রাজধানীর যানজট কমাতে গত মহাজোট সরকারের আমলে সড়ক বিভাগের নেওয়া ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়া, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং সর্বোপরি প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি)-এর কোনো মনিটরিং না থাকায় এগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ঝুলে পড়েছে। বিরাজ করছে এক ধরনের স্থবিরতা। কোনো কোনো প্রকল্পের মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হলেও সেগুলো এখনও শেষ হয়নি।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি’র এক প্রতিবেদনে গৃহীত এ প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রকল্পগুলোর বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে জনগুরুত্বসম্পন্ন এ প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

আইএমইডি’র প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইএমইডি প্রতিবেদন তৈরি করার পর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ হলে একনেকে অবগতির জন্য উপস্থাপন করা হয়। তবে এর সংখ্যা খুব কম। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নেয়, না নেয় সে বিষয়ে আমাদের কিছু করার থাকে না। পরবর্তীতে এ্যাকশন হলো কি না সেটা মনিটরিং করার ক্ষমতা আইএমইডি’র নেই।’

আইএমইডি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাবতলী-সোয়ারীঘাট সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রকল্পটির মেয়াদকাল ইতোমধ্যেই দু’বার বাড়ানো হলেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের উপর এটি করা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক সড়ক এ্যালাইনমেন্ট বরাবর ২৬০ ফুট ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এ্যালাইনমেন্টটির অনেক জায়গা অবৈধ দখলদারদের দখলে থাকায় সড়ক সম্প্রসারণ কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ সড়কটিকে চার লেনের পরিবর্তে আট লেন করার পরামর্শ দিয়ে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর (তৃতীয় বুড়িগঙ্গা/বসিলা) অবশিষ্ট এ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণসহ ৩টি পুরনো সেতু পুনর্নির্মাণ প্রকল্পটির অবস্থা হচ্ছে- এটির বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির বিপরীতে এ পর্যন্ত মাত্র ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের আওতায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু এ্যাপ্রোচ হয়ে কেরানীগঞ্জের সাথে ঢাকা মহানগরীর সহজ যোগাযোগ সৃষ্টি করার কথা। কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ না পাওয়া এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও স্ট্রাকচার অপসারণ না করতে পারায় এ পর্যন্ত পূর্ত কাজ শুরু করা যায়নি।

যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর সড়ক ৮ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির আওতায় যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়ককে ৮ লেন করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এডিপিতে কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দের অভাবে এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি হতাশাজনক। ইতোমধ্যেই ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটি মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের মেয়াদ থাকলেও ঠিকাদার নিয়োগ করতেই পেরিয়ে গেছে পুরো সময়। এ প্রকল্পের বিষয়ে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ১২০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ধরা হলেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় এর ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।

শিরনিটেক থেকে গাবতলী সেতু পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটির অবস্থা হচ্ছে, গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৬০ কিলোমিটার লিঙ্ক রোডের মধ্যে ১ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রকল্পটির মূল প্রস্তাবে ভূমি অধিগ্রহণ ও স্ট্রাকচার ক্ষতিপূরণ বাবদ ২২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাবে এ খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাব গত বছরের ১২ আগস্ট একনেক অনুমোদন করেছে বলে জানা গেছে।

টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির বিষয়ে ২০১১ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকের সভায় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে- সড়ক ও রেলপথ বিভাগের টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়ক চার লেন উন্নীতকরণ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হলো না। এই প্রকল্পটি এবং একই এ্যালাইনমেন্টে সেতু বিভাগ কর্তৃক প্রস্তাবিত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।

ডেমরা-আমুলিয়া-শেখের জায়গা-রামপুরা সড়ক (ডেমরা-সায়দাবাদ অংশ) নির্মাণ প্রকল্পটি দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

নবীনগর-চন্দ্রা-ডিইপিজেড সড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির কাজ অর্থবছরের মধ্যেই সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে।

গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি গাজীপুর-এয়ারপোর্ট)-এর আওতায় গাজীপুর জয়দেবপুর-টঙ্গী-উত্তরা-এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার বিআরটি রুট নির্মাণ, টঙ্গী সেতু নির্মাণ, ৫০টি বড় আর্টিকুলেটেড বাস সংগ্রহ, ৭টি ফ্লাইওভার নির্মাণ, ৩১টি স্টেশন, গাজীপুরে একটি বাস টার্মিনাল, ১৪১টি একসেস রোড উন্নয়ন, গাজীপুরে প্রায় ৩ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ৬টি মার্কেটের উন্নয়ন এবং দুদিকে ২০ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মাস ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টটির আওতায় মেট্রোরেল তৈরি করা হবে। এখন পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের একমাত্র মেট্রোরেল প্রকল্প। বাস্তব কাজ এখনও শুরু হয়নি।

দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু এ্যাপ্রোচ হতে মাওয়া লিঙ্ক রোড পর্যন্ত চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলেও এখন পর্যন্ত তা একনেকে অনুমোদন লাভ করেনি। দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করতে পরিকল্পনা কমিশনকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে।

(দ্য রিপোর্ট/জেজে/এসআর/এনআই/এইচএসএম/ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪)