বাঙালী জাতির প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নাম ‘ভাষা আন্দোলন’। দেশবিভাগের পর পাকিস্তান একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাষ্ট্রে জেঁকে বসে সামন্তবাদ। লক্ষ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে একটি সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখে ওই রাষ্ট্রকে স্থায়ী করা। এ জন্য তার রাষ্ট্রের অধিপতিরা ধর্মকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল। অথচ নিজেরা মোটেই ধার্মিক ছিল না, সাহেব-সুবোই ছিল একেকজন। তারা বলেছিল, পাকিস্তান হবে ইসলামী রাষ্ট্র— অথচ যারা এ কথা বলেছিল তাদের জীবনাচরণেও ইসলাম ছিল না। মূলত জনগণকে সামন্তবাদের কারাগারে বন্দী রাখার অভিপ্রায়ে দেশবাসীর সহনুভূতি আদায়ে তারা ওই-কথা বলেছিল। তা ছাড়া বাংলাকে তারা কোনো ভাষাই মনে করতে না, বলত ‘পৌত্তলিক ভাষা’।

ফলে ভাষা আন্দোলন সরাসরি আঘাত করে সামন্ত সংস্কৃতিকে জোরদার করার ওই রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মূলে। ভাষা নিয়ে আরও আরও বক্তব্য রয়েছে, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণও রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থা কিংবা সামন্তবাদী শোষণ যা-ই বলি না কেন, ভাষা আন্দোলন বাঙালীকে যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল শতভাগ তেমনটি নিশ্চয় বলা চলে। কেননা, ভাষা আন্দোলনের সফলতার পথ বেয়েই এসেছিল আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশে নব্বইয়ের যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সে আন্দোলনের প্রাণও আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনই ছিল বাংলার যাবতীয় আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণা। এখনো মিছিলে-মিটিং, সভা-সমিতি, রাজনৈতিক বিবৃতিতে ভাষা আন্দোলনের নানামাত্রিক প্রভাবের কথা উঠে আসে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে সেই আন্দোলনের প্রভাব আমাদের চেতনায় কতটুকু প্রতিফলিত তা গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করেছে তারা উত্তরপর্বের বাঙালীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যেমন অম্লান হয়ে আছে, তাদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। যখন কোনো শহীদ মিনারের পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাই, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় অবনত হয়ে আসে মস্তক। আপ্লুত হই একই সঙ্গে শোকে এবং আনন্দে। মিনারটা কি তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে পরিহাস করে? মিনারের দৃষ্টিতে কি ঝরে পড়ে স্নেহ ও করুণা— এমন প্রশ্ন জাগে আমার মনে। কেননা যখন দেখি, যে ব্যত্যয় নিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলন, তা প্রকারান্তরে এতদিন পরে এসে যেন ম্লান হতে বসেছে। শুরু হয়েছে প্রিয় বাংলা ভাষা নিয়ে যথেচ্ছাচার। চারিপাশে অপশক্তির নিত্য উল্লাস, সমাজ-রাষ্ট্রকে অন্ধকারে, পিছনের দিকে টেনে নেওয়া মহোৎসব। কী বলব এসব ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?

পাকিস্তান সরকারপ্রধানের নির্দেশ ও ঘোষণা ছিল ‘ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। অথচ দেশের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই বাংলাভাষী। ফলে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা— বাঙালী তা মেনে নিতে পারেনি। সারা দেশের বুদ্ধিজীবী ও বরেণ্য ব্যক্তিরা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রতিদিন ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মিছিল রাজপথকে উত্তাল করে তোলে। ১১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় পতাকা দিবস। পথে পথে বজ্রগর্জনে শ্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এ আন্দোলনে এসে আরও যুক্ত হয় স্কুল-কলেজ ছাত্রছাত্রী ও নারী। ক্রমে ভাষার দাবিটা একটি বেগবান রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। অনেক ঘটনার পর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সরকারি নির্দেশে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিপক্ষে বাংলা ভাষাকেই প্রধান ভাষা করার দাবি ও প্রস্তাব করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর উত্তরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দুঃখের বিষয় পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনও উর্দুর পক্ষে সমর্থন জানান। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার জনমত ছিল এর পুরোপুরি বিপরীত।

এর পরের ইতিহাস সহজ ছিল না। বাংলার জনগণকে জীবন দিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বায়ান্নো থেকে সেই আমাদের যাত্রা শুরু। এখনো মধ্যরাত্রির অন্ধকারে ও ভোরের কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে ফাল্গুনের ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ি আমাদের জানান দেয়, আমরা জেগে আছি তোমাদের চেতনায়। কিন্তু সেই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সত্যিই কি আমাদের চেতনায় প্রতিফলিত শতভাগ?

ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পরে এসে এ জাতীয় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াব কেন— তা অবশ্যই প্রশ্ন হতে পারে। এ প্রশ্ন এসেছে, আমাদের অধিকারের প্রশ্নে। গণতান্ত্রিক এই দেশে আমাদের অধিকার কি সর্বোতভাবে রক্ষিত? বাংলার মানুষ যে সামন্তবাদবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন করেছে তা নিশ্চয়ই পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ার আগ্রহে করেনি। অথচ দুঃখজনকভাবে তাই আমাদের পড়তে হয়েছে। পাকিস্তানী শাসকদের হটিয়ে দেওয়ার অর্থ দাঁড়িয়েছিল ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী পুরোহিতদের হটিয়ে দেওয়া। অথচ এ দেশে যারাই শাসক হয়েছেন তাদের অধিকাংশই বিশ্বশক্তির প্রভূত্ব মেনে নিয়েছেন। সরকারের বাইরে থেকেও করেছেন অনেকে।

এমন অবস্থায় বিদেশী কোনো শক্তি বা অপশক্তির তাঁবেদারী নয়। বাঙালীর প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিৎ আমাদের নিজস্বতার পরিচর্যা করা। নির্ভরশীলতার অন্তরালে আখের গোছানোর প্রসঙ্গ বা অভিযোগ এলে তাতে আমাদের জাতীয় বীরদেরই অসম্মান করারই শামিল। ভাষা আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করতে হলে রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং বিরোধী উভয় শক্তিকেই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ থেকে সরে থাকতে হবে। জাতীয় চেতনায় জাগিয়ে রাখতে হবে ভাষা আন্দোলন প্রভাব। বাঙালী জাতির নানামাত্রিক বৈষম্যমুক্তি এবং বৃহত্তর স্বার্থে এমনটি ভাবা যেতেই পারে।



লেখক : কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

(দ্য রিপোর্ট/আইজেকে/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৬)