দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মানিত ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘যতদিন একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও আস্থাভাজন নির্বাচন না হচ্ছে ততদিন এই রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পূর্ণভাবে কাটবে বলে মনে হয় না। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা না কাটলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিধা থেকেই যাবে।’

তিনি বলেন, ‘যদি সরকারের অবস্থান ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকে, তাহলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকবে।’

রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ সিপিডি কার্যালয়ে শনিবার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ড. দেবপ্রিয় এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে আপাত শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এর ফলে যে সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা আছে, কিন্তু পরিস্থিতিগত কারণে অচল হয়ে পড়েছিল কিংবা পুরোপুরি চলমান ছিল না সেগুলো সচল হবে বা সেগুলোর চলমান কার্যকারিতা বাড়বে। কিন্তু এটা আগামী দিনের নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাকে দূর করতে পারবে বলে মনে হয় না।’

দেবপ্রিয় বলেন, ‘অর্থনীতিকে সম্প্রসারিত করতে হলে নীতিগত অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। যে সব মধ্যমেয়াদী প্রকল্প গৃহীত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক সংলাপ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো বড় প্রকল্প গৃহীত হলে ভবিষ্যতে তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।’

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৩) দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে সংস্থাটির পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ

সিপিডি’র প্রতিবেদন তুলে ধরার সময় ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৭ থেকে ৬ দশমিক ১ পর্যন্ত হবে, এটা বড় কথা নয়। মহাজোট সরকারের আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার হয়েছিল ৬ দশমিক ৭। এটাকে ৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২-এ।’

তিনি বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে ত্বরণ ছিল সে ত্বরণের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে, এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির সেই মূল ত্বরণে ফিরে আসাই বর্তমান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।’

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে সেটা অনেকটাই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করে সিপিডি। তবে এ জন্য সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে সিপিডি’র প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- চলতি অর্থবছরে সরকারের আয় ও ব্যয় হিসাব পুনর্নিধারণ করা, ব্যয়ের ক্ষেত্রে অবকাঠামো খাত ও যেসব প্রকল্প সমাপ্তির পথে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সারসহ সকল উপকরণের সময়মত সরবরাহ নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অর্থনীতি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান এবং বিনিয়োগে নীতিগত নিশ্চয়তা প্রদান ইত্যাদি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহায়তা দিতে কৃষি ঋণ অব্যাহত রাখা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে দক্ষতার সঙ্গে সম্প্রসারণ করা ও প্রয়োজনে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সিপিডি।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তায় গ্রামীণ অর্থনীতি তথা কৃষি, কৃষি উৎপাদন ও কৃষিজাত প্রক্রিয়া সম্পর্কিত খাত এবং ক্ষুদ্র শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘যে সব শিল্প-বাণিজ্য ও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠার জন্য সরকারকে অবশ্যই তাদের সমর্থন দিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে রফতানিমুখী শিল্প খাতে বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু এটা যদি শুধু তারা পায়, অন্যরা না পায় তাহলে অর্থনৈতিক সুবিচার হবে না।’

তিনি বলেন, ‘সরকার যদি রফতানিমুখী শিল্পের উৎস কর কর্তন করে, তাহলে ক্ষুদ্র শিল্পের টার্ন-ওভার ট্যাক্স কেন মওকুফ করা হবে না, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।’

তবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান করতে গিয়ে পুরো চাপ ব্যাংকিং খাতের ওপর না দিয়ে এর জন্য পৃথক তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে সিপিডি। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাবে এবং ব্যাংকিং খাত চাপের মুখে পড়বে বলেও হুঁশিয়ার করেছে তারা।

সিপিডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সরকারের আয় ও ব্যয় উভয়ই গত বছরের তুলনায় অনেক কমেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। রাজস্ব আয় গত অর্থবছরের তুলনায় বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৮ হাজার টাকা কম হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়নে বৈদেশিক প্রকল্প সহায়তা ব্যয় কমে যেতে পারে। এর ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের গৃহীত ঋণ বেড়ে যাবে। তবে সেটা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে খুব বেশি হবে না এবং একই সঙ্গে যেহেতু ব্যাংকিং খাতে যথেষ্ট উদ্বৃত্ত তারল্য আছে ও বেসরকারি ঋণ চাহিদাও কম, এ সব দিক বিবেচনায় ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়লেও সেটা খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।

ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে সিপিডি বলেছে, ব্যাংকিং খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য, বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কমে যাওয়া বিনিয়োগে শ্লথ গতিকেই নির্দেশ করে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। এ ছাড়া নতুন ব্যাংকগুলো এখনও প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের অধিক হারে সুদ দিচ্ছে। এর চাপ পড়ছে ঋণ গ্রহীতাদের ওপর। তবে স্প্রেড কমেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও ভাল নয়।

এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা বেড়েছে। খাদ্যপণ্য খাতে বিশেষত চালের দাম বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। তবে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও উৎপাদক পর্যায়ে কৃষক তেমন মূল্য পাচ্ছে না, বরং ভোক্তা পর্যায়ে দাম অনেক বেড়েছে। বর্তমানে এই পার্থক্যটা আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পণ্য চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে। তবে সরকারি পর্যায়ে খাদ্য মজুদ গতবারের তুলনায় কম। এটা বাড়ানো প্রয়োজন। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।

সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল

সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘এ সব নেতিবাচক প্রবণতার বিপরীতে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কয়েকটি দিকে সুবিধাজনক অবস্থানেও রয়েছে। যেমন, সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। হয়ত এটা বিনিয়োগের জন্য অতটা সহায়ক নয়, কিন্তু বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর ফলে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। উৎপাদনমুখী ব্যয় বাড়িয়ে এবং ভর্তুকির অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত করে সরকার প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে পারে। এ ছাড়া বর্তমানে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে ২শ’ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত, রিজার্ভও অনেক, টাকার মানও স্থিতিশীল রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে সার, খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমেছে।’

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এসকে/২৫ জানুয়ারি, ২০১৪)