আহসান কবীর

দশম জাতীয় সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এখন জাতীয় পার্টি। সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের এই দলটি সঙ্গত কারণেই সংসদে প্রধান বিরোধীদল। দলটি ইতিমধ্যে রওশন এরশাদকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করেছে।

তা সত্ত্বেও এই দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধরনা দিচ্ছেন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতে। বিব্রতকর অবস্থাই বটে! শীর্ষস্থানীয় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবর- প্রধানমন্ত্রী নাকি জাপা থেকে দু’জনকে মন্ত্রিত্ব দিতে সম্মত হয়েছেন। তাহলে বিরোধীদল কারা? এই প্রশ্নে নাকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বিব্রত।

গ্রাম দেশের একটি গল্প :

এক আগন্তুক জনৈক গ্রামবাসীকে প্রশ্ন করলেন-

: এই গ্রামে মোড়ল-মাতবর কারা?

: আমরা আর মামুরা।

: এই গ্রামে চোর-ডাকাত কারা?

: কেন, আমরা আর মামুরা!

গল্প শুধু গল্পই। এর সাথে কেউ বর্তমান বাংলাদেশের সরকারি জোটের রাজনীতি অথবা জাতীয় সংসদের অবস্থার তুলনা করবেন না।

বাংলাদেশে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ আবির্ভাব ঘটে এরশাদ জমানায়। তখন আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন কথিত বিরোধী দলীয় জোটকে এই নামে ডাকতো দেশবাসী। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো সেনাশাসকের অধীনে নির্বাচনে যেতে অস্বীকৃতি জানালে বেকায়দায় পড়েন এরশাদ। এই মুশকিল আসানে এগিয়ে আসেন আ স ম রব ও তার সহযোগীরা। পাতানো নির্বাচনে ‘জয়ী হয়ে’ রব ‘সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা’ খেতাব পান। বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রবের জন্য যা ছিল যারপরনাই কলঙ্কের। অনেকে বলেন, এর মাধ্যমে আ স ম রবের উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যতেরও অপমৃত্যু ঘটে।

তবে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে এরশাদ কিন্তু এখনও বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। তার সহযোগিতায় গঠিত হয় মহাজোট- যারা নবম জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পাল্টে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন এরশাদ। এমনকি শেষ সময়ে নির্বাচনে যেতে অস্বীকার করায় জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও আলোচনার বাইরে রাখা যায়নি তাকে। সামরিক হাসপাতাল থেকে তিনি দল চালাচ্ছেন, নাকি তার কনসেন্ট ছাড়াই নেতারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা নিয়ে রয়েছে নানামুখী মত। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে চাইলেও এরশাদকে সে-সুযোগ দেয়নি ‘মেরুদণ্ড সোজা’ নির্বাচন কমিশন। জোর করেই নাকি তাকে সংসদ সদস্য বানানো হয়েছে। আবার যথাসময়ে সিএমএইচ থেকে সংসদ ভবনে এসে এমপি হিসেবে শপথও নিয়েছেন তিনি। তার স্ত্রী রওশন এখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা।

পর্দার অন্তরালের এইসব খেলাধুলায় এরশাদ নিজে কতটা অংশ নিয়েছেন, আর তাকে কতটুকু ব্যবহার করা হয়েছে সেসব তথ্য চাপা থাকবে না। একদিন প্রকাশিত হবে। তার জন্য প্রয়োজন আরও সময়ের। তবে ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এই যে, যে এরশাদ একদিন ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ সৃষ্টি করেছিলেন, সেই এরশাদের দলকেই এখন একই অভিধায় অভিহিত করে গালমন্দ করলে মানুষকে দোষ দেওয়া যাবে না।

২.

স্বাভাবিক নির্বাচনে ইতিপূর্বে যাদের জামানত বাঁচেনি, এবার তারা সংসদ সদস্য হয়েছেন দলে দলে। সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্তে চোখ বন্ধ করে সমর্থন দেওয়ায় এখন তাদের দাবিও বেড়েছে। সবাই মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে চান। মুশকিল হয়েছে, তাহলে বিরোধী বেঞ্চে বসবে কারা? এমনিতেই পৃথিবীর কোনো দেশ (ভারত ছাড়া) ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে স্বীকার করছে না। তার ওপর বিরোধীদল না থাকলে হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি নাকি ভাবিয়ে তুলছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও। ফর্মুলাও ইতিমধ্যে বের করা হয়েছে। ‘বিরোধীদল’ জাতীয় পার্টি থেকে দু’জনকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিতে সম্মত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দু’দিন আগে জাপা নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী এমন প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি জাতীয় পার্টি নেতাদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বসানোর কথা দিয়েছেন বলে বলছে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় অনলাইন মিডিয়া। আর এমনটি যদি হয়, তাহলে তা হবে এক অভিনব অবস্থা- বলছে দেশের শীর্ষ সংবাদপত্রটি।

৩.

প্রকৃতিকে তার নিজের মতো করে চলতে দিতে হয়। জোর করলেই সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা। দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষ হিসেবে কাছ থেকে দেখেছি, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লবের’ নামে উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য বাঁধ-পোল্ডার নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে অধিক ফসল ফলানোর যে চেষ্টা হয়েছিল, মাত্র দু’দশকের মধ্যে তা বুমেরাং হয়েছে।

একইভাবে বলা যেতে পারে, রাজনীতির স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি রুদ্ধ করলে তার ফলও ভালো হতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন হবে এবং দেশের মানুষ যে দলকে চাইবে, তারা রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। মাঝের পাঁচ বছরজুড়ে চলতে থাকবে রাজনৈতিক নানা তৎপরতা। বিগত পাঁচ বছরে দেশবাসী হতাশার সাথে দেখলো, ক্ষমতাসীনরা জোর করে বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করলো। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো যে, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের পক্ষে নির্বাচনে যাওয়া অর্থহীন মনে হলো। এই কারসাজির বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে যেসব কাণ্ডকারখানার অবতারণা হলো, তা শুধু নতুন নতুন রেকর্ড স্থাপনই করেনি, ক্ষমতার রাজনীতিকে রীতিমতো হাস্যাষ্পদে পরিণত করেছে।

লেখক : সাংবাদিক