প্রচণ্ড গর্জন শুনে চমকে যায় ইথিকা। আকাশে যে কখন এত মেঘ ঘনিয়েছে, বুঝতে পারেনি। আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চিরে দিচ্ছে বিদ্যুৎ। এমন জোরে একটা ঝড়ের ঝাপটা এলো, মনে হলো উড়িয়ে নেবে সবকিছু। নিজেকে শক্ত করে আঁকড়ে থাকে ইথিকা। ব্যালকনির একটা টব ফুলগাছসহ উড়িয়ে নিয়ে গেল বাতাস। দরজা-জানালাগুলো জীবন্ত হয়ে ছটফট করতে লাগল। ইথিকার ওড়না আর মাথার চুলগুলো বুঝি ঝড়ের সঙ্গী হওয়ার জন্য উন্মাতাল।

ঘোর দুপুরটিকে মনে হচ্ছে রাতের শুরু। এক সময় নিজের অজান্তেই ইথিকা উপলব্ধি করল, প্রকৃতির এই লীলা থেকে নিজেকে প্রতিরোধ করার সামর্থ্য তার নেই। আত্মসমর্পণ করল বৃষ্টির কাছে। তার মনে হতে লাগল, স্বর্গলোক থেকে প্রকৃতিদেবী বুঝি আজ তার সমস্ত সৌন্দর্য মেলে ধরেছে।

ইথিকার আজ এত ভালো লাগছে কেন? ছাদহীন এ ব্যালকনিতে আগেও তো বহুবার এসেছে। নাকি এর প্রকৃত কারণ তাপসের চিঠি? দুপুরে চিঠিটি পাওয়ার পর সবকিছুই ইথিকার ভালো লাগছে। তাপস তার বড় খালার ছোট ছেলে। ইথিকার চেয়ে দুই বছরের বড়। জাবিতে পড়ছে। লিখেছে, ‘সামনে পরীক্ষা তাই আসতে পারব না। দোয়া করিস।’ খুব কমন কথা। তবুও এর মধ্যে ইথিকা অন্য কিছু খুঁজে ফেরে কেন? তাপস কখনও কিছু বলেনি, তবু যখনই তাপসের চোখের দিকে তাকিয়েছে, মনে হয়েছে সে ভাষার সঙ্গে পরিচয় নেই।

কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে- বলতে পারবে না ইথিকা। আবহাওয়া কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল। এ সময় একা থাকতে গা ছমছম করে। দাদুর অসুস্থতার খবর পেয়ে বাবা-মা দেখতে গেছেন। কাপড় পাল্টে এক মগ কফি তৈরি করল ইথিকা। আধো অন্ধকারে নিজ বাড়িটাকেও কেমন যেন অপরিচিত ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যাটা এভাবেই কাটল ইথিকার। রাতে ঝিরঝির বৃষ্টির সঙ্গে বইতে লাগল জোর বাতাস।

ছোট ভাইটির সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে জুয়েলকে ওর রুমে পড়তে পাঠিয়ে দিয়ে ইথিকা চলে এলো নিজের রুমে। রাত সাড়ে ১১টারও বেশি। ক্রমেই বাড়ছে বাতাসের বেগ আর সমুদ্র-গর্জনের মতো অবিরাম শব্দ। হঠাৎ মনে হলো, ইথিকার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনির জানালায় ঠক ঠক দুটি আওয়াজ। ইথিকা বলল- ‘কে?’

আস্তে উত্তর এলো- ‘তাপস’।

প্রকৃতি বুঝি আজ অন্য খেলায় মেতেছে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় ইথিকার। ভেতরের ঝড়ের আন্দোলন বাইরের ঝড়কেও যেন হার মানিয়ে গেল। আস্তে করে দরজা খুলে দিল ইথিকা। দেখল, এক তোড়া গোলাপ হাতে নিয়ে তাপস কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে। ফুলগুলো ইথিকার দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস্ ডে’!

ইথিকা কোনো উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল- ‘সিঁড়ি ছাড়া দোতালার ব্যালকনিতে উঠলেন কীভাবে? আশপাশে তো কোনো গাছও নেই।’

তাপস নিরুত্তর। বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। ফুলগুলো হাতে নেওয়ার পর থেকেই বুকের মধ্যে অন্যরকম এক টান অনুভব করছে ইথিকা। তাকিয়ে দেখল ব্যালকনির পিলার বেয়ে তাপসের নিচে নেমে যাওয়া।

ব্যাপারটা সত্যি না স্বপ্ন- ভাবতে পারছে না ইথিকা। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তির মিলিয়ে যাওয়ার দিকে।

লেখক : প্রদায়ক, দ্য রিপোর্ট।