আমানউল্লাহ আমান, দিরিপোর্ট২৪ প্রতিবেদক : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৪১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বৃহস্পতিবার। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্রপন্থী নেতাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম বিরোধীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাসদ। প্রতিষ্ঠার পর দলটি সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের ভিত কাঁপালেও জাসদ এখন রাজনীতির গগণে অস্তমিত সূর্য।

জাসদ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পার্টির চেইন অব কমান্ড না থাকা, বার বার ভাঙন, নেতৃত্বের আদর্শগত দ্বন্দ্ব, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে সামরিক সরকারকে সহায়তা, বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাদী দলের সঙ্গে ঐক্য, মূলধারার নেতাদের দল ছেড়ে পৃথক দল গঠন কিংবা সরাসরি বিভিন্ন বুর্জোয়া দলে যোগদানসহ কর্মী সংকটের কারণে এক সময়ে সমাজতন্ত্রের মশাল জ্বালনো জাসদ এখন ম্রিয়মান কুঁপির মতো নিভু নিভু করছে।

জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ নিবন্ধন নিয়েছে জাসদের পৃথক দুটি অংশ। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন একাংশ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মশাল প্রতীকে কোনো আসন পায়নি। তবে নবম সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের সঙ্গে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেয়া আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ৩টি আসন লাভ করে। জাসদ সভাপতি ইনু মহাজোট সরকারে পেয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

অন্যদিকে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন আসনে জয়ী হতে না পারলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিকল্প রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা করছে।

জাসদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার একটি হোটেলে সেক্টর কমাণ্ডার মেজর এম এ জলিলকে সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক করে জাসদ গঠন করা হয়েছিলো।

ঘোষণাকালে নেতরা বলেছিলেন ,‘২৫ বছরের গণআন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম বাঙালি জাতির জীবনে যে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে, স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে সমগ্র জাতির সে বিপ্লবী চেতনা আজ স্তব্ধপ্রায়। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্র আজ প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি আজ সুবিধাবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অর্থনীতি শোষক সম্প্রদায়ের করায়ত্ব। স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক মুক্তিযোদ্ধারা তথা সারা দেশের যুবশক্তি আজ চরমভাবে অস্বীকৃত, নিগৃহীত। ক্ষমতাসীন দল গোটা যুবসমাজকেই তাদের চক্ষুশূল বলে ধরে নিয়েছে। উঠতি পুঁজিপতি, শিল্প প্রশাসক গোষ্ঠীর ও ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী প্রথার নিগড়ে বাংলার কৃষক-শ্রমিকের জীবন আজ অতিষ্ঠ। একদিকে সমাজের অতিক্ষুদ্র শতকরা ৮ জন শোষক, অপরদিকে শতকরা ৯২ জন শোষিত মানুষ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়ানক ও পুতুল সরকারকে উৎখাত করে কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েমের উদ্দেশে দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রবল জনমত সৃষ্টির নিমিত্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পতাকাতলে জমায়েত হওয়ার জন্য দেশের ছাত্র, যুবশক্তি, মুক্তিযোদ্ধা, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বাস্তুহারা, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের নিকট উদাত্ত আহ্বান রইল।”

জাসদ আত্মপ্রকাশের পরদিন তৎকালীন জাসদের মুখপাত্র কবি আল মাহমুদের সম্পাদিত দৈনিক গণকণ্ঠ বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল ‘বাংলার রাজনৈতিক গগনে নতুন সূর্য’।

জাসদ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদের সবচেয়ে বড় কর্মসূচী ছিল ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও। ঐ কর্মসূচীতে পুলিশ গুলি চালালে আত্মগোপনে চলে যায় জাসদ নেতারা। এরপর বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জাসদের সামরিক শাখা গণবাহিনী গঠন করেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লব এ যাবৎ জাসদের সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ।

জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর জাসদ গোপনে তৎকালীন শাসকদের সহযোগিতা করে। ১৯৮০ সালে জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান ঘোষণা করেন ১৮ দফা কর্মসূচি। যাতে আরও গণতন্ত্র, ২০০ আসনের পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বসহ ৫০০ আসনের পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এর নাম দেয়া গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার। ১৯৮০ সালে এই ১৮ দফা কর্মসূচি প্রশ্নে জাসদ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং জাসদ থেকে আ ফ ম মাহবুবুল হক, খালেকুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামন , বজলুর রশিদ ফিরোজের নেতৃত্বে একাংশ দল থেকে বেরিয়ে বাসদ নামে নতুন দল গঠন করে। পরে বাসদও দুই ভাগ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৩ সালের শুরুতে বাসদ খালেকুজ্জামান অংশ থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৃথক বাসদ গঠন করেন মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও শুভ্রাংশু চক্রবর্তী। পরবর্তীতে সেনাশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রশ্নে ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে আবার বিভক্ত হয়ে পড়ে জাসদ। এসময় জাসদের একাংশের নেতৃত্ব দেন আ স ম রব, নূরে আলম জিকু, মো.শাহজাহান ও চিত্তরঞ্জন গুহ। অন্য অংশের নেতৃত্ব দেন শাজাহান সিরাজ, মির্জা সুলতান রাজা, হাসানুল হক ইনু। পরবর্তীতে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ করা নিয়ে ১৯৮৬ সালে আবার বিভক্ত হয়ে পড়ে জাসদ শাজাহান সিরাজ অংশ। জাসদ শাজাহান সিরাজ গ্রুপ থেকে পৃথক হয়ে নতুন জাসদ (পুর্নগঠন) গঠন করেন হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ , শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মুনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)।

আরো জানা যায়, তখন শাজাহান সিরাজ অংশে থেকে যান মির্জা সুলতান রাজা, এ বি এম শাহজাহান। পরবর্তীতে আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন একাংশ পৃথক হয়ে ১৯৮৮ সালে দেশের প্রায় সব দল যখন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত তখন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেন।

পরবর্তীতে শাজাহান সিরাজ বিএনপিতে যোগ দেন। মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জান যোগ দেন আওয়ামী লীগে। বর্তমানে মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক।

জাসদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানেই থেমে থাকেনি জাসদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রূপকথা। পরবর্তীতে আবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদারের নামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে জাসদ। ১৯৯৭ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আ স ম রব ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। সেসময় পূনর্গঠিত জাসদের সভাপতি নির্বাচিত হন আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন হাসানুল হক ইনু। ঐ সময় জাসদের সভাপতি আ স ম রব ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী।

জানা গেছে, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আবার ভাঙনের মুখে পড়ে জাসদ। ২০০২ সালের ২৭ অক্টোবর জাসদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে আ স ম রবের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আ স ম রব-কে দল থেকে বহিষ্কার করেন জাসদ ইনুর নেতারা।

৪১ বছরের ইতিহাসে জাসদ সমাজতন্ত্রের পথে কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, “১৯৭২ সাল থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আমরা সামাজিক বিপ্লবের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করি। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে এ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়। কারণ এতে আমরা সফল হইনি। এরপর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে আমরা মহাজোট গঠন করি। ”

তিনি বলেন,“ স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশকে জঙ্গীবাদের দিকে যেভাবে নিয়ে যাচ্ছিল আমরা সেখান থেকে দেশকে প্রগতিশীল ধারায় আনার চেষ্টা করছি। ”

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর বর এ প্রসঙ্গে বলেন, “ মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের রাষ্ট্র এবং সরকার কায়েম করা। কিন্তু তৎকালীন সংবিধান ও শাসক সে চেতনার ছিল না। এরই প্রেক্ষিতে আমরা ’৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা করে জাসদ প্রতিষ্ঠা করি। জাসদ দেশের প্রথম বিরোধী দল। ”

তিনি আরো বলেন,“ আমরা প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের নীতি-আদর্শ নিয়ে আছি। আমাদের শত শত নেতা-কর্মী, সংগঠকের জীবনদান, আত্মহুতি ,ফাঁসি এ সমস্ত কিছুর পরও এ দল তার নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। ”

আ স ম রব বলেন,“ এখন জাসদের যে অংশ ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলছে। এটা দলীয় আদর্শের পরিপন্থী। এর সঙ্গে আমি কখনই একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি না। যারা এটা করছে তাদের সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে তাদের মধ্যে দলীয় আদর্শ আদৌ আছে কিনা?”

এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জেএসডি বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

(দিরিপোর্ট২৪/আমান/ এমডি/ অক্টোবর ৩০, ২০১৩)