হেমন্তের সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মহড়া কক্ষে প্রবেশ করেই শোনা গেল নির্দেশক মাসুম রেজার রাগান্বিত কণ্ঠস্বর। ‘কামাল তোর কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। আরও প্রসন্ন। স্বাভাবিকভাবে সংলাপটা বল।’

সংলাপ প্রক্ষেপণ থেকে অভিনয়শিল্পীদের দেহভঙ্গি সব কিছু নিয়েই ভাবতে হচ্ছে নির্দেশক মাসুম রেজাকে।

ঢাকার মঞ্চে ১৬ বছর পর নাটক নির্দেশনা দিচ্ছেন মাসুম রেজা। দেশ নাটকের প্রযোজনায় ‘সুরগাঁও’ নামের নাটকটি ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হবে। এ নাটকের মহড়া নিয়েই এখন ব্যস্ত সময় কাটছে মাসুম রেজার।

সর্বশেষ ২০০০ সালে ‘নিত্যপুরাণ’ নির্দেশনা দিয়েছিলেন মাসুম রেজা। এই নাটকের রচয়িতাও ছিলেন তিনি। সেটিও দেশ নাটক মঞ্চস্থ করে। এর ১৬ বছর পর মঞ্চে নির্দেশনা দিচ্ছেন। নাটকের নাম ‘সুরগাঁও’। মাসুম রেজাকে নাট্যকার হিসেবেই চেনেন সবাই। নাট্যকার মাসুম রেজা এরই মধ্যে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।

নিত্যপুরাণ ছাড়াও মঞ্চে তার রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হল, নাট্যকেন্দ্রের ‘আরজ চরিতামৃত’, থিয়েটার বেইলী রোড-এর ‘কুহকজাল’, থিয়েটার সেন্টার-এর ‘শামুকবাস’, পদাতিক নাট্য সংসদের ‘জলবালিকা’।

নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও নির্দেশক মাসুম রেজা এদেশের নাট্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। মাসুম রেজা অবশ্য নাট্যকার হিসেবেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তাই তো সুরগাঁও নাটক প্রসঙ্গে মাসুম রেজা বলেন, ‘এটি একটি নাট্যকার নির্দেশিত নাটক’। সম্প্রতি নাট্যকার-নির্দেশক মাসুম রেজার মুখোমুখি হয়েছিলেন দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক পাভেল রহমান। আলাপচারিতার কিছু অংশ প্রকাশ করা হলো। ছবি হাসান রেজাউলের সৌজন্যে।

আপনি তো ১৬ বছর পর মঞ্চে নাটক নির্দেশনা দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, প্রায় ১৬ বছর পর নাটক নির্দেশনা দিচ্ছি। তবে নাটকের পোস্টার-ব্যানার কোথাও লেখা থাকবে না- নির্দেশক মাসুম রেজা। এটি একটি নাট্যকার নির্দেশিত নাটক। অর্থাৎ এই নাটকের নাট্যকার যিনি, তিনিই নির্দেশক। আমাদের দল ‘দেশ নাটক’ থেকে অনেক দিন পর নতুন নাটক মঞ্চে আসছে। সব মিলিয়ে অনেকের আগ্রহ তৈরি হয়েছে নাটকটি নিয়ে। আগ্রহ যেমন তৈরি হয়েছে, একধরনের চাপও তৈরি হয়েছে। সব চাপ অতিক্রম করে মঞ্চে আমরা একটা ভালো নাটক দেখাতে পারব বলে মনে করি।

সুরগাঁও নাটক প্রসঙ্গে জানতে চাই?

সুরগাঁওকে আমি বলছি, পৃথিবীর মানচিত্র বহির্ভূত একটি গ্রাম। প্রথিবীর মানচিত্রের কোথাও এই গ্রামের কোন অস্তিত্ব নেই। কোন নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমেও এটি বন্দি নয়। যে সময় দর্শক এটি দেখবেন, তিনি সেই সময়ের সঙ্গেই মিলিয়ে নিতে পারবেন। সেই গ্রামে আমার মগজে প্রথিত ভাবনার উপস্থাপন করেছি, মূর্ত করেছি বিমূর্ত রূপে। সুরগাঁও পৃথিবীর মানচিত্রের বাইরের একটি গ্রাম হলেও এই গ্রামের একটা নির্দিষ্ট মানচিত্র আছে। এখানে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা রয়েছে। জায়গাগুলোর নামকরণের পেছনেও কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। এই গ্রামেরই একটি চরিত্র আনাল ফকির। যে কিনা পৃথিবীর ইতিহাসের সঙ্গে ভ্রমণ করে। ইতিহাসের অনেক কিছুর সঙ্গে তার ভ্রমণের গল্প মিলে যায়।

আপনি তো সর্বশেষ নিত্যপুরাণ নির্দেশনা দিয়েছিলেন?

মহাভারতের আদলে নয়া মিথ একলব্যের কাহিনী নিয়ে ‘নিত্যপুরাণ’ লিখেছিলাম। এবার আসছি মগজ বাস্তবতার গল্প সুরগাঁওয়ের মানুষের গল্প বলতে। সুরগাঁও কল্পনাপ্রসূত একটি গ্রাম। সেই গ্রামে আমার মগজে প্রথিত ভাবনার উপস্থাপন করেছি, মূর্ত করেছি বিমূর্ত রূপে। সুরগাঁও এক অচিন গাঁ, হয়ত সুরগাঁও নামে কোন গ্রাম আছে। তবে জল-জঙ্গল, জমিনের মানচিত্রনগরে সুরগাঁও নামে কোন লোকালয় আছে কিনা নিশ্চিত নয় কেউ। কল্পনাপ্রবণ মানুষের মগজে এর বাস। এখানে অসামান্য প্রত্নকাল, সদ্য বর্তমান আর সম্ভাবনার সামনের দিন। এই তিন সত্য মিলেমিশে থাকে। সুরগাঁওয়ের বাস্তবতাও পরিলক্ষিত বাস্তবতার ঊর্ধে্ব কোন কোন মানুষের মগজ বাস্তবতার সমান্তরাল।

মগজ বাস্তবতার বিষয়টি যদি আরেকটু বিস্তারিত বলেন?

সুরগাঁওকে আমি বলছি আমার মগজ বাস্তবতার গ্রাম। আমার মগজে যা যা ঘটে তার সবকিছুই সেই গ্রামে ঘটতে দেখা যায়। প্রতিটা মানুষই তার মগজ বাস্তবতায় কিছু কিছু না কিছু ভাবে। নাটকটি দেখে হয়তো চলমান বাস্তবতার কিছু কিছু বিষয়ের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। থিয়েটারের বাস্তবতায় চিন্তার সীমনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছি।

সুরগাঁও লিখেছিলেন কবে?

এই নাটকের গল্পটা নিয়ে ভেবেছি অনেক বছর। তবে এটি লিখতে আমার সময় লেগেছে ৭ দিন। ২০১৫ সালে এই নাটকটি লিখেছি।

নাটকের অন্যান্য ডিজাইন কারা করছেন?

সব মিলিয়ে ২০ জনের মতো একটি টিম মঞ্চে অভিনয় করবে। এছাড়া আলোক পরিকল্পনা করবেন নাসিরুল হক খোকন। সঙ্গীত পরিকল্পনা করবেন শিমুল ইউসুফ এবং তার সঙ্গে থাকবেন তরুণ মেধাবী সঙ্গীত নির্মাতা পৃথ্বিরাজ। পোশাক পরিকল্পনা করবেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি, সেট পরিকল্পনা করবেন প্রাণ রায়। পোস্টার ও প্রকাশনা পরিকল্পনা করবেন রাফি হক। নাটকে কিছু নৃত্যের কাজ থাকবে সেটি করবেন মুনমুন আহমেদ।

নাটকটি এ সময়ের সঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক হবে?

এটা দর্শক বিবেচনা করবেন। আমি শুধু থিয়েটারের জানালায় আমার সৃষ্টিকে দেখতে চাইছি। এখন ঢাকার মঞ্চে নিরীক্ষাধর্মী কাজ খুব কম হচ্ছে। পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়। আমাদের স্বপ্ন কেন আরও বিস্তৃত হবে না। আমি চাই, থিয়েটারের জানালাটা আরও বড় হোক।

সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

আপনাকেও ধন্যবাদ। আর সবাইকে আমন্ত্রণ ‘সুরগাঁও’ দেখার জন্য। আগামী ২০ জানুয়ারি জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটি দেখতে আসুন সবাই।

(দ্য রিপোর্ট/পিএস/এফএস/এনআই/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬)