দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : স্বপ্নের ফাইনাল। ভারতের মুখোমুখি স্বাগতিক বাংলাদেশ। সোনার হরিণের মতো টিকিটের পেছনে তাই তিন দিন ধরে দৌড়াচ্ছেন ক্রিকেট ভক্তরা। খুব সামান্য লোকই সৌভাগ্যবান হিসেবে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সেই টিকিটের দেখা। টিকিট নিয়ে দর্শক তো দূরে থাক, খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন নিজেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। নানামুখি চাপে বিক্রির জন্যও দিতে পারেননি খুব বেশি টিকিট। যাদের জন্য এত আয়োজন সেই মাশরাফিরাও কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেয়েছেন চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এই যখন অবস্থা তখনও মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের বাইরে কালোবাজারিতে টিকিট মিলছে বহুগুণ দামে।

স্টেডিয়ামের পাঁচ নম্বর গেটের পাশে রবিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে টিকিট-প্রত্যাশী হিসেবে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এক যুবকের সঙ্গে। নাম মাজহারুল ইসলাম লেলিন। যিনি নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সহ-সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তার কাছ থেকে কৌশলে নেওয়া ভিজিটিং কার্ডে পরিচয় হিসেবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পরিচয় রয়েছে। লেলিন নিজে কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত নন, তবে ব্ল্যাকে টিকিট কিনে নিজের অনুসারী কর্মীদের দিতে ঘুরছেন স্টেডিয়ামের আশপাশে। জানালেন, এর মধ্যেই বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করেছেন প্রায় ১৬টি টিকিট। যা নিজের অনুসারী কর্মীদের মাঝে বণ্টন করেছেন।

তার দলের আরও কিছু কর্মী আসবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও মাস্টারদা সূর্য সেন হল থেকে। কিছু লোককে নিজের পরিচয়েই বিনা টিকিটে স্টেডিয়ামে খেলা দেখাতে পারবেন বলে জানালেন। এরপরও তার আরও অন্তত ২০টি টিকিট তার প্রয়োজন বলে জানালেন লেলিন।

টিকিটের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ফোনে কথা বলছেন লেলিন। এর মধ্যে নিজের পরিচিত এএসপি পর্যায়ের এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। যিনি ওই সময় মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ডিউটিরত ছিলেন। তার মাধ্যমে কিছু টিকিট জোগারের জন্যই হচ্ছিল এই কথা। কথোপকথনের এক পর্যায়ে ওই যুবক পুলিশ কর্মকর্তাকে বললেন, আপনাদের কনস্টেবল পর্যায়ের অনেকেই ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করছেন।

খেলা শুরুর আগে প্রয়োজনীয় টিকিট জোগার করতে পারবেন বলে আশা করছেন মাজহারুল ইসলাম লেলিন। জানালেন, মিরপুরের কিছু মানুষ ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করছে। তারা কোথা থেকে টিকিট পায়? জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনি-আমি তো এখানে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করতে পারব না। আমাদের তো মানসম্মান আছে। এ জন্য যারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত তারা ওই মানুষদের মাধ্যমে এসব টিকিট বিক্রি করে।

পাঁচ নম্বর গেট পার হয়ে চার নম্বর গেট থেকে আসার সময় দু’জন টিকিট নিয়ে কথা বলছিলেন। ক্রেতা হিসেবে দাম জিজ্ঞাসা করলে, ১৫০ টাকা মূল্যের টিকিট ৪০০০ টাকা দাম চাওয়া হয়। একজন মাঝবয়সী ও অপরজন কিশোর বয়সী লোক ‘একটি টিকিট আছে নিলে তাড়াতাড়ি নেন’ বলতে বলতে পাঁচ নম্বর গেটের দিকে এগুতে থাকেন।

চার নম্বর গেট পার হয়ে মোড়ের কাছে এসে কথা হলো কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে। দর্শনার্থী হিসেবে তাদের কাছে টিকিট চাওয়া হলে, টিকিট থাকার কথা কেউ স্বীকার করেননি। একজন বললেন, আশপাশে খোঁজ রাখেন, হয়তো কালোবাজারিতে পেয়েও যেতে পারেন। কোনো ‘সিস্টেম করে’ স্টেডিয়ামে প্রবেশের সুযোগ আছে কিনা? জানতে চাইলে এসব কনস্টেবলের কেউই এই প্রস্তাবে রাজি হননি। স্টেডিয়ামে আজ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে? জানতে চাইলে একজন বললেন, আইজিপি স্যার নিজেই এটা তদারক করছেন। কারণ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আসার কথা রয়েছে।

তাদের মধ্যে দু’জন জানালেন সকালেই টিকিট নিয়ে ইনডোরের সামনে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার কথাও জানান তারা। ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে সামনে আসতেই একজনের কাছে টিকিট থাকার আলামত পাওয়া গেল। তবে জিজ্ঞাসা করা হলে টিকিট থাকার কথা অস্বীকার করলেন তিনি। পরে অন্য একজনকে নিয়ে নিজ বাসার দিকে চলে যান। কথোপকথনে বুঝা যায় যে, ২৫০ টাকা মূল্যের টিকিট ওই ব্যক্তি ৫০০০ টাকায় ক্রয় করেছেন।

আরেকটু সামনে এসে হতাশ হয়ে বসে থাকা দু’জনকে টিকিটের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তারা উৎসুক নিয়ে কাছে আসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন টিকিট আছে ভাই? উত্তরে জানালাম না, আমরাও টিকিট ক্রয় করার জন্য খুঁজছি। তাদের একজন বললেন, ভাই ১৫০ টাকা মূল্যের টিকিট ৪০০০ ও ২৫০ টাকা মূল্যের টিকিট ৫০০০ চেয়েছে। বসে আছি দেখি শেষ পর্যন্ত একটু কম মূল্যে পাওয়া যায় কিনা। ভাই টিকিটের সন্ধান পেলে জানাবেন, আমরা এখানেই আছি।

স্টেডিয়ামের বাইরে যখন এমন দৃশ্য, তখন টিকিট নিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রায় হাজার দুয়েক অনুরোধ রয়েছে টিকিট প্রদানের জন্য। যেখানে সমাজের সর্বস্তরের লোকই রয়েছেন। কিন্তু বিসিবির সভাপতি হিসেবে সামান্য কিছু টিকিট সৌজন্যতা রক্ষার্থে প্রদান করতে পেরেছি।’

এশিয়া কাপ টি২০-তে ফাইনালের টিকিট নিয়ে দুই দিন ধরেই সরগরম ক্রিকেটাঙ্গন। এর মধ্যেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড প্রায় ৫০০০ টিকিট নাকি নিজেদের দর্শকদের জন্য কিনে নিয়েছে। এছাড়া ভিআইপিদের নানামুখি চাপে পৃষ্ট বিসিবি কর্মকর্তাসহ ক্রিকেটারদের মুখেও টিকিট নিয়ে অসহায়ত্বের কথা শুনা গেছে। অধিনায়ক মাশরাফি তো নিজেই স্বীকার করেছেন ২৫টি টিকিট চেয়ে পেয়েছেন ৫টি। এই যখন অবস্থা তখন কালোবাজারিদের কাছে টিকিট আসছে কোথা থেকে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সবাই।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/সা/মার্চ ০৬, ২০১৬)