বাদামী পাহাড়ের পাদদেশের গহীন বনটা ছিল নানা ধরনের গাছ-গাছালিতে ভরা। পাহাড় থেকে ছুটে আসা দমকা বাতাসে গাছের পাতা ঝিরঝিরিয়ে কাঁপে। শুকনো পাতারা যায় খসে। কখনো পুরো বনজুড়েই এলোমেলো পাতা ঝরতে থাকে। ডাল বেয়ে ছুটে চলা কাঠবিড়ালীরা তখন লেজ উচিয়ে বলে, ঝরো, পাতা ঝরো। আরও পাতা ঝরো।

বুনোহাঁসের মস্ত ঝাঁকও পৎপৎ করে ডানা মেলে দিয়ে দূরের দিগন্তে মিলিয়ে যাবার সময় হিমেল বাতাসের ঝাঁপটায় অবিরাম পাতা ঝরতে দেখে। দলপতি হাঁসটা বলে, এবারে দেখতে পাচ্ছি অনেক বেশি করে পাতা ঝরছে। আগে এমন দেখিনি।

সেই গহীন বনের ভেতরে ছিল একটা টলটলে রূপুলী হ্রদ। সেই হ্রদের পাশেই ছিল দীঘল বার্চ গাছটা। এক দিন সোনালী আলোতে মাখামাখী হয়ে একটা বনমুরগী ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে সেখানে উড়ে আসে। চিকচিক করছিল বনমুরগীর লাল ডানা। বনমুরগীটা সেই বার্চ গাছের ডালের ওপর ঝুঁপ করে নামল। ভাবল, সেখানেই সে আশ্রয় নেবে। তার কাছে বার্চ গাছটাকে বেশ নিরাপদ বলে মনে হলো।

তখন কুচকুচে কালো রাত নেমে এসেছে। অনেকটা পথ এক-নাগাড়ে উড়ে আসার জন্য বনমুরগীটা ছিল ভীষণ ক্লান্ত। তার বেশ ঝিঁমুনী পাচ্ছে। সে বার্চ গাছের এক খোঁড়লের ভেতরে পাখা গুঁজে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন বনমুরগীর দু’চোখে রাজ্যির ঘুম নেমে আসে। বনমুরগীটা তখন গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত ধরনের স্বপ্ন দেখল বনমুরগী। স্বপ্নের ভেতরে সে দেখতে পেল বনভূমির ভেতর থেকে একটা ঘন নীল মূর্তি বেরিয়ে আসছে। মূর্তিটার শরীর কুয়াশায় ঢাকা। মূর্তিটা তার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, এই যে বনমুরগী, তোমার ওপরে তো এখন বিশাল এক দায়িত্ব। তুমি যদি অনেক দূরের রূপুলী হ্রদের নীচের মাছকুমারীর দেশে এখন না যাও তাহলে সাঙ্ঘাতিক এক কাণ্ড ঘটে যাবে। মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। পৃথিবীটা যাবে ধ্বংস হয়ে।

এই ভয়ানক কথাটি তাকে জানিয়ে দিয়ে রহস্যময় নীল মূর্তিটা আবার ধীরে ধীরে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে যায়। বনমুরগীর ঘুম ভেঙে যায়। তার কোমল বুকে তখন ধুকপুকুনী শুরু হয়ে যায়। এ সে কী রকম স্বপ্ন দেখল! এক বিশাল দায়িত্ব এসে পড়েছে তার ওপরে। আর সেটা হচ্ছে গিয়ে এই পৃথিবীটাকে বাঁচানো। সে যদি এখন হ্রদের নীচের মাছকুমারীর দেশটিতে গিয়ে না পৌঁছায় তাহলে পৃথিবীতে মস্ত বিপর্যয় ঘটে যাবে। পৃথিবী যাবে ধ্বংস হয়ে। ভয়ানক ব্যাপার।

আতঙ্কিত বনমুরগী তখন খোঁড়লের ভেতর থেকে ঝপাৎ করে পথে নামল। তাকে তো এবার যেতে হবে অনেক দূরে। রূপুলী হ্রদের দেশে।

কিছুটা পথ যাওয়ার পর তার সাথে বনমোরগের দেখা হলো। পালক ফুলিয়ে কেমন দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঝলমলিয়ে আসছে।

শুভ সকাল বনমোরগ।

শুভ সকাল বনমুরগী। কোথায় যাচ্ছ এমন হন্তদন্ত হয়ে? এত তাড়া কীসের?

আমাকে তো যেতে হচ্ছে সেই রূপুলী হ্রদের মাছকুমারীর দেশে। আমি যদি সেখানে না যাই তাহলে এই পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাপারটার গুরুত্ব তুমি বুঝতে পারছ?

তাই শুনে বনমোরগ খুব ঘাবড়ে গিয়ে বলে, এই ধরনের কথা তোমাকে আবার কে বলতে গেল?

আমি এক বার্চ গাছের খোঁড়লে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে এই নির্দেশটি পেয়েছি।

বনমোরগের কাছে তখন মনে হলো বিষয়টা আসলেই তো গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তো এই বনভূমিও যাবে ধ্বংস হয়ে। তারও তখন বেঁচে থাকার আর কোনো পথ থাকবে না। সেও শেষ হয়ে যাবে। বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

কথাটা ভাবামাত্র বনমোরগ কেমন কুঁকড়ে মুঁকড়ে যায়। তার বুকে শুরু হয় প্রচণ্ড কাঁপুনী। সে পা দিয়ে অস্থিরভাবে মাটি আঁচড়াতে থাকে।

শোনো বনমুরগী, আমিও কিন্তু যাব তোমার সাথে। তুমি শুধু একা যাবে কেন?

বনমুরগী এ কথা শুনে খুশী হয়।

ভালোই হবে তাহলে। পথ চলায় আমি এক সাথী পেলাম।

দু’জনে বনপথ দিয়ে চলতে থাকে। আলো-ছায়ার মাঝে বনভূমিকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। ঝোঁপের ওপরে ফিনফিন করে রঙিন প্রজাপতিরা উড়ছে। তাদের ডানায় ডানায় স্বপ্নের ছোঁয়া।

যেতে যেতে তারা এক হাঁসের দেখা পায়। হাঁসটি গুগলি, শামুকের খোঁজে হেলে দুলে চলেছে। ওদের দেখে হাঁসটি থমকে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার, এমন লাফিয়ে লাফিয়ে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

বনমুরগী বলল, সে কথা আর বলো না, মস্ত বিপদে পড়ে চলেছি। আমাদের এখন যেতে হচ্ছে রূপুলী হ্রদের নীচের মাছকুমারীর দেশে।

সেখানে কেন?

ব্যাপার অতি গুরুতর। জানো, সেখানে না গেলে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যেতে পারে?

কী আবার ঘটবে?

হাঁসটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করে। বনমুরগী এমনভাবে চোখ মুখ কাঁপিয়ে কথা বলছে যে, মনে হচ্ছে না জানি কী সাঙ্ঘাতিক কিছু হবে। আসলে হবেটা কী?

বনমুরগী উত্তেজিতভাবে বলল, না গেলে যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে!

বনমুরগীর গলা কাঁপানো এমন কথা শুনে হাঁসের তো ভিরমি খাবার মতো অবস্থা। এমন আশ্চর্যজনক কথা সে আর আগে কখনো শোনেনি। তার পেটের ভেতরে মোঁচড় দিয়ে ওঠে। সে ভয় পাওয়া গলায় মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে, তোমাকে এ কথা কে বলেছে?

বনমুরগী তাকে খোলাসা করে বলে, আমি একটা বার্চ গাছের খোঁড়লের ভেতরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে নির্দেশ পেলাম যে, আমাকে রূপুলী হ্রদের মাছকুমারীর দেশে চলে যেতে হবে। যদি না যাই তাহলে পৃথিবী একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।

শুনে হাঁসের তো অবস্থা কাহিল। তার পেটে ভয়ের বুঁড়বুঁড়ি ওঠে। আসলেই তো ভয়ানক ব্যাপার। এদের সাথে তারও তো যাওয়া উচিত। বেঁচে থাকতে তো হবে। হাঁস তখন তাদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। ভীত কণ্ঠে বলে, আমিও তাহলে যাব তোমাদের সাথে।

চলো, আমাদের আর একজন তাহলে সঙ্গি বাড়ল।

বনমুরগী, বনমোরগ আর হাঁস পাশাপাশি চলেছে। উজ্জ্বল আলোতে পুরো বনভূমি ঝলমল করছে।

কিছু দূর যাওয়ার পর তারা এক রাজহাঁসের দেখা পেল। রাজহাঁসটা তার দীঘল গলা বাড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়েছিল। হাঁস তার সামনে যায়।

সুপ্রভাত ভাই রাজহাঁস।

সুপ্রভাত হাঁস। কোথায় যাচ্ছ?

আমাকে রূপুলী হ্রদের মাছকুমারীর দেশে যেতে হবে।

সেখানে কেন?

না গেলে যে পৃথিবীটাই একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।

রাজহাঁস তো শুনে অবাক।

তোমাকে এ ভয়ানক কথাটি কে বলেছে?

হাঁস চটপট করে বলল, আমাকে এ কথা বলেছে বনমোরগ।

রাজহাঁস তখন বনমোরগকে জিজ্ঞেস করে, তোমাকে এ কথা কে বলেছে?

বনমোরগ পালকে ঝাড়া দিয়ে বলে, ওই বনমুরগী আমাকে এ কথা বলেছে।

রাজহাঁস তখন বনমুরগীর চারদিকে ঘুরে ঘুরে লাল ডানা ঝাঁপটাতে থাকে।

কী হে বনমুরগী, কে তোমাকে জানিয়েছে যে মাছকুমারীর দেশে তুমি না গেলে পৃথিবীটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।

বনমুরগীও ডানা ঝাঁপটে বলল, আমি তো বার্চ গাছের অন্ধকার খোঁড়লের ভেতরে দিব্যি ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নের মাঝে পেলাম এই নির্দেশটি।

এবার রাজহাঁসের টনক নড়ে। কথাটা তো মারাত্মক। এতে ভয়াবহ বিপদের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমনটা ঘটলে তো তার জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাকেও পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। শিহরিত হয় রাজহাঁস। আতঙ্কের স্রোত তার দীঘল গলার ভেতরে ওঠানামা করতে থাকে। ব্যাগ্র কণ্ঠে বলে, আমিও যেতে চাই তোমাদের সাথে।

তাদের দলে তখন আরও একজন সদস্য যোগ হলো। ওরা দলবেধে বনপথ দিয়ে চলা শুরু করে।

চলেছে তারা চলছে

গোমড়া মুখে কানাকানি

বিপদ হলো জানাজানি

ধুকুর ধাকুর বুক কাঁপিয়ে

বলছে তারা বলছে

পৃথিবীটা ধ্বংস হলে

মরব সবাই দলে দলে

তাইতো এমন ঘুরছে মাথা

সারা শরীর টলছে।

যেতে যেতে তাদের সাথে এক শেয়ালের দেখা হয়। শেয়াল ওদের এমনভাবে ছুটে চলার কারণ জানতে চেয়ে যা রাজহাঁসের কাছে শুনল তাতে তো তার আক্কেল গুড়ুম। তার ধূসর বুক ধড়াস ধড়াস করে কাঁপতে থাকে। সে জুলজুল করে বলে, এ আমাকে তুমি কী শোনালে রাজহাঁস, পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। মহা-সর্বনাশের এই কথাটি তোমাকে আবার কে বলল?

রাজহাঁস বলে, আমাকে তো বলেছে ওই খুদে হাঁসটা।

শেয়াল তখন ছোট হাঁসকে জিজ্ঞেস করে, কে জানিয়েছে তোমাকে যে এই পৃথিবী ধ্বংস হবে?

খুদে হাঁস শরীর মুঁচড়ে বলে, আমাকে এ কথা বলেছে বনমোরগ।

শেয়াল তখন লাফ দিয়ে বনমোরগের সামনে যায়। বনমোরগের মুখের কাছে শেয়াল তার নাক উঁচু মুখটাকে নামিয়ে বলে, তুমি এটা কীভাবে জানলে? কে জানিয়েছে তোমাকে?

শেয়ালের অমন টকটকে লাল চাউনি দেখে তো বনমোরগ বেশ ঘাবড়ে যায়।

টকটকে শেয়ালটা তার শরীরে এবার থাবা দেবে নাকি?

বনমোরগ খানিকটা কুঁকড়ে গিয়ে বলে, আমাকে... আমাকে বলেছে ওই বনমুরগী।

বনমুরগী তোমাকে কে বলেছে যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে?

বনমুরগী মিনমিন করে জানাল, আমি একটা বার্চ গাছের খোঁড়লে ঘুমিয়ে স্বপ্নের ভেতরে এ কথাটি জেনেছি।

শেয়াল তড়পিয়ে ওঠে। স্বপ্নে শুনেছ। ওহো, স্বপ্নে জেনেছ। যত সব উদ্ভট, আজগুবী, অদ্ভুত এক কথা। যার

কোনো মাথামুণ্ডু নেই। এমন তো কখনও শুনিনি যে তোমরা রূপুলী হ্রদের নীচের মাছকুমারীর দেশে না গেলে এই পৃথিবীটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। এ সব কথার কিন্তু কোনো অর্থ নেই। মানে নেই। আর তোমাদের এ রকম হন্তদন্ত হয়ে অবুঝের মতো ছুটে চলারও কোনো যুক্তি নেই।

বনমুরগী, বনমোরগ, খুদে হাঁস, রাজহাঁস ফ্যালফ্যালিয়ে শুনতে থাকে শেয়ালের তড়বড়িয়ে বলা কথা। তারা কেমন অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। এখন তারা কী করবে? কোথায় যাবে? শেয়াল বুঝতে পারে দলটি এখন মহা-সমস্যায় পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাদের চাউনিতে ভীতি। তাদের শরীরে কাঁপুনী। তারা যেন এখনই নেতিয়ে পড়বে।

শেয়াল তাদের সমস্যার সমাধান করে দেওয়াটাকে তার একটি কর্তব্য বলে মনে করল।

গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল, অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি এখনই এই সমস্যাটাকে মিটিয়ে ফেলছি।

তারা সবাই কৃতজ্ঞ চিত্তে শেয়ালের দিকে তাকায়। কতটা দয়ালু স্বভাবের হলে এমন কথা বলে।

শেয়াল শান্ত স্বরে বলে, এক কাজ করো তোমরা। এখন সোজা আমার ডেরাতে চলো। সেখানে অনেক গরম। এই প্রচণ্ড শীতের সময়ে সেখানে ঠাঁই নিলে তোমরা অনেক স্বস্তি পারে। শান্তি পাবে।

তখন কনকনিয়ে হিমেল বাতাসের তীব্র ঝাপটা আসছে। তাদের সবার কাছেই শেয়ালের প্রস্তাবটিকে খুব চমৎকার বলে মনে হলো। প্রচণ্ড শীতের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা পথ তো পাওয়া গেছে। তাদের শরীর যেভাবে অবসন্ন হয়ে আসছে। তারা সাথে সাথে শেয়ালের ডেরাতে যেতে রাজি হয়।

আমরা সবাই মিলে তোমার ডেরায় যাব।

এদিকে শেয়াল তো মহাখুশী। তার মনে ফুরফুরে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সব ক’টাকেই এবার বাগে পাওয়া গেছে। এদের সব ক’টাই দেখতে আবার নাদুস-নুদুস। গায়ে গতরে বেশ পুরুষ্টু। শেয়ালের জিভ সুরসুর করে।

তোমরা তাহলে আমার সাথে ডেরায় চলো।

শেয়ালের পিছু পিছু ওরা চলতে থাকে। শেয়াল তাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ দিয়েছে। এই দুঃসময়ে মুক্তিদূত হিসেবে তাদের কাছে চলে এসেছে।

শেয়াল তার ডেরায় এসে কোণায় ডাঁই করে জমিয়ে রাখা শুকনো পাতা আর কাঠকুটোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের তাপে শেয়ালের ডেরা তাড়াতাড়ি গরম হয়ে ওঠে।

চারটে প্রাণী তখন আগুন ঘিরে বসে উম পোয়াতে থাকে। ক্রমশ তাদের শরীর ঝরঝরে হয়ে উঠছে।

আগুনের তাপে তারা যথেষ্ট আরাম পায়। তাদের ঝিঁমুনী আসে। চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে যায়। ঘুমে তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। তারা ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে।

শেয়াল তাদের সবার ঘুমোনোর জন্য জায়গার ব্যবস্থা করে। খুদে হাঁস আর রাজহাঁসকে ডেরার এক কোণায় ঘাসের চাটাইতে শুতে বলে। ওপরের কড়িকাঠে থাকার জায়গা হয় বনমুরগী আর বনমোরগের।

রাত বাড়তে থাকে। বনের ভেতরে একটানা ঝিঁঝিপোকার ডাক। রাত থমথম করে। পাতাকাঁপা বাতাস বয়। খড়ের চাটাইতে রাজহাঁস আর তুলতুলে খুদে হাঁসটি কুঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। গুটি গুটি পায়ে সেখানে শেয়াল এসে তাদের মাথার কাছে দাঁড়ায়। তার চোখ দুটো আগুনের শিখার মতো ধক্ধক করে জ্বলছে। তার সামনে নরম মাংসের খাবারের দু’টো শরীর। শেয়ালের পেটের ভেতরে চিড়িক দিয়ে ওঠে খিদে। তার যে আবার খুব খাই-খাই স্বভাব। শেয়াল তার সূঁচালো মুখটা নামিয়ে আনে। তারপর খপ করে খুদে হাঁসটার গলা কামড়ে এক মোচড়ে ছিঁড়ে ফেলে। খুদে হাঁসটার ছটফটানীতে তখন রাজহাঁসের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আতঙ্কিত চোখে দেখে শেয়ালের মুখে ছোট হাঁসটির রক্তমাখা মাথা ঝুলছে। রাজহাঁস কক করে পালিয়ে যাবার আগেই শেয়াল ছোট হাঁসের মাথাটাকে ফেলে হামলে পড়ে রাজহাঁসের ওপরে। রাজহাঁস আর পালাতে পারে না। শেয়াল থাবা দিয়ে মুঁচড়ে দেয় রাজহাঁসের লম্বা গলা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। শেয়াল রাজহাঁসের পালকগুলো টেনে টেনে ছেঁড়ে। শেয়ালের সামনে নিথর হয়ে পড়ে আছে দু’টো প্রাণী। তারা এই ডেরাতে এসেছিল একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। এদিকে শেয়ালের খিদে বাড়তে থাকে। শেয়াল হাঁস দু’টোর মাংস টুকরো টুকরো করে। তারপর চুলোর ওপরে রাখা কড়াইয়ের তেলে ফেলে ভাজতে থাকে। তার মধ্যে আবার কিছু বনজ লতাপাতাও মিশিয়ে দেয়। এতে সোয়াদ আরও বাড়বে। এদিকে কড়িকাঠের ওপরে কুঁকড়ে মুঁকড়ে শুয়ে থাকা বনমুরগীর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। চপাস চপাস করে তেল ফোটার শব্দ হচ্ছে। তার নাকে এসে লাগে মাংস ভাজার গন্ধ। কড়িকাঠের ওপর থেকে মাথা নীচু করে বনমুরগী বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করে। দেখে চুলোর পাশে শেয়াল বসে কী যেন মচমচ করে ভাজছে। মাঝে মাঝে শেয়ালটা তার লেজটাকে খুশীতে এদিক-ওদিক নাড়াচ্ছে। শেয়াল গুনগুন করে সুরও সাধছে।

তাইরে নাইরে না

তৈরি হচ্ছে খানা

তাইতো সুখে নেচেকুঁদে

গাইছি আমি গানা

আমায় কেউ করেনি মানা।

বনমুরগী জিজ্ঞেস করে, ও শেয়াল ভাই, কীসের যেন ভাজার গন্ধ পাই।

শেয়াল ছিল ভারি চতুর। বনমুরগীটাকে আসল ব্যাপারটা মোটেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাহলে সে পালাবে।

শেয়াল তড়বড়িয়ে বলে, ও কিছু না। আমি মটরশুঁটি ভাজছি।

এ কথা শুনে বনমুরগী আবার চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

শেয়াল বনমুরগীকে ঘুমিয়ে যেতে দেখল। ওপাশে বনমোরগ তো ঘুমোচ্ছেই।

শেয়াল রাজহাঁসের শরীরে মশলা মাখিয়ে ঝলসাতে থাকে। পোড়া পোড়া গন্ধ উঠছে। ঝলসানো মাংস চিবিয়ে খেতে খুব মজা।

এবার বনমুরগীর ঘুমটা ভেঙ্গে যায় মাংস পোড়ার শব্দে। বনমুরগী দেখল কীভাবে শেয়াল রাজহাঁসের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে বনমুরগী থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। এই তাহলে ছিল শেয়ালের মনে! এ তো মহা ধুরন্ধর। তাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের ডেরাতে নিয়ে এসেছে। ছল-চাতুরি জানে। অথচ তাদের দলটি বেরিয়েছিল এক মহৎ কাজে। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে ছুটে যাচ্ছিল রূপুলী হ্রদের মাছকুমারীর দেশে। অথচ এই ভয়ানক পাজি শেয়ালটা কিনা মাঝপথে দিল এমন বাগড়া।

বনমুরগী ভালো করেই বুঝতে পারছে হাঁসের মাংস খেয়ে শেষ করার পর শেয়াল তার আর বনমোরগের ওপরে হামলা চালাবে। তাদের দশাও করবে এই হাঁসের মতো। তাহলে তো সে স্বপ্নের নির্দেশ মতো রূপুলী হ্রদের নীচের মাছকুমারীর দেশে আর পৌঁছাতে পারবে না। তাহলে মহা-সর্বনাশ ঘটবে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। বনমুরগী ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থেকে বুদ্ধি আঁটতে থাকে। কীভাবে এই ভয়ঙ্কর শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কত বড় এক দায়িত্ব নিয়ে সে বেরিয়েছে। পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে। এখন তো আর পেটুক শেয়ালের শিকার হওয়া যাবে না।

বনমুরগী শেয়ালকে বিভ্রান্ত করার এক বুদ্ধি বের করে। বনমুরগী উপর থেকেই বলে, ও ভাই শেয়াল, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?

শেয়াল একটু চমকে যায়। বনমুরগীটা আবার সব টের পেয়ে গেল নাকি? শেয়াল সাবধানী হয়ে ওঠে।

বনমুরগী বলছে, শুনতে পাচ্ছ? তুমি শুনতে পাচ্ছ?

শেয়াল চোখমুখ খিচিয়ে বলে, কী শুনব? শোনার কী আছে?

বনমুরগী অবাক হয়ে বলে, বুনোহাঁসদের পাখা ঝাপটানোর শব্দ তুমি শুনতে পাচ্ছ না। আমার তো ঘুম ভেঙ্গে গেল এই পাখসাঁটের শব্দে। সেটা যে আমার খুবই চেনা এক শব্দ।

শেয়াল ভ্যাঁবাচাকা খেয়ে বলল, বুনোহাঁস মানে?

শেয়ালের কাছে সবচাইতে প্রিয় হচ্ছে বুনোহাঁসের তুলতুলে নরম মাংস।

বনমুরগী বুঝতে পারল বুনোহাঁসের কথা শুনে শেয়ালটার খানিক ভাবান্তর হয়েছে। যা পেটুক আর লোভী এই শেয়াল। তার শুধু খাই-খাই স্বভাব।

বনমুরগী শেয়ালকে উসকে দেয়ার জন্য বলতে থাকে, বাইরে এখন চর্বিঅলা হাঁসের দল উড়ছে। তারা এসেছে দূরের পাহাড় থেকে। যাচ্ছে হ্রদের দেশে। প্রতি বছর ওরা এভাবে উড়ে যায়। এখান দিয়েই যায়। আমি ওদের পাখা ঝাপটানোর শব্দকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারি। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে যাত্রাপথে তারা এখন এখানে থেমে খানিক বিশ্রাম নেবে।

শেয়াল ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ওরা এখানে নামবে তাহলে? ঠিক বলছ তো?

নামবে তো বটেই। ঝুপ ঝুপ করে নামবে। তুমি যদি এখন বাইরে যাও তবে তাদের নেমে আসার দৃশ্য দেখতে পাবে। সরালি, নীলশর, পান্তামুড়ি, লেনজা, নাঁকতা হাঁসেরা এসেছে।

বুনোহাঁসদের তালিকা শুনে শেয়ালের লোভ আরও বেড়ে যায়। সে বাইরে ছুটে যায় হাঁস ধরতে।

বনমুরগী এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে তখন বনমোরগকে ঝাঁকি দিয়ে ডেকে তোলে। শেয়ালের সব কীর্তিকলাপ জানায়। শুনে বনমোরগ তো হতভম্ব। দু’জনেই খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। যে করেই হোক শেয়ালের থাবা থেকে তো বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকাটা তাদের ভীষণ প্রয়োজন। তারাই তো পৃথিবীকে রক্ষা করবে। তারা অবিরাম ডানা ঝাপটে ছুটতে থাকে।

বনমুরগী রয়েছে স্বপ্নের ঘোরে। তারা চলেছে রূপুলী হ্রদের দেশে।

বনমুরগী বলে, ইশ, এবারে বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি। শেয়ালের বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়লেই তো মহা-সর্বনাশ হয়ে যেত। আমরা দু’জন সঙ্গিকে হারিয়েছি। খুদে হাঁস আর রাজহাঁসকে এমন করুণভাবে বিদায় জানাতে হলো। দুঃখে বুকটা আমার ফেটে যাচ্ছে।

বনমোরগ বলে, ভাগ্যিস তুমি বিষয়টা টের পেয়েছিলে।

বনমুরগী ঝলমলে লাল পালকের বাহার ছড়িয়ে বলে, টের তো আমি পাবই। আমি যে চলেছি অত্যন্ত মহৎ এক কাজে। পৃথিবীটাকে তো আমাদের রক্ষা করতে হবে। রূপুলী হ্রদের কাছে গিয়ে স্বপ্ন দেখা পথটি পাব। হ্রদের নিচে মাছকুমারীর দেশে যাব। স্বপ্ন আমার সার্থক হবে। শয়তানের হাত থেকে বেঁচে এসেছি।

এদিকে লোভী শেয়ালের ঘটেছে ভয়ানক বিপত্তি। বুনোহাঁস ধরার জন্য রাতের ঘন অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে গিয়ে পাহাড়ী গভীর খাদে গড়িয়ে গেছে। ধারালো পাথরের আঘাতে তার শরীর গেছে ছিন্নভিন্ন হয়ে। সে ছিল ছল-চাতুরিতে সেরা। অন্যদের সর্বনাশ করত। কখনও সুন্দর স্বপ্ন দেখেনি। অন্যদেরও কখনও সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে চেষ্টা করেনি। শুধু অন্যের ক্ষতির চিন্তা করত। তাই তার পরিণতিটাও হরো এমন করুণ।

বনমুরগীর ছিল স্বপ্ন। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার সোনালী স্বপ্ন। অন্য প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা। তাই সে ডানার মাঝে দুরন্ত গতি পেয়ে ছুটে যেতে পারছিল।

বনভূমিতে আলোর তীরের মতো ছুটে যাচ্ছিল।

বনমুরগী ছিল স্বপ্ন দেখা এক পাখি।

(ফিনল্যান্ডের লোককাহিনী অবলম্বনে)

আলী ইমাম : বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ।