদকে। ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল সাতাশ বছর বয়সে তরুণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরপর তার রাজনীতির আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর হয়। তার জীবন সংসারে যত বড় অর্জন আছে তা দিয়েছে রাজনীতি। সবচেয়ে বড় যে দুঃখ পাওয়ার তাও পেয়েছেন এই রাজনীতি থেকে।

জোহরা তাজউদ্দীন একজন সার্থক রাজনীতিক, স্ত্রী এবং মা। তরুণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের প্রধান রাজনীতিবিদদের একজন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সৈয়দা জোহরার অবদানও কম নয়। তাজউদ্দীন আহমদ পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হিসেবে কাজ করার ফলে বেশিরভাগ সময়েই সংসারের দিকে খেয়াল রাখতে পারতেন না। অনেকটা সচেতনভাবেই খেয়াল না রেখেও নিশ্চিন্ত ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন তার সংসারে এমন একজন আছেন যিনি থাকলেই যথেষ্ট। তিনি জোহরা তাজউদ্দীন।

তাজউদ্দীন আহমেদ এবং জোহরা তাজউদ্দীন একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ছিল পরিমিতি বোধ। যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একে অন্যের মূল্যায়ন ছিল। একসময় জোহরা তাজউদ্দীন সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাজউদ্দীন আহমেদের মন্তব্য ছিল এরকম, তোমার রাজনীতির আগ্রহ তোমার কাছে। তোমার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমি শ্রদ্ধাশীল।

স্বাধীনতা যুদ্ধের অমোঘ ডাকে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ যখন ভারতে চলে যান তখন জোহরা তাজউদ্দীনকে বলে গিয়েছিলেন, আমি চলে যাচ্ছি। জানিনা দেখা হবে কিনা। সাড়ে সাত কোটি মানুষের যা হবে তোমাদেরও তাই হবে। মানুষের সঙ্গে মিশে যেও। চার সন্তান নিয়ে অকুলপাথারে পড়া জোহরা তাজউদ্দীন যোগ্য মায়ের পরিচয়ই দিয়েছেন। শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ভারতে যেতে সক্ষম হন।

রাজনীতিবিদ হিসেবে জোহরা তাজউদ্দীন আহমেদের বড় পরীক্ষা ছিল পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগকে আগলে রাখা। দলের দুঃসময়ে আহ্বায়ক হিসেবে সেই দায়িত্ব তিনি পালনই শুধু করেননি, তৎকালীন সরকার ও রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত থেকে রক্ষা করেছেন দলকে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা দেশে আসার পর তার হাতে দলীয় দায়িত্ব অর্পণ করে রাজনীতির ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন।

এত ঘটনাবহুল পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন সত্বেও নিজের সন্তানদের মানুষ করে তুলেছেন স্বাভাবিকভাবে। রাজনীতির মধ্যে থেকেও প্রচলিত রাজনীতির গতানুগতিকতা তাদের ছুতে পারেনি। তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ, সিমিন হোসেন রিমি তার উজ্জল দৃষ্টান্ত।

মৃত্যু মানুষের নির্ধারিত নিয়তি। তা কখনো এড়ানোর নয়। কিন্তু কিছু মৃত্যু নীরবতা ভেঙ্গে দেয়। জানান দেয় নতুন করে। জোহরা তাজউদ্দীনের মৃত্যু যেন তাই। এ যেন চলে যাওয়া নয়…

পুনশ্চ…একটি ঘটনা

দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। লাখো কোটি পরিবারের মতো বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারও নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে চার সন্তান নিয়ে এক পরিচিতের বাসায় গিয়ে আশ্রয় চাইলেন জোহরা তাজউদ্দীন। গৃহকর্তা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। কৌশলে সন্তানসহ জোহরা তাজউদ্দীনকে নিজের বাসায় না উঠিয়ে আরেকটি নিরাপদ স্থানে রেখে আসার প্রতিশ্রুতি দেন।

সন্তানসমেত জোহরা তাজউদ্দীনকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কর্মকর্তাটি যান তার বাসায়। এরপর আর ফিরে আসেননি। দরজায় কড়া নেড়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্বাধীনতার পর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হাতে আসে ঐ কর্মকর্তার ফাইল। স্ত্রীকে (জোহরা তাজউদ্দীন) এই বিষয়ে অবহিত করেন তাজউদ্দীন। জোহরার উত্তর ছিল, এটা আপনার অফিসিয়াল বিষয়। ঐ কর্মকর্তা আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছিল সেটার সঙ্গে তার পদোন্নতির বিষয় মেলানো উচিত নয়। পদোন্নতি তার কাজের বিচারেই হওয়া উচিত। এই ছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন।

লেখক : সাংবাদিক

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

মুক্তমত এর সর্বশেষ খবর

মুক্তমত - এর সব খবর