সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। যে কেউ এখন রতনকে দেখলে বিস্মিত হবে। মূর্তির মতো চুপচাপ বসে আছে। চারপাশে প্রচুর মশা। মশাগুলো রতনকে ঘিরে রয়েছে। কিন্তু রতনের ভাবভঙ্গী দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না, মশাগুলো তাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করছে।

রতন হাত দিয়ে মশাগুলো তাড়ানোর চেষ্টাও করছে। ও একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে মেঠোপথ। পথের ওপর অনেকগুলো জোনাকি। জোনাকির আলোর খেলা চলছে। কেউ ভাবতে পারে, রতন এই জোনাকির আলো দেখছে। রতন আসলে খোলা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু চোখ দিয়ে সে কিছুই দেখছে না।

গতকাল সন্ধ্যাবেলা ও এই সময় রতনের মা রতনকে বকছিলেন, কাল পরীক্ষা, বই নিয়ে একটু বসো।

মা, পরীক্ষা তো আমার।

পরীক্ষা তোমার। মাথা-ব্যথা আমার।

মাথা আছে বলেই তো মাথা-ব্যথা।

মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে রতন বলে, বাবার কথা মনে পড়ে মা?

মায়ের মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে যায়!

মনে পড়বে না কেন?

আট বছরের রতনের মনে হল মায়ের চোখেজল! কিন্তু এই মনে হওয়া পর্যন্তই। মা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বললে, তোর বাবা যুদ্ধে গেছে। দেশ স্বাধীন করতে।

যুদ্ধ, স্বাধীন এই সব শব্দগুলো গত কয়দিন ধরে রতন খুব শুনছে। ওদের গ্রামটা ঢাকা শহর থেকে খুব দূরে নয়। রতন জানে, দশ থেকে বারোমাইল দূরে ঢাকা থেকে। রতন শুধু ঢাকা শহরের গল্পই শুনেছে। কোনো দিন যায়নি।

রতনকে হিরু মামা বলেছিলেন, পরীক্ষা শেষ হলে রতনকে ঢাকায় নিয়ে যাবেন। ঢাকা শহরে দেখার অনেক জিনিস রয়েছে।

মামা অনেক জিনিসের কথা বলেছে। কিন্তু রতনকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে মামার একটি কথা।

ঢাকা শহরে কোথাও এত ছোট পথ নেই। বড়-বড় পথ সেখানে। ঢাকার লোকেরা বলে, রাস্তা। রাস্তার ওপর কালো পিচ। তবে সেখান দিয়ে মানুষ চলাচল করে না। রতন এ রকম রাস্তা কোনোদিন চোখেও দেখেনি। গাড়িতো দূরের কথা পথ মানে মেঠোপথ। মানুষের পায়ে চলার পথ। সেই পথ দিয়ে মানুষ যায় নিজের ঠিকানায়। মামার কাছে এই কথা শোনার পর কেন জানি পথ রতনের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। যে পথ দিয়ে বাবা চলে গেছে মা বলেন, এই পথ দিয়েই তোর বাবা একদিন ফিরে আসবেন বীরের বেশে।

বীর দেখতে কেমন?

মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল রতন।

মা দেয়ালে ঝোলানো বাবার ছবিটা দেখিয়ে বলেছিল, বীর হল এই রকম। তবে ফেরার সময় তোর বাবার কাঁধে নিশ্চয়ই একটা রাইফেল থাকবে।

এই শব্দটাও নতুন শুনছে রতন। স্কুলে এখন একামাত্র শিক্ষক ‘টিপু ভাই’। ছাত্র আন্দোলনে তিনি তার একটি পা আর হাত হারিয়েছিলেন। তারপর থেকে এই গ্রামের স্কুলে ছাত্র পড়িয়ে যাচ্ছেন টিপু ভাই। কিন্তু ছাত্রদের কখনো তাকে ‘স্যার’বলতে শেখাননি। বলেছে, ‘ভাই’বলতে। গ্রামের প্রায় সবাই যুদ্ধে চলে যাওযায় টিপু ভাই একা আগলে রেখেছেন গ্রামকে। স্কুলটাও খোলা রেখেছেন। ছাত্ররা এলে তাদেরকে বলেন, স্বাধীনতার অর্থ কি? গল্প করেন কীভাবে তিনি ‘৬৯এর ছাত্র-আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। টিপু ভাই যদিও এবার যুদ্ধে যাননি কিন্তু এই গ্রামের ওপর দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধার যাওয়া আসা। তাদের নানা রকম সাহায্য করেন টিপু ভাই। এই সাহায্য করাটাই আজ বিরাট বিপদ ডেকে এনেছে।

রতন আজ স্কুল থেকে যখন বাড়ির পথে তখনই এই ঘটনাটা ঘটে। রতন দেখল, দমকা হাওযার মতো খাকি-পোশাক পরা একদল লোক ছুটে যাচ্ছে। তারপরই প্রচণ্ড শব্দ। স্কুল ঘরের টিনের ছাদটা উড়ে গিয়ে কোথাও পড়ল। প্রায় দৌড়ে সামনে এগিয়ে রতন দেখতে পায় শুধু রতনদের বাড়ি নয় আশপাশে সবগুলো বাড়িতে আগুন জ্বলছে।

মা কোথায়?

প্রথম রতনের মনে এই প্রশ্নটাই এল। মসজিদের মৌলানা সাহেব রতনকে প্রায় কোলে করে নিয়ে গ্রামের বাইরে এই বটগাছটার নিচে বসিয়ে রেখে গেছেন তাও প্রায় একঘণ্টা। রতন মওলানা সাহেবকে জিগ্যেস করেছিলে, মা কোথায়?

গ্রামের একজনও বেঁচে নেই। সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী।

অন্য দিন হলে এটুকু সময়ে খিদে পেত কয়েকবার। আজ খিদের কথা ভুলে গেছে রতন। চোখের সামনে শুধু পথ।

আকাশে মেঘ ছিল। একটু আগে মেঘ সরে গেছে। বিরাট একটা চাঁদ উঠেছে আকাশ জুড়ে চাঁদের সেই আলো গাছের ফাঁক দিয়ে পড়েছে পথের মধ্যে।

চাঁদের আলোতেই রতনের চোখ চিকচিক করে ওঠে। পথ দিয়ে কেউ আসছে। আসছে একজন নয় কয়েকজন বীরপুরুষ। মা যে রকম বলেছিল, বীরপুরুষের চেহারা। সামনের বীরপুরুষটার চেহারা ঠিক সে রকম। বীরপুরুষটা রতনের সামনে এসে দাঁড়ায়।

কি, সবাইকে হারিয়েছ?

রতম কোনো কথা বলে না।

বীরপুরুষটি তার সঙ্গে কথা বলছে। এটি বড় বিস্ময়। মনে হচ্ছে, বীরপুরুষটি তার অনেক চেনা। রতন কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার কণ্ঠ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। তোমাদের গ্রাম কোনটা?

রতন হাতের ইশারায় সামনের দিকে পথ দেখায়। পরক্ষণে আবার হাত দেখায় পেছন দিকে। বামদিক, ডানদিক সবদিক। বীরপুরুষ বলে উঠে, বুঝতে পেরেছি। গ্রাম নয়। তুমি পুরো বাংলাদেশ দেখাচ্ছ। এই বাংলাদেশের পথ দিয়ে এখন তোমাকে নিয়ে আমরা হাঁটব।

বীরপুরুষদের একজন রতনের হাতে বাংলাদেশের একটা পতাকা ধরিয়ে দেয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তখন রতনও জেনে যাবে যুদ্ধের কৌশল। জানবে গ্রেনেডের শক্তি। জানবে এই পতাকাটা সবার কত প্রিয়। রতনের নতুন পরিচয় তখন হবে একজন ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা। আর আগামী দিনে এর পরিচয় হবে একজন ক্ষুদে বীরপুরুষ হিসাবে।

লেখক : শিশু সাহিত্যিক ও চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।