বাড়তি আলু রফতানির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। বরং রফতানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান দ্রুত না করলে বর্তমানের চেয়েও আলু রফতানি কমে যাবে বলে মনে করছেন রফতানিকারকরা।

বিপুল পরিমাণ আলু উৎপাদন হওয়ায় এবার দাম পাচ্ছে না কৃষক। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আলু রফতানি বাড়ানোর কথা বলছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কারণ দেশ থেকে খুব সামান্য পরিমাণ আলু রফতানি হয়ে থাকে। কিন্তু রফতানিকারকরা বলছেন, রফতানির ক্ষেত্রে নানা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেই সরকারের। তাই সহসাই বাড়ছে না আলু রফতানি।

আলু রফতানির অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি সভা আহ্বান করে কৃষি মন্ত্রণালয়। সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও আলু রফতানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক সভায় সভাপতিত্ব করেন। রফতানিকারকরা বলছেন, এ পর্যন্ত আলু রফতানি বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সুসংবাদ নেই। প্রচুর আলু উৎপন্ন হলেও রফতানিযোগ্য আলুর অভাব আছে। একইসঙ্গে তারা আলু রফতানিতে নগদ সহায়তা বাড়ানোরও দাবি জানান।

এ বছর দেশে ৯০ লাখ টনের মত আলু উৎপন্ন হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। এবার দাম না পাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় আলু ঢেলে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন কৃষকরা।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৪২ হাজার টন আলু রফতানি হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে রফতানি হয় ৩৪ হাজার ২০১ টন আলু। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে আলু রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ হাজার টন।

বাংলাদেশ আলু রফতানিকারক সমিতির (বিপিইএ) সভাপতি শেখ আব্দুল কাদের দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমাদের দেশে রফতানিযোগ্য তেমন ভালো জাতের আলু নেই। এ জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অধিক পরিমাণ ড্রাইমেটার সমৃদ্ধ আলুর জাত উদ্ভাবন করা দরকার। এখন শুধু গ্রানুলার জাতটি রফতানি করা হচ্ছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বহির্বিশ্বে এর চাহিদা কমে যাচ্ছে। পাকিস্তানের শান্তি জাতের আলুর মান অত্যন্ত ভালো হওয়ায় বিভিন্ন দেশে এর চাহিদা ব্যাপক। আমাদের টিসিআরসি (টিউবার ক্রপ রিসার্চ সেন্টার) থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় চাহিদা অনুযায়ী আলুর জাত পাওয়া যাচ্ছে না।

আলু রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এগ্রিকনসার্নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আমাদের দেশে এখনও আলুভিত্তিক কোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্প গড়ে ওঠেনি। কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি আলু রাখে। আলু পচে যায়। আলুর ‘ব্ল্যাক হার্ট’ ও ‘হলো হার্ট’ রোগের কারণে রফতানিতে সমস্যা হয়। এ ছাড়া আমাদের দেশে যে আলুর ‘গোল্ডেন নেমাটোডে’ রোগ নেই তা ইউরোপকে জানানো দরকার। এ ছাড়া মাঝে মাঝে কৃষি বিভাগ থেকে ‘ফেটোসেনিটারি সার্টিফিকেট (আলুতে কোনো ক্ষতিকর উপাদান নেই বলে সনদ)’ পেতে অসুবিধা হয়। সরকার ইনসেনটিভ ২০ শতাংশ অব্যাহত রাখলেও শিপিং ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের এনওসি (অনাপত্তি সনদ) চায়।

গ্লোবাল এগ্রোর সিইও বেলায়েত হোসেন জানান, শিপিং ডিপার্টমেন্ট যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের এনওসি (অনাপত্তি সনদ) ছাড়া কার্গো না ছাড়ে তবে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে আলু রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। কোল্ড স্টোরেজে রাখা আলু রফতানি করলে ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ এতে আলুর কার্বোহাইড্রেট ভেঙে সুগারে পরিণত হয়, ফলে মিষ্টি আলু আর রফতানি করা যায় না।

আমাদের দেশ থেকে আলু রফতানির ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসের তেমন কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না উল্লেখ করে বিপিইএ সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌসী বেগম বলেন, মিশনগুলোতে বিদেশে আলুর বাজার সৃষ্টির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, রফতানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ সহায়তা দেওয়া হলেও কাটছাঁটের পর ১৫ শতাংশের বেশি পাওয়া যায় না। আমরা সরকারের কাছে ওয়ানস্টপ পদ্ধতিতে এ সহায়তা দেওয়া ও সহায়তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছি।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেজর (অব.) জসিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, আলুর ব্যবহার বাড়াতে হলে সরকারের ওএমএস, ভিজিএফ, টিআর, কাবিখা কর্মসূচিতে চাল, গমের মত আলু দেওয়া দরকার। সরকার ইনসেনটিভ ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করলে আলু ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হবে।

তিনি আরও বলেন, সময় নির্ধারণ করে আলু রফতানি করলে বিদেশে ভালো বাজার সৃষ্টি হবে। অসময়ে আলু রফতানি করলে আলু পচে যায়। দেশে কোল্ড স্টোরেজে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আলুর গুণগত মান ঠিক থাকে না।

কোন জাতের আলু স্থানীয় পর্যায়ে খাওয়ার উপযোগী, কোন জাতটি রফতানিযোগ্য এবং কোন জাতের আলু দীর্ঘদিন হিমাগারে সংরক্ষণ করা যাবে সরকারি পর্যায়ে এর একটি সুষ্ঠু নীতিমালা থাকা দরকার বলেও মত দেন একজন ব্যবসায়ী।

অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার ফারুক দ্য রিপোর্টকে বলেন, আলু রফতানিকারক ও কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন আলু রফতানির সমস্যাগুলো আমাদের জানিয়েছে। আমরা তাদের সমস্যাগুলো বিবেচনা করছি। তাদের অনেক অভিযোগ সত্য নয়। আলু রফতানি বাড়বে দাবি করে তিনি বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই আলু রফতানির অগ্রগতির বিষয়টি জানতে পারব।

তিনি আরও বলেন, হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে আলু রফতানির জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। আমাদের দেশের আলুর গোল্ডেন নেমাটোডে ও ব্লাক হার্ট রোগের প্রাদুর্ভাব নেই। এ সম্পর্কিত যথাযথ তথ্য হর্টেক্স ফাউন্ডেশন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।

কৃষি বিপণন অধিদফতর বছরওয়ারী আলু উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ সম্পর্কিত একটি ডাটাবেজ তৈরি করবে জানিয়ে ফারুক আনোয়ার বলেন, উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর আলু রফতানি সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রতিমাসে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪)