আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বিশ্ব ভালবাসা দিবস। চন্দ্রিমা উদ্যানজুড়ে এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির সরব উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে, দিনটির গুরুত্ব কথা। অথচ আজকের দিনেও মন মরা হয়ে বসে আছে মাহিন।

কোনো কিছুতেই মন বসছে না মাহিনের। হৃদয়জুড়ে তার হাহাকার, নিদারুণ কষ্ট। অসহায়ের মতো সে বসে আছে চন্দ্রিমা উদ্যানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের লেকপাড়ে। হাজার মানুষের কোলাহল। আশপাশে প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির বিচিত্র চলাফেরা। নিজেকে আজ খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার।

এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! এইতো সপ্তাহ খানেক আগেও কত আনন্দ ছিল। ইয়াসমিনের হাত ধরে লালবাগ কেল্লার মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর বসে ওইদিনও কত স্বপ্নের বিনিময় হলো দু’জনের। ইয়াসমিন মাহিনের হাত ধরে সেদিন বলেছিল- জানো মাহিন, তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগে না। সময় একদম কাটে না। মনে হয় সব সময় তোমার কাছেই থাকি। তোমার হাত ধরে সারাদিন ঘুরে বেড়াই।

মাহিন বলেছিল- আমারও তাই মনে হয়। তুমি যদি রাজি হও তাহলে বাবা-মাকে দিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই তোমার বাবা-মাকে প্রস্তাব পাঠাই। এভাবে আর কতদিন, বল? আমার আর ভালো লাগে না।

ইয়াসমিন বলে, যাক না আর কিছু দিন। চাকরি করছ। একটু গুছিয়ে ওঠো। এরপর..।

-ঠিক আছে, তুমি যা ভালো মনে করো। মাহিন আর কথা বাড়ায় না।

ওই দিনই ইয়াসমিনের সাথে শেষ দেখা তার। এরপর ওই রাতে মোবাইলে কথা হয়েছিল মাহিনের, হোস্টেলে ভালোভাবেই ফিরেছে ইয়াসমিন। সে দিন শেষ বিকেলে ইয়াসমিন মাহিনকে জানিয়েছিল, কিছু দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি বরিশালে যেতে হচ্ছে তাকে। বাবা নাকি তাকে খুব তাড়া দিয়েছে।

যেতে দিতে চাইছিল না মাহিন। ইয়াসমিন মাহিনের হাত ধরে বলেছিল, ক’দিনের জন্যই তো যাচ্ছি। এরপরেই তো আবার তোমার কাছেই আসব। এ ছাড়া মোবাইলে তো কথা হচ্ছেই।

কিন্তু পরদিন থেকেই মোবাইল বন্ধ ইয়াসমিনের। কয়েক মিনিট পর পর ফোন দিয়েছে মাহিন। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছে একই কণ্ঠ, ‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।…’

ইয়াসমিনের হোস্টেলেও খোঁজ নিয়েছে মাহিন। কিন্তু সেখান থেকে ইয়াসমিন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানতে পারেনি সে।

ভোরে সচরাচর ঘুম থেকে ওঠা হয় না মাহিনের। কিন্তু আজ কেন যেন জেগে উঠেছে সে। আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। ইচ্ছে ছিল ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ইয়াসমিনকে নিয়ে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াবে। মনের অব্যক্ত কথাগুলো বলবে তাকে। কিন্তু সে তো নেই। কোনো কিছুতেই মন বসে না মাহিনের। দুপুরের দিকে চন্দ্রিমা উদ্যানে আসে সে। যদি মনটা একটু ভালো হয়!

মাহিনের পুরো নাম ইকবাল হাসান মাহিন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে সবে চাকরি নিয়েছে একটি বেসরকারি ব্যাংকে। প্রেম ভালোবাসার প্রতি কোনো সময় আগ্রহ ছিল না তার। বরাবরই এ সব থেকে নিজেকে দূরে রাখার সম্ভাব্য পথ এড়িয়ে চলেছে। ঝামেলাই মনে হতো এ সবকে।

তা ছাড়া চোখের সামনে পরিচিত অনেক বন্ধুকেই দেবদাস হতে দেখেছে সে। মেয়েদের প্রেম-ভালোবাসার পেছনে ঘুরে ঘুরে (ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়) শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে দেখেছে অনেককে। সবচেয়ে কাছের বন্ধু শাকিলকে তো চোখের সামনে নীলা নামের এক মেয়েকে ভালোবেসে পাগল হতে দেখেছে মাহিন।

মাহিন ও শাকিলের ছোটবেলা কেটেছে এক সঙ্গে। একই স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছে দু’জন। এইচএসসি পাসের পর আলাদা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুবাদে কিছুটা দূরত্ব বাড়ে তাদের। ধানমণ্ডিতে শাকিল যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, পাশের আরেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ত নীলা। শাকিল ও নীলার সম্পর্কের কথা অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে বন্ধু মহলে। এমনকি শাকিলের বাবা মা-ও বিষয়টি জেনে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কের কথা।

প্রথমে এ সম্পর্ককে মেনে নিতে রাজি না হলেও পড়ে শাকিলের বাবা-মা মেনে নিয়েছিলেন। লেখা-পড়া শেষ করে শাকিল ছোটখাটো একটা চাকরি নিলে দু’জনের বিয়েও দিতে চেয়েছিলেন তারা। নীলার সাথে সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে ছিল যে, কাছের বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ খবর নেওয়ারও সময় ছিল না শাকিলের। শাকিল মাহিনকে মাঝে মধ্যেই বলত- জানিস মাহিন, ও আমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় ওর খোঁজ নিতে হয়। নীলা বলেছে আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। আমিও তাকে ছাড়া বাঁচব নারে...।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর শাকিল-নীলার বিয়েটা হলো না। হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল নীলা। কি কারণে নীলার এ নিরুদ্দেশ তা তার কাছ থেকে জানতে পারেনি শাকিল। কিন্তু নীলার কাছের বান্ধবী মহুয়া বলেছে-শাকিলের অল্প আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবার নাকি পছন্দ ছিল না তার।

নীলার বাবার অঢেল সম্পত্তি। বড় ভাই কানাডায় থাকে। গ্রামের বাড়িতে অনেক জমিজমা তার বাবার। বিপরীতে শাকিলের বাবা-মায়ের সাধাসিধে জীবনযাপন। শাকিলের বাবা মনসুর আলী একটি ফার্মে চাকরি করতেন, আর মা চাকরি করেন স্কুলে। সব কিছু ভেবে এক সময় সটকে পড়ে নীলা।

শাকিল সম্ভাব্য সব জায়গায় নীলাকে খুঁজেছে। ছাত্রী হোস্টেল থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার মামা বাড়িতে- যেখানে মাঝে মধ্যেই নীলা যেত। কোথাও তাকে পায়নি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। কিন্তু ঠিকানা জানা নেই শাকিলের। এরপরও যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু পরে নীলার বান্ধবীর কাছে সব কিছু জানার পর আর যেতে হয়নি।

এর পর থেকেই শাকিল কেমন যেন হয়ে গেছে। শরীরটা ভেঙ্গে পড়েছে। মুখে খোচাখোচা দাঁড়িগোফ। কোনো কাজে মন বসে না তার। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো, আর ঘুম পাড়া এখন তার কাজ। চাকরিটাও চলে গেছে তার। এরই মধ্যে বাবাও চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন একমাত্র মায়ের চাকরির উপরেই সংসার চলে তাদের। এ সবই হয়েছে ওই নীলা নামের মেয়েটির কারণে।

ইয়াসমিনের সঙ্গে মাহিনের পরিচয় বেশি দিনের নয়। বছর খানেক আগে এক কলিগের বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় তার। ওই কলিগের ছোটবোনের বান্ধবী ইয়াসমিন। মাস্টার্সে পড়ছে। প্রথমে পরিচয়, এরপর ভালো লাগা। তারপর ভালোবাসার আত্মিক সম্পর্ক।

এরপর থেকে সময় হলেই দু’জন বেড়াতে যায় রমনা পার্ক, শিশুপার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ বিভিন্ন জায়গায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দু’জন একান্তে সময় কাটানো…।

সূর্যটা এতক্ষণ মাথার উপরেই ছিল। অল্পক্ষণেই অস্ত যাবে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাহিন। বাসায় ফিরতে উদ্যত হয় সে। এরই মধ্যে জিন্সের পকেটে থাকা মোবাইলটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠ, তুই কই মাহিন? বন্ধু মাসুমের ফোন। তিন দিন আগে ও বিয়ে করেছে। মেয়েটি নাকি খুবই স্মার্ট, সুন্দরী। সম্পর্কের বিয়ে ওদের। দাওয়াত দিয়েছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি মাহিনের। মাসুমের সঙ্গে মাহিনের সম্পর্ক সেই ইউনিভার্সিটি জীবনের শুরু থেকে। একই ব্যাচে বিবিএ ও এমবিএ করেছে। বাবা সরকারি বড় আমলা। অর্থবিত্তের অভাব নেই তাদের।

হঠাৎ মাসুমের ফোন? মাহিনের ছোট করে জবাব, আমি চন্দ্রিমা উদ্যানে, তুই? আমিও তো চন্দ্রিমা উদ্যানে, জিয়ার মাজারের উত্তর পাশে। তোর ভাবিও এসেছে, এদিকে আয়। ঠিক আছে, আসছি। বলেই লাইনটা কেটে দিল মাহিন।

বুক ভরা কষ্ট নিয়ে মাসুমের দিকে এগিয়ে যায় মাহিন। জিয়ার মাজার পার হতেই চোখ ছানা ভরা। রীতিমত হতবাক-কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে মাহিন। আর একটু সামনে মাসুমের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে যে মেয়েটি বসে আছে সে আর কেউ নয়, মাহিনেরই প্রাণ-প্রিয় ইয়াসমিন।

মাহিন থমকে দাঁড়ায়। তার পা আর চলে না, প্রতিটি পা যেন কয়েক মণ ভারি হয়ে ওঠে। মাহিন পেছন ফেরে কিন্তু সে বুঝতে পারে না- তার ফিরে যাওয়া উচিত; নাকি ইয়াসমিনকে প্রশ্ন করবে, ‘কেন আমাকে নিয়ে তোমার এই ছেলে-খেলা!’

লেখক : প্রতিবেদক, দ্য রিপোর্ট।